• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল’

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছাত্রদের উদ্দেশে এক জায়গায় বলেছিলেন, “ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষা পাশ ও স্বর্ণপদক লাভ নহে— দেশসেবার জন্য চাই প্রাণের সম্পদ ও যোগ্যতা অর্জন করা। দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিব— ইহাই একমাত্র সাধনা হওয়া উচিৎ। এই সাধনার আরম্ভ ছাত্রজীবনেই করিতে হইবে।”

যখন আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ শহরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে জেলা স্তরে, নাগরিক সমাজের সঙ্গে পড়ুয়ারাও তাতে অংশগ্রহণ করছে, তখন রাস্তায় নেমে আন্দোলনে পড়ুয়াদের অংশগ্রহণ নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। এ ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ১৯০৫ সালের কার্লাইল সার্কুলারের কথা। সেই বছর ২২ অক্টোবর তদানীন্তন বাংলা সরকারের মুখ্য সচিব আর ডব্লিউ কার্লাইল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণ ঠেকাতে সার্কুলারের মাধ্যমে অনুরূপ নিদান দিয়েছিলেন। আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে সারা রাজ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেছেন। সরকারের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে স্কুল-ছাত্রদের শিক্ষা দফতর ব্যতীত অন্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। প্রয়োজনে শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এখানে প্রশ্ন, কবে, কোন ছাত্র বা শিক্ষক আইন মেনে সমাজ প্রগতির কাজে যুক্ত হয়েছেন?

কাজ যখন ন্যায়সঙ্গত হয়, সে ক্ষেত্রে আইন গৌণ হয়ে যায়। হেমচন্দ্র কানুনগো, বেণীমাধব দাস, সূর্য সেন, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ শিক্ষকের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। কারণ তাঁরা দেশের ছাত্র যুবকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলেন। তাঁরা সবাই ছাত্র-যুবকদের দেশের কাজে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এই ধরনের শিক্ষকদের থেকেই ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়, বাদল, দীনেশ, প্রীতিলতা, সুনীতি, নেতাজিদের সৃষ্টি। মনুষ্যত্ব অর্জনের প্রাথমিক পাঠ বাবা-মায়ের থেকে পেলেও, প্রকৃত মানুষ তৈরিতে শিক্ষকদের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যায়ের প্রতিবাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগরিত হয়। যুগে যুগে ছাত্র-যুবকরাই তো সমাজ পরিবর্তনের ঝান্ডা তুলে ধরেছে। স্বাধীনতা উত্তর নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে আশির দশকে ইংরেজি ও পাশ-ফেল চালুর দাবিতে ছাত্ররাই আমাদের রাজ্যে পথে নেমেছিল। উনিশ বছর লড়াইয়ের পর পুনরায় ইংরেজি চালু করতে সরকার বাধ্য হয়। ফলে, এত বড় ঘটনায় ছাত্রসমাজ সরে থাকবে কী করে?

আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ার উপর বর্বরোচিত অত্যাচার, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্যভবন ও প্রাক্তন অধ্যক্ষের অনুগত ডাক্তারি পড়ুয়াদের একাংশের ভূমিকা আতশকাচের নীচে। সম্ভবত শাসক দলের অতি বড় সমর্থকও এ কথা আজ বিশ্বাস করেন না যে, জনৈক সিভিক ভলান্টিয়ার এই ঘটনার একমাত্র অপরাধী। বরং রাজ্যবাসীর মনে প্রত্যয় ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে যে, এটি একটি সংগঠিত খুন এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে এই নারকীয় ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ও হয়ে চলেছে। আদালতের নির্দেশে সিবিআই এ ঘটনার তদন্তভার হাতে নিয়েছে। নাগরিক সমাজ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ দাবির পাশাপাশি দক্ষ গোয়েন্দাদের কাছ থেকে আশা করছে তিনটি মৌলিক প্রশ্নের সদুত্তর— কারা অপরাধটা করল? কী ভাবে করল? কেন করল? সন্দেহ নেই গোটা প্রশাসন সহ মুখ্যমন্ত্রী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। সারদা, নারদা, কয়লা-গরু-পাথর-বালি পাচার, শিক্ষকের চাকরি লুট, রেশন কেলেঙ্কারি, পার্ক স্ট্রিট-কামদুনি-হাঁসখালি গণধর্ষণ, বগটুই জতুগৃহ ইত্যাদি কঠিন বাউন্সার সামলে আরজি কর কাণ্ডে বেসামাল হয়ে পড়েছেন।

এই অবস্থায় সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে ফতোয়া জারি করে সরকার আসলে দিশাহীনতারই পরিচয় দিল। শাসক দল ঘনিষ্ঠ কয়েক জন বাছাই করা সেলেব্রিটি বাদে নাগরিক সমাজের ব্যানারে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে আজ শামিল হয়েছেন। ডাক্তার, উকিল, ছাত্র, যুব, শিক্ষক, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ফুটবল সমর্থক, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, বিদ্বজ্জন, অভিনেতা, লেখক, গায়ক, নাট্যকার, চিত্রকর— কে নেই তালিকায়। বিচারের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সরব হতে দেখা যাচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের মহিলাদের। তাঁদের একাংশ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রাপক উপভোক্তা-সত্তার বেড়া ভেঙে আজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। সমাজে নাড়া দিয়ে যাওয়া এই ঘটনায় যে স্কুল-ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিবাদে যোগ দেবে, এমনটাই স্বাভাবিক। অথচ, প্রশাসন ফতোয়া জারি করে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে বেড়ি পড়াতে চাইছে।

প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভায়, কন্যাশ্রীর বিজ্ঞাপনে বা দুর্গাপুজো প্যারেডে স্কুল-ছাত্রছাত্রীদের হাঁটানোর যৌক্তিকতায়। হাওড়ার তিনটি স্কুলে শো-কজ় নোটিস ধরানো হয়েছে। অর্থাৎ, প্রশাসন আর জি কর বিষয়ে চূড়ান্ত ভাবে দোদুল্যমান। হিটলার শাসনের দমবন্ধ অবস্থায় ‘হোয়াইট রোজ়’ নামে এক গুপ্ত সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারি ছাত্র হান্স শোল, তাঁর বোন সোফি শোল ও আর এক ডাক্তারি ছাত্র প্রোবস্ট ছিলেন এর মাথা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩-এ হান্স ও সোফি একটি সুটকেস হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে গুচ্ছ গুচ্ছ ইস্তাহার শ্রেণিকক্ষ, বারান্দায়, সিঁড়িতে উড়িয়ে দেন। পাহারাদার জ্যাকব ছুটে এসে তাঁদের পাকড়াও করে। জনগণের মন দুর্বল করা, হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি একাধিক অভিযোগে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হান্স, সোফি ও প্রোবস্টের বিচার সম্পন্ন হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁদের মৃত্যুদণ্ড সম্পন্ন হয়। ছাত্রছাত্রীদের তাই শাসক ভয় পায়। ‘হোয়াইট রোজ়’-এর শিক্ষা অন্তত তাই বলে।

তা হলে ছাত্রদের কাজ কি কেবল পড়াশোনা করা? এ নিয়ে আমাদের দেশের গুণী মানুষেরা কী বলেছিলেন? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছাত্রদের উদ্দেশে এক জায়গায় বলেছিলেন, “ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষা পাশ ও স্বর্ণপদক লাভ নহে— দেশসেবার জন্য চাই প্রাণের সম্পদ ও যোগ্যতা অর্জন করা। দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিব— ইহাই একমাত্র সাধনা হওয়া উচিৎ। এই সাধনার আরম্ভ ছাত্রজীবনেই করিতে হইবে।” রবীন্দ্রনাথ যখন বলেছিলেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”, তখন কি শুধু বলতে চেয়েছিলেন, ছাত্ররা এ কথা আমার মুখস্থ করো, পরীক্ষার খাতায় লিখে নম্বর তোলো, কিন্তু চোখের সামনে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ কোরো না? নজরুল যখন বলেছিলেন, “ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?” কাকে বলেছিলেন? ছাত্র-যুবকদের হিম্মতের কাছেই তো ছিল তাঁর আহ্বান। ‘বেনু’র কিশোর পাঠকদের উদ্দেশে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, “বয়স কখনোও দেশের ডাক থেকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক থেকে কাউকে আটকে রাখতে পারেনা, তোমাদের মত কিশোর-বয়স্কদেরও না। একজামিনে পাস করা দরকার— এ তার চেয়েও বড় দরকার। ছেলেবেলায় এই সত্যচিন্তা থেকে আপনাকে পৃথক করে রাখলে যে ভাঙার সৃষ্টি হয়, একদিন বয়স বাড়লেও আর তা জোড়া লাগতে চায় না। এই বয়সের শেখাটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। একেবারে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়।” বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “যে শিক্ষা মানুষকে তেজ দেয় না, সাহস দেয় না, চরিত্র দেয় না, মনুষ্যত্ব দেয় না, সে শিক্ষা আবার কিসের শিক্ষা? শুধু ডিগ্রি পাশ দিলেই কি শিক্ষা হয়?”এই গুণী মানুষদের চিন্তার বিপরীতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ যখন এই নির্দেশ পাঠায়, তখন সত্যিই মনে হয়, সত্যকে আড়াল করার জন্য তবে কি এ নতুন আর এক পদক্ষেপ?