উই স্যাল ওভারকাম…

গত ৯ আগষ্ট কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী ডাক্তারের উপর যে জঘন্যতম ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে গেল তারপর প্রায় এক মাস কেটে গেল, তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে নির্দিষ্ট করে কিছু নির্ধারণ সম্ভব হলো না। এও এক সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কর্তব্যে গাফিলতি বা অনুপযুক্ততার ঘটনা। ৯ আগষ্টের ঘটনার পাশাপাশি এই ঘটনাও যেন আমাদের দিনের পর দিন বিহ্বল থেকে বিহ্বলতর করে চলেছে। বিশ্বকবির প্রবাদপ্রতিম লাইনদুটি মনে পড়ে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’ বিশ্বায়নের পর থেকে মানুষের গায়ের চামড়া গন্ডারের থেকেও মোটা হয়ে গেছে। হাতে একটি স্মার্টফোন আর কানে হেডফোন- এই হলো সাধারণভাবে এক তরুণ-তরুণীর চেহারা। চলার পথে কোন অন্যায় ঘটলে সে অবলীলাক্রমে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। তবে আরজি করের ঘটনার পরে চলমান জন-প্রতিবাদ এক অভূতপূর্ব মাত্রা নিয়েছে যা স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এক বিরলতম ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

আরজি করের ঘটনার দিন পুলিশ এবং হাসপাতাল প্রশাসন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছে। সামান্য খুনের ক্ষেত্রেও যে তৎপরতা দেখানো হয়, তার লেশমাত্র দেখা যায়নি হাসপাতাল প্রশাসনের কাছ থেকে। হাসপাতালের অধ্যক্ষ এই ঘটনার পরবর্তী করণীয় কর্তব্য কি করে দুঃসাহসিক ভাবে এড়িয়ে গেলেন। তরুণীর মা-বাবা আইনত তার কাছ থেকে এই জবাব চাইতে পারেন যে “আপনার তত্ত্বাবধানে আমাদের সন্তানকে রেখে আমরা কী অপরাধ করেছি? আপনি কেন আমাদের বিভ্রান্ত করলেন? কেন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলেন না? কেন হাসপাতালের তরফ থেকে এফআইআর হলো না? পুলিশকে জানাতে দেরি হলো কেন?” আর পুলিশ প্রধানের কাছেও বাবা-মা জানতে চাইতে পারেন, ‘আপনি তো সুরক্ষা দিতে অপারগ হলেন। কিন্তু, আপনারও তো সন্তান আছে। তার ক্ষেত্রে আমাদের মেয়ের মত আপনি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতেন?’ তাই বাবা-মা’র এই সব দাবিরই বহিঃপ্রকাশ দেখাচ্ছে দিনের পর দিন আম-জনতা দলমত-নির্বিশেষে প্রতিবাদে সামিল হয়ে। সাধারণ জনগণ যদি নির্যাতিতা তরুণীর প্রতি এই সমবেদনা দেখাতে পারে, তবে মুখ্যমন্ত্রী বা তার প্রশাসন কি করে চুপ করে আছেন? ‘অপরাজিতা’ এক বাহারি নাম দিয়ে ধর্ষণের অপরাধ- সংক্রান্ত এক আইন পাশ করালেন। তাতে ধর্ষণের অপরাধের প্রমাণ লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কি সংস্থান রাখা আছে, তা জানা জরুরী। বিশেষ করে আরজি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের আশা-প্রত্যাশা তাই হবে।

রাজ্য সরকার এবং তদন্তকারী সংস্থার হালচাল দেখে মানুষের রোষ একবিন্দু কমেনি। কি করে কমবে? আমরা সবাই জানি ২০১২ সালে ২৩ বছর বয়সী দিল্লির ছাত্রী জ্যোতি সিং-এর গণধর্ষণ এবং হত্যার পরে সারাদেশব্যাপী প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছিল। সরকারকে কঠোরতম আইন এনে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলো। সেই বছরেই চালু হলো শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতন বিরোধি পকসো আইন। তারপরে ধর্ষণ, শিশুদের যৌন-নির্যাতনসহ খুনের ঘটনা ভয়ঙ্করভাবে ক্রমবর্ধমান। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) রিপোর্ট অনুযায়ি দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯০ টি ধর্ষণ হচ্ছে। এতো পঞ্জীকৃত অপরাধের কথা। এর বাইরে আরো কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, যে ক্ষেত্রে অপরাধের শিকার ভয় বা সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অপরাধকে বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না? এ কোন গণতন্ত্র? যেখানে অর্ধেক আকাশের কোন অস্তিত্ব নেই, নেই “অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”-এর মূল্যবোধ। তাই প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই আমরা ধর্ষণের খবর দেখতে পাই। মনে হয় যেন বৃহত্তর সমাজকে এক নতুন স্বাভাবিকতাকে মেনে নিতে বলা হচ্ছে অসহায় রাষ্ট্রকে ঠুটো জগন্নাথের মত সাক্ষী রেখে। ভারতবর্ষ নামক তথাকথিত অর্থনীতিতে দ্রুত প্রগতিশীল দেশের নাগরিক হতে গেলে এই মূল্য মেনে নিতে হবে। বিকল্প কিছু নেই। আইন করে দিয়েছি। আমাদের কর্তব্য আমরা পালন করেছি। প্রতিনিধি নির্বাচিত হবার পর সংসদে গিয়ে না বসি বা অধিবেশন ভন্ডুল করে দিয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকি, আমরাই দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ধনী সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক। অন্যদের সঙ্গে নয়। ওরাই আমাদের নির্বাচনের অর্থ জোগায়। আমরাও তাই ওদের দেখি। তোমরা আমাদের তার লক্ষ ভাগের এক ভাগও দিতে পারবে না। সেই একই মানসিকতার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক এবং আর জি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আয়নায়।


গত মে মাসে ২৮ বছর বয়সী এক স্পেনীয় তরুণী তাঁর ৬৪ বছর বয়সী স্বামীর সামনে গণধর্ষিতা হয়েছেন ঝাড়খন্ডের দুমকাতে। দম্পতি তাদের মোটরসাইকেলে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতে এসেছিলেন। ঠিক কয়েকদিন পরে ২১ বছর বয়সী এক মঞ্চশিল্পী তাঁর ছত্তিশগড় নিবাসী সহশিল্পীদের দ্বারা গণধর্ষিতা হয়েছেন ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলাতে। এই দুই ঘটনার ঠিক আগে উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে ১৭ বয়সী আর এক তরুণী গণধর্ষিতা হয়েছেন, এক বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরার পথে। এক বিদেশি-বিদেশিনীর কী ধারণা হোল? কী ধারণা হলো মঞ্চশিল্পীর পরিচিত সহশিল্পীদের সম্পর্কে? আর বিবাহ অনুষ্ঠানের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া কি নারীদের অপরাধ?

২০১৭ সাল থেকে এনসিআরবি ধর্ষণের পাশাপাশি একাধারে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পৃথক তথ্য রাখছেন। এর থেকে দেখা যাচ্ছে, যে এই শ্রেণীতে ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১,৫৫১ ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০১৮ সালে- ২৯৪ জন এবং সবচেয়ে কম ঘটেছে ২০২০ সালে ২১৯ জন। করোনা অতিমারী, লকডাউন ইত্যাদি প্রতিকূল পরিবেশেও রেহাই পায়নি নারী, কারণ ২১৯ জন সংখ্যাটা কি নিতান্ত কম? রাজ্যওয়ারি হিসেবে সবচেয়ে বেশি এই শ্রেণীর ঘটনা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে ২৮০ জন। এর পর মধ্যপ্রদেশ (২০৭), আসাম (২০৫), মহারাষ্ট্র (১৫৫) এবং কর্ণাটক (৭৯) জন। আসামে মত অনেক কম জনসংখ্যার রাজ্যে মহারাষ্ট্রের থেকে বেশি ঘটনা নথিভুক্ত হলে ধরে নেওয়া যায় তথ্য ত্রুটিপূর্ণ বা মহারাষ্ট্রে অনেক অপরাধ অপঞ্জীকৃত রয়ে গেছে। এবার আসি গড় হিসাবে। ২০১৭-২০২২ সময়কালে গড়ে প্রতি বছর ২৫৮টি ঘটনা নথিভূক্ত হয়েছে, তার অর্থ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫টি ধর্ষণ-খুনের ঘটনা হয়েছে। কি ভয়ঙ্কর চিত্র? নথিভূক্ত হয়নি এমন ঘটনা ন্যূনতম হিসেবে ধরে নিলেও দিনে একটি শুধু ধর্ষণ নয়, তার সঙ্গে খুনও সংঘটিত হয়েছে। অপরাধী মানসিকতা কোন পর্যায়ে গেছে। এর অর্থ পুরুষতন্ত্র যেন ধর্ষণের মাধ্যমে নারীকে বোঝাতে চাইছে তোর নারীত্বকে আমরা ধুলোর মত উড়িয়ে দিই আর খুন করে বলছে তোর অস্তিত্বই আমরা মানি না। এ ছাড়া আর কী মানসিকতা বেরিয়ে আসে এই সব ঘটনাপরম্পরা থেকে? তাহলে বোঝা যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীর উপরে পুরুষতান্ত্রিক স্পর্ধাকামী আধিপত্য যেন বেড়েই চলেছে। এর প্রধান কারণ বিশ্বায়নের পড়ে ভোগবাদি সমাজের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি, যেখানে নারীকেও পণ্য করে দেখা হচ্ছে আরো বেশি করে। আইন কোন ভাবেই এই প্রবণতাকে রুখতে পারছে না। এই তত্ত্বের জাজ্বল্য উদাহরণ আর জি কর ঘটনাকে তাই সাধারণ মানুষ ভুলতে পারছে না।

এই ঘটনা যে ভোলা সহজ নয় তা তথ্য দিয়েই বোঝাই। এনসিআরবি’র তথ্য আরো বলছে, বিভিন্ন নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ধর্ষণ-খুনের মামলা ২০১৭ সালের পর থেকে বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালের শেষে যা ছিল ৫৭৪ তা ২০২২ সালে শেষে দাঁড়িয়েছে ১,৩৩৩ এ। আইনকে কঠোর করে কি লাভ হলো? এতো উলট-পুরাণ! আরো বাকি আছে। তদন্তের পরে অনেক ক্ষেত্রেই চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। ২০১৭-২০২২ সময়কালে ১৪০টি ধর্ষণ-খুনের অভিযোগের ক্ষেত্রে পুলিশ শুধুমাত্র চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে চার্জশিট দিতে পারেনি বলে। অর্থাৎ প্রমাণসাপেক্ষ তথ্যসাবুদ জোগাড় করতে পারেনি। ভাবা যায়, যেখানে ধর্ষণ এবং খুন দুইয়ের মতো ভয়ঙ্করতম ঘটনা ঘটলো সেখানে তথ্যপ্রমাণ নেই? এখানেই উঠে আসে, তদন্তকারী সংস্থার উদাসীনতা বা কর্তব্যে অবহেলা কিংবা কোন প্রভাবশালীর প্রতি পুলিশের আনুগত্য প্রকাশের সম্ভাবনা। কারণ হিসেবে এনসিআরবি’র তথ্যে উঠে এসেছে- যথেষ্ট প্রমাণ না থাকা, অভিযুক্তকে খুঁজে না পাওয়া, অভিযোগ মিথ্যা হওয়া। ধর্ষণ এবং খুন ঘটে গেল, পুলিশ এফআইআর গ্রহণ করলো, তদন্তে নামলো আর তার পরে বলল যে অভিযোগ মিথ্যা। হ্যাঁ, ভারতের মতো ফানুস-গণতন্ত্রে সব সম্ভব। সত্যি করেই তাই মেনে নিতে হয় আইনের চোখ থাকতে নেই, নিরপেক্ষ বিচারের জন্য নয়, ন্যায়বিচারের অধিকার খর্ব করার জন্য।

এই সমস্ত বিষয়ের চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে ফেলেছে সাধারণ মানুষ। গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিবাদ মিছিল করে লালবাজারে গিয়ে নগরপাল বিনীত গোয়েলের টেবিলের উপর প্রতীকী শিরদাঁড়া রেখে নগরপালের মুখে চরম চপেটাঘাত করেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আলোচনার শেষে নির্লজ্জ নগরপাল কি করে প্রতিবাদি জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ রাখেন, ‘দুর্গাপুজো আসছে, তাই আপনারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সাহায্য করুন?’ সঙ্গে সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তাররা বিনীতকে বিনীতভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘স্যার, কথাটা ভালো লাগলো না।’ বিনীত যে নবান্নের বিনীত কর্মচারি তাই বোঝা গেল আর বোঝা গেল নবান্নও আশায় আছে যে আর একটা মাস কাটলেই বাঙালী দুর্গাপূজায় মেতে উঠবে আর প্রতিবাদ-আন্দোলন হিমঘরে ঢুকে যাবে।

নাটকের প্রথম পর্বের যবনিকা পতন হল ৯ সেপ্টেম্বর, যেদিন সুপ্রীম কোর্টে ৪ সেপ্টেম্বরের স্থগিত শুনানি গৃহীত হোল। এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতির কথা সুপ্রীম কোর্ট উল্লেখ করলেন যে বিষয়ে সিবিআই বা রাজ্য সরকারের উকিলের কাছে কোন তথ্য নেই। সেটি হলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো মৃতদেহ এবং অন্যান্য সামগ্রীর চালান। তবে, শীর্ষ আদালতের মন্তব্যে জানা গেছে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদর্থক উৎস সিবিআই পেয়েছে। সেই বিষয়ে সিবিআইকে আবার আগামী শুনানির দিন ১৭ সেপ্টেম্বরের আগে আদালতে জমা দিতে হবে। শীর্ষ আদালত জুনিয়ার ডাক্তারদের ১০ তারিখ বিকেল ৫ টার মধ্য কাজে জমা দিতে বলেছেন। স্পষ্টত জুনিয়ার ডাক্তাররা অখুশি। তবে তাদের বিকল্প উপায় বার করতে হবে জনস্বার্থে। মৃত্যুর ঘটনার এক মাস পূরণ হওয়া ৯ সেপ্টেম্বরের রাতেও আন্দোলন চলেছে, প্রতীকী নীরবতা পালনের মাধ্যমে। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে চলমান আন্দোলন থেমে যাবে। কারণ, এখনো পর্যন্ত মাত্র তিনজনই গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর তদন্তের মধ্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে মূল তদন্তকে হালকা করে দিয়েছে। শেষে শুধু জানাবো পিট সিগারের কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া সেই অমর গানের কথা, ‘উই স্যাল ওভারকাম’, যা গাইতে গাইতে জুনিয়ার ডাক্তারেরা লালবাজারে গিয়েছিলেন। আশা রাখি এই মন্ত্র নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন এগিয়ে যাবে।