• facebook
  • twitter
Sunday, 13 April, 2025

সর্বত্র জলস্তর কমছে, জলসঙ্কট রোধে জলাশয়গুলো বাঁচাতে হবে

প্রশ্ন হল, খেলার মাঠ তৈরির এই কেরামতি কি শহরের অন্যত্র দেখানো যেত না? কেন জঙ্গলে মোড়া অংশটি উজাড় করার চেষ্টা, যেখানে সমগ্র শহরেই গাছের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে কম।

প্রতীকী চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব যত প্রকট হচ্ছে, দুনিয়াতে জলসঙ্কট তত ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও জলসঙ্কট ক্রমে তীব্রতর হছে। একটি সমীক্ষা বলছে, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ তীব্র থেকে অতি তীব্র জলসঙ্কটের সম্মুখীন। মানবোন্নয়নের নিরিখে এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি— জীবন ধারণের জন্য শ্বাসবায়ু ব্যতীত আর কিছুই জলের মতো এমন অপরিহার্য নয়। পরিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে যেমন বিবিধ অসুস্থতার প্রকোপ বাড়ছে, তেমনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। ফলে খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা প্রকটতর হচ্ছে। পাশাপাশি, জল সংগ্রহের কাজটি ক্রমে কঠিনতর এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠায় তাতে নষ্ট হচ্ছে মানব শ্রমঘণ্টা। প্রতিটি ঘটনাই উন্নয়নের পক্ষে নেতিবাচক। অন্য দিকে, এই সঙ্কটের একটি বৈষম্যমূলক দিকও রয়েছে। জল হয়ে উঠছে একটি বাজারজাত পণ্য— যাঁর আর্থিক সামর্থ্য আছে, তিনি জল কিনে নিচ্ছেন; যাঁদের সেই সামর্থ্য নেই, তাঁদের পক্ষে জল সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে। ঘটনা হল, এই বাজারেরও একটি সীমা আছে। জল যত দ্রুত ফুরোচ্ছে, তাতে টাকা থাকলেও তা কিনে নেওয়া বহু ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে উঠবে, সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে।

সম্প্রতি আর্থিক রেটিং সংস্থা মুডি’জ় জানাল যে, ভারতের ক্রেডিট রেটিংয়ে দেশের জলসঙ্কটের প্রভাব পড়বে। জলের অভাব ঘটলে যেমন কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে, তেমনই ধাক্কা খাবে শিল্পও। রেটিং সংস্থাটির আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি শেষ অবধি তুমুল সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, যা ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর হবে। এখনই ততখানি আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন থাকছে। কিন্তু, একই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, ভারতের অভিমুখ সেই বিপজ্জনক দিকেই।ভারতে জলসঙ্কটের সমাধানসূত্র খুঁজতে হলে কৃষিক্ষেত্রের দিকে তাকাতেই হবে, কারণ ৮০ শতাংশের বেশি মিষ্টি জলের ব্যবহার হয় সেচের কাজে। প্রথমত, জলনিবিড় শস্যের চাষ থেকে সরে আসতে হবে তুলনায় কম জলের চাষে। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের মাধ্যমে ফসল ক্রয়ের সিদ্ধান্তও এমনই হওয়া বিধেয়, যা এই নীতিকে সমর্থন করে। কৃষিক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সেচের ব্যবহার কমাতেই হবে।

বিবিধ সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাঁধে যথেষ্ট জল থাকলেও তা শেষ অবধি বহু খেতে পৌঁছয় না। বৃহৎ সেচ ব্যবস্থার এই শেষ মাইলের সংযোগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি অনুসরণ করতে হবে। দরকার গোষ্ঠীভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থারও। জল চিরকালই একটি গোষ্ঠীসম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত— তার অপব্যবহার রোধের দায়িত্বও গোষ্ঠীর হাতে ছাড়াই বিধেয়। অন্য দিকে, শিল্পক্ষেত্রে জলের ব্যবহারের বিষয়েও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। একাধিক শিল্পে বিপুল পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের প্রয়োজন পড়ে। সংস্থাগুলিকে বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে, অথবা তাদের থেকে চড়া হারে শুল্ক আদায় করতে হবে। অন্য দিকে, শিল্পক্ষেত্রের দূষণের ফলে জলের বহু উৎস কার্যত ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জলাশয় থেকে নদী, মিষ্টি জলের এই উৎসগুলিকে শিল্পদূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও নির্দিষ্ট নীতি চাই। কিন্তু বাস্তব হল, ভারতে ২০১২ সালের পর আর জল-নীতির সংস্কার হয়নি। ২০১৮-১৯ থেকে নতুন জাতীয় জল-নীতি প্রণয়নের যে চেষ্টা চলছে, তার দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

কলকাতায় যে বড় জলাশয়গুলো রয়েছে তাদের মধ্যে রবীন্দ্র সরোবর প্রধান। কিন্তু সেখানে জলস্তর ক্রমশ নামছে। রবীন্দ্র সরোবর যে শুধুমাত্র সৌন্দর্যায়নের বা বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারের জায়গা নয়, সেখানকার বাস্তুতন্ত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখাও যে অত্যন্ত জরুরি, তা বোধ হয় কলকাতা পুরসভার বোঝার সময় এসেছে। কলকাতাকে সুস্থ, সুন্দর রাখার দায়িত্বটি তারই, অথচ শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্র সরোবরকে ঘিরে এ-যাবৎ তার কার্যকলাপগুলি যথার্থ ‘রক্ষক’-এর নয়। বরং সরোবরকে রক্ষার প্রশ্নে পরিবেশপ্রেমীরা যখন সরব হয়েছেন, তখন পুরসভার হাবভাবে উদাসীনতা এবং অ-সচেতনতাই স্পষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি সরোবরের ভিতরে এক বিশাল জায়গা জুড়ে মাটি কাটার অভিযোগ উঠেছে সরকারি সংস্থা কেএমডিএ-র বিরুদ্ধে। পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে, সেখানে প্রচুর সাপ, নানা কীটপতঙ্গের বাস। এ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ওই সরীসৃপ, কীটপতঙ্গগুলি চিরকালের মতো স্থানটি থেকে মুছে যেতে পারে।

হঠাৎ মাটিতে কোপ কেন? জানা গিয়েছে, খেলার মাঠ তৈরির জন্য কেএমডিএ একটি বিশেষ সংস্থাকে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি দিয়েছে। সেই কারণে বেশ কিছু দিন যাবৎ মাটি কাটা চলছে। পরিবেশবিদদের আপত্তি সত্ত্বেও তা যে আগামী দিনে সহজে বন্ধ হবে না, অনুমান করাই যায়।ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং কংক্রিটায়নের চাপে ইতিমধ্যেই কলকাতার বৃহদংশ থেকে সবুজ অন্তর্হিতপ্রায়, অথচ বায়ুদূণের মাত্রা উদ্বেগজনক। এ-হেন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কলকাতার এই সুবিশাল জলাশয়টি নাগরিক স্বস্তিবিশেষ। জলাশয়, পাড়ের গাছপালা, দীর্ঘ হাঁটার রাস্তা, শরীরচর্চার ব্যবস্থা, শিশুদের পার্ক— সব মিলিয়ে প্রায় ১৯২ একর বিস্তীর্ণ এই অঞ্চল শুধুমাত্র সংলগ্ন অঞ্চলের নাগরিকদের পছন্দের জায়গাই নয়, বহু পাখি, কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থলও বটে। সুতরাং, সরোবরকে রক্ষা করাই এক যথার্থ পরিবেশপ্রেমী পুরপ্রশাসনের কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল। কলকাতার দুর্ভাগ্য, তেমনটা দেখা যায়নি।

বরং সৌন্দর্যায়নের ঠেলায় বার বারই এই স্থানের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতীতে অভিযোগ উঠেছিল, জলাশয়ের মধ্যে লাগানো বড় ও চড়া আলোয় পাখি ও কীটপতঙ্গদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত হওয়ার। ছটপুজোকে ঘিরে পরিবেশকর্মী এবং রাজ্য সরকারের টানাপড়েনের ইতিবৃত্তও এত দ্রুত ভুলে যাওয়ার নয়। পুজোর কারণে সরোবরের জলদূষণ এবং নাগাড়ে বাজি ফাটানোয় সংলগ্ন পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে শেষ পর্যন্ত জাতীয় আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সেই স্বস্তি থিতু না হতেই এ বার যন্ত্রের উপদ্রব শুরু।

প্রশ্ন হল, খেলার মাঠ তৈরির এই কেরামতি কি শহরের অন্যত্র দেখানো যেত না? কেন জঙ্গলে মোড়া অংশটি উজাড় করার চেষ্টা, যেখানে সমগ্র শহরেই গাছের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে কম। গত বছর গ্রীষ্মে রবীন্দ্র সরোবরের জলের স্তর বিপজ্জনক ভাবে কমে গিয়েছিল। আঙুল উঠেছিল চার পাশে গড়ে ওঠা বহুতলের দিকে। সেই অভিযোগ সত্যি কি না, জলস্তর নামতে থাকলে কী ব্যবস্থা করা উচিত, সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা কত দূর এগিয়েছে? জলাশয় রক্ষার কোনও প্রকার উদ্যোগ না করে কেন এই অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে নজর? বার বার আদালত নির্দেশ দেবে, তবে রবীন্দ্র সরোবর রক্ষা পাবে, এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্র সরোবরকে বাঁচিয়ে রাখার দায় সকলের— প্রশাসনের, নাগরিকেরও। সেই বোধোদয় এখনও না হলে কলকাতার সর্বনাশ।