পরিবেশবিদদের সব সতর্কীকরণ এবং আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনে নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মধ্যপ্রদেশের কেন্ ও বেতোয়া নদীর সংযুক্তিকরণের শিলান্যাসের মাধ্যমে।
ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড বা জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প কোনও মৌলিক ভাবনা নয়। দেড় শতাব্দী আগে ব্রিটিশরাও এই প্রকল্পের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছিল। নদী সংযোগ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্লাবিত নদীগুলোর সঙ্গে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের মরসুমি নদীগুলোর সংযোগ ঘটানো। ২০০০-এর প্রথম দশকে এই জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প আবার মাথাচাড়া দেয়। সেই সময় একের পর এক বন্যায় ও খরা পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে জলের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, সেই সময় জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে কথাবার্তা নতুন করে শুরু হয়েছিল।
ভারতে নদী সংযুক্তিকরনের ধারনা প্রথম আসে ১৮৫৮ সালে, যখন ইংরেজ অফিসার স্যার আর্থার কটন, এই বিষয়ে প্রথম কথা বলেন। যিনি কৃষ্ণা ও গোদাবরীর ওপর দুটো বাঁধ তৈরি করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল অধিক জল সরবরাহ রয়েছে এমন নদীগুলোকে খাল দিয়ে যুক্ত করা হবে যে নদীতে জল-ঘাটতি রয়েছে তার সাথে। তিনি ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের নদীগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে তা বলেছিলেন, যা ভারতীয় নদীগুলো থেকে প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা। এই অর্থে যে, গোটা বছর ধরে ইউরোপীয় নদীগুলোর জল স্তরের পার্থক্য খুব সামান্য থাকে। সাধারণত, ইউরোপীয় নদীগুলোর ক্ষেত্রে বছরের যে কোনও সময়েই এই পরিবর্তন ২০ শতাংশের বেশি হয় না। কিন্তু ভারতে, এই পরিবর্তন ৮০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই, গ্রীষ্মকালে এবং বর্ষায় নদীগুলোর চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি নদ-নদীকে ৩০টি সংযোগ খাল দ্বারা সংযুক্ত করা হবে। যার মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার কিলোমিটার। এদের মধ্যে কিছু নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে, এদেরকে বলা হয় ‘হিমালয়ান’ নদী। এই নদীগুলোকে ১৪টি খালের দ্বারা সংযোগ ঘটানো হবে। বাকি নদীগুলো দক্ষিণ ভারতের। এদের বলা হয় ‘পেনিনসুলার’ নদী। এদের ১৬টি খালের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। তৈরি করা হবে ছোট বড় ৩ হাজার জলাধার। খালগুলো ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মত প্রশস্ত হবে। গভীরতা হবে প্রায় ৬ মিটার। প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১১ লক্ষ কোটি টাকা। সংক্ষেপে বললে, পরিকল্পনা বা প্রকল্পের দুটি বড় অংশ আছে। গঙ্গা ও তার কয়েকটি উপনদী যথা গন্ডক, ঘাগরা, সারদা ও যমুনা নদীকে খাল কেটে সংযুক্ত করা হবে। এ জল সুদূর রাজস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশে আছে ব্রহ্মপুত্র নদী। গঙ্গা ও তার উপনদী থেকে যে জল সরানো হবে, তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্রের জল দ্বারা। সে ক্ষেত্রে দুটি খাল খনন করা হবে— (১) মানস-সংকোষ-তিস্তা সংযোগ ও (২) যোগী ঘোপা-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল। গঙ্গার তুলনায় ব্রহ্মপুত্র নিচু দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই পাঁচটা ধাপে ব্রহ্মপুত্রের জলকে ১০০ মিটার উচুঁতে তুলে তারপর গঙ্গায় ফেলা হবে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের জলের মাধ্যমে পূরণ করা গঙ্গার জল প্রবাহ কিন্তু ফারাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে আসবে না, চলে যাবে সুদূর দাক্ষিণাত্যে। ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে সংযোগ খাল কেটে ওড়িশার সুবর্ণরেখা ও মহানন্দার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে। তারপর মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ও ভাইগাই নদ-নদীগুলোকে সংযুক্ত করে কর্ণাটক, কেরেলা, তামিলনাড়– রাজ্যে জল সরবরাহ বাড়ানো হবে।
ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ভারতের পরিবেশবিদ বন্দনা শিভা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থার নামান্তর মাত্র’। তিনি আরো মন্তব্য করেছিলেন ‘এটা একটা দুর্নীতির মহাপ্রকল্পের প্যাকেজ, যেটা ভারতের জীবন নির্ধারণী ইকো-সিস্টেমকে ধ্বংস করবে’। আরেকজন পরিবেশবিদ ‘ওয়াটার ম্যান অব ইন্ডিয়া’ খ্যাত রাজেন্দ্র সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক। এ প্রকল্প একদিকে বন্যা, অন্যদিকে খরার কারণে বহু মানুষকে উদ্বাস্তু এবং তাদের অবর্ণনীয় ক্ষতি করবে। নদী কোনো রাস্তা নয়, তার একটা জীবনচক্র আছে। আন্তঃনদী সংযোগ ভারতের জলসম্পদকে ব্যক্তিমালিকানার পথে চালিত করবে’। পরিবেশবাদীদের মতে, এই প্রকল্প ভারতের নদীভিত্তিক প্রতিবেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। তাঁরা বলছেন, সরকার দেশের ভূগোলকে নতুনভাবে আঁকতে চাইছেন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বন্য প্রাণী এবং ভাটির দিকে থাকা কৃষকের কি হবে? নদীকে শুধু জলের উৎস হিসেবে দেখলে হবে না, দেখতে হবে পূর্ণাঙ্গ বাস্তুতন্ত্র হিসেবে। নদী সংযোগের জন্য যে অসংখ্য খাল খনন করতে হবে, তার জন্য প্রতিবেশকে অস্বীকার করতে হবে। এটা অর্থের অপচয়। উদ্বৃত্ত জল দেখিয়ে যে পরিমাণ জল সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সে হিসেবের মধ্যেও অতিরঞ্জন আছে।
নদীসংযোগ প্রকল্পের পেছনে বিজেপি সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল মেরা গেলডিন বলেছিলেন, ‘এই শতাব্দীতে যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে তেল নিয়ে তাহলে আগামী শতাব্দীতে তা হবে জল নিয়ে’। বর্তমান সময়ে কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, জলের অপর নাম জীবন। অথচ এই জলই দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ১৯৯৮ সালে ২৮টি দেশে জলের অভাব ছিল। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০-এর কাছাকাছি। ১৯৭০ সালের পর মাথাপিছু জল পাওয়ার পরিমাণ কমেছে ৩৩ শতাংশ।
সাধারণ জনগণের জন্য এটা দুঃসংবাদ সন্দেহ নেই। তবে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর জন্য এ এক দারুণ খবর। এর মধ্যে তারা বিরাট ব্যবসার সন্ধান পাচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সুপেয় জলের উৎসগুলোকে দখল বা নিয়ন্ত্রণ করার কাজ তারা শুরু করে দিয়েছে। এই জলবাণিজ্যে কী পরিমাণ লাভ হতে পারে বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে তা হিসেব করে ফেলেছে। তাদের হিসেবে প্রতিবছর এ অংকটা দাঁড়াবে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার অর্থাৎ ৮ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য তারা প্রথমেই দেশে দেশে সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ করার ব্যবস্থা করছে। তাদের আশা এভাবে বিশ্বব্যাপী একটা মুক্ত জলবাজার গড়ে তোলা যাবে।
নদীসংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও দেশী-বিদেশী কর্পোরেট হাউজগুলো এই প্রকল্পের সমস্ত স্তরেই অংশগ্রহণ করবে। তারা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, জল সরবরাহ, জল ব্যবহারকারীদের ফোরাম গড়ে তুলে তাদের কাছে জল বিক্রি ইত্যাদি সব কাজই করবে। নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই দেশের নদীগুলোকে কর্পোরেট হাউজগুলোর হাতে একে একে তুলে দেওয়া হচ্ছে। নদী সংযোগ প্রকল্পের এক একটি বা একাধিক খালকেও এইভাবে তুলে দেওয়া হবে কর্পোরেট টাইকুনদের হাতে।
সর্বোপরি, নদী সংযুক্তি পরিকল্পনার ভিত্তি হল এই যে, সমুদ্রে জলের নির্গমন আসলে অপচয়। এই ধারণা পরিত্যাগ করা জরুরী। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ধারণা, কারণ নদী থেকে জল সমুদ্রে প্রবাহিত না হতে দিলে সমগ্র জল এবং বৃষ্টির চক্রটির বিঘ্ন ঘটবে। কি পরিমাণ বর্ষা হবে তা সরাসরি নদীর জল কতটা সমুদ্রের মধ্যে প্রবাহিত হয় তার ওপর নির্ভর করে। নদীগুলোর সমুদ্রে পৌঁছানো আটকালে তা উপকূল সহ উপকূলবর্তী জমিগুলোতেও প্রভাব ফেলবে। যদি নদীর জল সমুদ্রের মধ্যে প্রবাহিত না হয়, তবে ভূগর্ভস্থ জলে নোনা জলের অনুপ্রবেশ ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট, লবনাক্ততার জন্য প্রতি বছর প্রায় ৫৫০ বর্গকিলোমিটার জমি হারাচ্ছে। সমুদ্র থেকে ভেতর দিকে ৬০ কিলোমিটার অবধি এই লবণাক্ততা বর্তমান। ভারতে প্রায় ৭৫০০ কিলোমিটার উপকূলরেখা রয়েছে। অনুমান করা হয় যে নদীর জল সমুদ্রের মধ্যে প্রবাহিত না হলে সামুদ্রিক জল ১০০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার অবধি জমিতে প্রবেশ করতে পারে। এর অর্থ ভারতের ভূখণ্ডের এক তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক জলে হারাবে। সেই অবস্থায় এসব এলাকায় কোনো কৃষিকাজ সম্ভব নয়। এমনটা ইতিমধ্যেই ঘটেছে যে, গুজরাট এবং তামিলনাড়ুতে। এসব এলাকার গ্রামগুলো পুরোপুরি খালি করতে হয়েছে কারণ যেখানেই নলকূপ বসাতে যাবে সেখানেই সামুদ্রিক জল রয়েছে। মাত্র ২৫ বছর আগে, এখানে পুরোটাই মিষ্টি জল ছিল।
এখন প্রশ্ন হল, নিজের দেশের জনগণ ও বিজ্ঞানীমহলকেও অন্ধকারে রেখে এই বিশাল প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য কি?