হতে চেয়েছিলেন বিপ্লবের বিশ্বপথিক

চে গেভারা। বিশ্বের কাছে পরিচিত এই বিপ্লবী মানুষটির পুরো নাম এর্নেস্তো গেভারা দেলা সের্না। ১৯২৮-এর ১৪ জুন তিনি জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ক্লান্ত ফুসফুস নিয়ে জন্মেছিলেন গেভারা। বিপ্লবের দুরন্ত পথে আমৃত্যু এই ফুসফুস অক্লান্তভাবে তাঁকে দিয়ে গেছে পৃথিবীর বাতাস। অসুস্থ ছেলেটিকে সুস্থ রাখার জন্য বাবা-মা রোসারিও ছেড়ে চলে আসেন আলতা গার্সিয়া নামে ছোট পাহাড়ি শহরে। চে-র অসুস্থ শৈশবের অনেকটাই কেটেছে ঘরবন্দি অবস্থায়। গেভারার শৈশবের এই ঘরবন্দি জীবনের বাইরে পৃথিবী জুড়ে তখন শোষিত মানুষের ক্রান্তিকালের সময়। তাঁর পরিবারে ছিল এক প্রগতিশীল চিন্তার আবহ। শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত মানুষের প্রতি ছিল চের গভীর মমত্ব। তাঁদের ছোট ঘরের হাজারো বইয়ে ঠাসা র‍্যাক থেকে খুঁজে পড়তেন কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, লেনিন, জওহরলাল নেহরু, রবার্ট ফ্রস্টের বই। তখন থেকেই চে শুনেছেন শোষিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবের ধ্বনি প্রথম কবে উঠেছিল সে খবর চে নিশ্চয়ই জেনেছিলেন। বলশেভিক বিপ্লবের ডাক তাঁর জন্মের ১০ বছর আগে শোনা গিয়েছিল। কিশোর বয়স থেকে গেভারা দেখেছিলেন তাঁর উপনিবেশ লাঞ্ছিত মহাদেশকে। শুধু জন্মভূমি আর্জেন্টিনা নয়, সারা লাতিন আমেরিকা জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের কালো ছায়া। চিনের আকাশে তখন ফুটছে বিপ্লবের লাল তারা। চে তাঁর যৌবনের শুরুতে দেখেছিলেন বিপ্লবের আগুনে আলোকিত পৃথিবীকে।

চে নিজেকে প্রথমে সঁপে দিয়েছিলেন কিউবার বিপ্লবে। কিউবা বিপ্লবের রূপকার ফিদেল কাস্ত্রোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ‘সেকেন্ড ইন কমান্ডে’র ভূমিকায়। তার আগে বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদাকে নিয়ে গেভারা পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর বহু প্রতীক্ষিত মোটর সাইকেল যাত্রায়। এ এক মহাদেশীয় যাত্রা। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তিনি খুঁজেছিলেন লাতিন আমেরিকার শোষিত মানুষকে। দেখেছিলেন কারখানা, খনি শ্রমিকদের অবস্থা। পৌঁছেছিলেন দরিদ্র মানুষের কাজকো নগরী, পাবলো কলোনিতে। তাঁর মোটর সাইকেল ছুটেছিল বুয়োনোস আয়ার্স থেকে আটলান্টিকের উপকূল ধরে দুর্গম আন্দিজের গিরিপথ পেরিয়ে চিলির নিম্নবিত্তের শহরগুলিতে। মানুষের ভালোবাসা, আতিথেয়তা দুই বন্ধুর হৃদয়কে আপ্লুত করে তুলছিল। চিলি পেরিয়ে তাঁরা এলেন উত্তরে পেরু আর কলম্বিয়ায়, সেখান থেকে ভেনেজুয়েলার কারাকাসে। বন্ধু গ্রানাদো ছিলেন কুষ্ঠরোগের চিকিৎসক। তাঁকে নিয়ে চে আতাকামা মরুদেশের বহুগ্রামে নিজেদের নিবেদিত করেছিলেন কুষ্ঠরোগীর সেবায়। এই যাত্রায় গেভারা আবিষ্কার করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ছায়া আর হৃদয়ের কাছাকাছি পেয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত মানুষের সত্তাকে। বাইসাইকেলের গতির সঙ্গে যে মহাদেশকে তিনি দেখেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা তাঁর স্বপ্ন কল্পনাকে পাল্টে দিয়েছিল। চে-র উপলব্ধির মধ্যে নিপীড়িত মানুষের অবস্থা আরও গভীরভাবে দাগ কেটেছিল।

চে গেভারা মনে করতেন ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব। এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে চে গুয়াতেমালায় রাষ্ট্রপতি জাকোবা আরবেনজ্ গুজমানের নেতৃত্বাধীন সামাজিক আন্দোলনে জলিয়ে পড়েন। ১৯৫৪-তে সিআইএ-র ষড়যন্ত্রে গুজমান ক্ষমতাচ্যুত হলে চে আরও গভীরভাবে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। ১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে থাকাকালীন চে কিউবা বিপ্লবের রূপকার ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে পরিচিত হন। হাজার মাইল দূরে কিউবা বিপ্লবের সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। চে যখন কিউবায় পৌঁছান তখন সেখানে উত্তাল বিদ্রোহ চলছে। ৮২ জন গেরিলা নিয়ে গেভারা কিউবা যাত্রা করেন সমুদ্র পেরিয়ে। তাদের ওপর চলে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ। যাত্রাপথে ৬৭ জন সৈন্য প্রাণ হারান। চে যখন কিউবায় পৌঁছান তাঁর সৈন্য সংখ্যা তখন ১৫ জন। হাতে মাত্র ৯টি অস্ত্র।


১৯৫৫-র ২৬ জুলাই চে আন্দোলনের দলের সদস্যপদ পান। মার্কিন মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসি বাতিস্তাকে উৎখাতে সাহায্য করতে কিউবার নদী সংকুল দুর্গম প্রদেশে মরণপণ লড়াই চালান। দক্ষ নেতৃত্বে আক্রমণ চালিয়েছিলেন বাতিস্তার সামরিক ঘাঁটিতে। ততদিনে তিনি আরও আয়ত্ত করেন গেরিলা লড়াইয়ের সুদক্ষ কায়দা। চে তখন হয়ে উঠেছেন বিপ্লবের কমান্ডার।

সিআইএ-র খাতায় চে তখন হয়ে উঠেছেন ‘ভয়ঙ্কর কম্যুনিস্ট’। ৬০-এর দশকের শুরুতে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের ঝড় তুলবেন বলে আবার বেরিয়ে পড়েন। এসেছিলেন আমাদের উপমহাদেশেও।
১৯৬৫-তে একদল গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে তিনি যান কঙ্গোয়। সেখানকার রাজনৈতিক জটিলতায় চে-র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সফলতা পায়নি। তিনি আবারও ফিরে আসেন নিজের মহাদেশে।

এরপর বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকে বলিভিয়ার মাটিতে। ১৯৬৬-র নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চে নিয়ান কাহুরাসু এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিলেন। বলিভিয়ার সামরিক শক্তিকে উৎখাতের জন্য কিউবার বিপ্লবীরা যোগ দিতে আসেন। সাম্রাজ্যবাদীরা তখন ক্ষুধার্ত হায়নার মতো খুঁজে চলেছে তাঁকে। বলিভিয়ায় বারিয়েন্তাসের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সহযোদ্ধাদের নিয়ে চে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। লড়াই চলে চিকুইটানিয়ার জঙ্গলে।

আমাজনের গভীরে ছিল তাঁদের আস্তানা। ১২০ জন গেরিলা সদস্যের মধ্যে তাঁদের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২২ জনে। গুরুতর আহত চে গেভারা বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন রাজধানী লা পাজ থেকে ৭০০ মাইল দূরে লা হিগুয়েরা গ্রামে। আহত শরীরে একটা ছোট স্কুলবাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন গেভারা। ৯ অক্টোবর। সূর্য তখন মধ্যগগনে। পাহাড়ি গ্রামটার ছোট স্কুলবাড়িটাকে সন্তর্পণে ঘিরে ফেলে বলিভিয়ার ঘাতক সৈন্য। গেভারা যেন মৃত্যুকে জিতে নেওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন। সার্জেন্ট মারিও টোরেনের অগণিত ফায়ারিংয়ে বিদ্ধ হল গেভারার শরীর। লা হিগুয়ারার ছোট স্কুল বাড়িতে ঝাঁঝরা হল লাতিন আমেরিকার সূর্য সন্তান। ৩৯ বছর বয়সে থেমে গেল গেভারার ক্লান্ত ফুসফুস। মৃত্যুর নিষ্পলক চোখেও যেন লেগেছিল বিপ্লবের স্বপ্ন। যেন এখনও তিনি শুনতে পাচ্ছেন দূরের আখচাষিদের গান কিংবা খনি শ্রমিকের শ্রমসংগীত। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যের অন্ধকার নামলো। ভিগুয়ারা গ্রামের কেউ বিপ্লবীর মৃত্যুর খবর জানলো না। সূর্যাস্তের আগেই বিপ্লবের সূর্য-সন্তানকে ঘাতকরা সরিয়ে দিল লাখো মানুষের দৃষ্টি থেকে দূরে অনেক দূরে।

বিপ্লবের বিশ্ব পথিক হতে চেয়েছিলেন চে গেভারা। তৃতীয় বিশ্বের যেখানে শোষিতের ওপর নিপীড়ন দেখেছেন সেখানেই তুলতে চেয়েছেন বিপ্লবের ঝড়।

তাঁর বাইসাইকেল ডায়েরি কিংবা পঞ্চাশের দশকের প্রতিদিনকার ডায়েরির পাতা মহাদেশীয় বিপ্লবের স্বপ্ন জাগানো লেখায় ভরে উঠতো। যে মানুষটি হতে পারতেন বুয়োনস আয়ার্স মেডিক্যালে মেডিসিনের ডাক্তার, হতে পারতেন বড় সাঁতারু কিংবা টেসিন খেলোয়াড়। হতে পারতেন কবি-লেখক, সেই মানুষ হয়ে উঠলেন বিপ্লবের চলমান সৈনিক। এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে বিপ্লবের বার্তাবাহী। এ কথা ঠিক, তিনি শোষণমুক্তির পথ আপন উন্মাদনায় বিপ্লবের ক্ষেত্রে খুঁজেছেন। সমাজতন্ত্রের পথ অনুসন্ধান করেছেন। কিন্তু এই পথে সংগঠিত মানুষের যে শক্তি ও ক্ষমতার সংযুক্তির প্রয়োজন ছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠেনি। একটি রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির মূল শ্রেণিগত অবস্থান কোন জায়গায়, সে দেশের মাটিতে যথার্থ বিপ্লবী পথ কোনটা হবে, তার বাস্তব রূপায়ণ কিভাবে সম্ভব, তা স্থিরীকৃত হবার আগেই রাষ্ট্রীয় মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে চে চরম অঘাত হানতে চেয়েছেন। ফলে অগণিত শোষিত মানুষের সমর্থন পেয়েছেন, কিন্তু অগণিত শ্রমিক-কৃষক মানুষ তাঁর সংগ্রামে সামিল হতে পারেনি।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার আগে যে সামাজিক আন্দোলন, যে বিপ্লবী গণ আন্দোলনের জোয়ার আসে তা চে-র আগে অন্য দেশে বিপ্লবী প্রয়াস দেখা যায়নি। ফলে তার বহু মরণপণ লড়াই বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয়েছে, বহু গেরিলা যুদ্ধ রক্তস্নাত পরিণতিতেই শেষ হয়েছে। চে একসময় গেরিলা যুদ্ধকে মুক্তির একমাত্র উপায় ভেবেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি উপলব্ধি করেন। ‘দ্য বলিভিয়ান’ ডায়েরিতে তিনি বলছেন ‘যে দেশে শাসক দলের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কার্যকারিতা থাকে, সেখানে নাগরিক সংগ্রামের সম্ভাবনাকে আগে সৃষ্টি করতে হবে।’ শাসকের একাধিপত্যের মধ্যেও যদি সামাজিক সাংবিধানিক বৈধতা থাকে, সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলাই বিপ্লবের প্রাথমিক কাজ।

চে গেভারা মনে করতেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত দরিদ্র দেশগুলোতে বিপ্লবের সম্ভাবনা বেশি মাত্রায় রয়েছে। তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ছিল তাঁর বিপ্লবের প্রস্তুতি ক্ষেত্র। মানুষকে স্বাধীন করার সুতীব্র বাসনা তাঁকে মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সামনে ছিল রুশ বিপ্লবের প্রেরণা। ভ্রমণের নেশা তাঁকে একদিন ইনকা সভ্যতার কাছাকাছি এনেছিল। প্রাচীন নিদর্শনে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের ওপর সভ্যতার শোষণের চিহ্ন। কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামী কবি হোসে মার্তির আদর্শ চে-কে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর আদর্শেই তিনি পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রথম পাঠ। প্রায় সমবয়সী হলেও ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তাঁর অন্তরের নেতা। তাঁরই সমসাময়িক কালে এশিয়ার দিগন্তে দেখেছিলেন চীন বিপ্লবে মানুষের গণমুক্তির সংগ্রাম। মাও সে তুঙ তাঁর কাছে ছিলেন পৃথিবীর প্রিয়তম মানুষ। যৌবনে দেখা এই পৃথিবীই তাঁকে বিপ্লবের পথে টেনে এনেছিল।

চে-র জীবন ছিল যেন রূপকথার এ্যাডভেঞ্চারে ভরা। কিন্তু চে যে রূপকথার নায়ক সেই রূপকথা নির্দিষ্ট কোনও ভূগোলের কিংবা দেশের-ভাষার-জনপদের নয়। সেই রূপকথা পুরো বিশ্বের, সকল ভাষার, সকল দেশের। সেই রূপকথায় রয়েছে মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ইশতেহার। চে গেভারার জীবন শুধু মহৎ দুঃসাহসের কাহিনি নয়। তাঁর ডায়েরির পাতা, প্রতিদিনের রোজনামচা, টাইপ রাইটারের প্রিন্ট কপি সব কিছু ছিল বিপ্লবের উন্মাদনায় ভরা। চে বলিভিয়ার লড়াইয়ের ডায়েরি লিখেছেন, যেন সহযোদ্ধা শহিদদের প্রতিদিনকার রক্তের ফোঁটা দিয়ে। তাঁর বিপ্লবের ক্যারাভান দেশ থেকে দেশান্তরে এগিয়ে ছিল স্বপ্নময় রোমান্টিকতায়। এই স্বপ্নের পতাকা মহাদেশের প্রান্তে প্রান্তে উড্ডীন রেখেছিলেন। ফিগুয়ারার স্কুলবাড়িতে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার আগে চে গেভারা হত্যাকারীদের উদ্দেশে তাই বলেছিলেন, ‘জানি তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছ। কাপুরুষ, গুলি চালাও। তোমাদের গুলিতে মরবে শুধু মানুষটি। তবুও তার পতাকা আকাশে উড়বে চিরকাল।’