ভােট হােক অবাধ

প্রতীকী ছবি (Getty Images)

বাংলায় এখনও ২৪ আসনে নির্বাচন বাকি। সুতরাং এই আসনগুলির ভােট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করে দেখাক নির্বাচন কমিশন। তা যদি পারে, তবুও তাে বলা যাবে, বাংলার সিংহভাগ আসনেই ভােট ঘটনাবিহীন হয়েছে। আর হিংসাহীন ভােট হলে কমিশনের সেই যে এ রাজ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ করার চ্যালেঞ্জ, তা কিছুটা রক্ষিত হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ দফা পর্যন্ত যা করতে ব্যর্থ কমিশন।

এ পর্যন্ত ভােটে এত যে অন্যায়, অবিচার, জােরজুলুম, কারচুপি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত, তাতে কি কমিশনের সুনাম সুষশ বাড়ল? ক’টা অন্যায় কাজের প্রতিকার করতে পারল কমিশন? অন্যায় দেখে মুখ বুজে থাকাও তাে একটা বড় অন্যায়।

প্রত্যেক দফার ভােট শেষে কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক দিল্লিতে ছুটে যাচ্ছেন, বাংলার ভােট নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করার জন্য। বিমান বন্দরে সাংবাদিকরা যখন তাঁকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করছেন, ভােট কেমন হল? তাঁর সহাস্য মন্তব্য, ‘ভােট শান্তিপুর্ণ’। এ যে কোন শান্তি ঘটনার পরম্পরায় তাকে মেলানাে যাচ্ছে না। দুবরাজপুরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামবাসীরা, তাদের বেশির ভাগ মহিলা, যখন কোনও দলের কর্মীদের বাধাদানের ফলে ভােট দিতে পারলেন না, তখন লাঠি, ঝাঁটা, বাঁকা হাতে তার প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন। প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে একটি বাড়িতে চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালালেন। বাড়ির গৃহকত্রী হাত জোর করে মেয়েকে সামনে নিয়ে, মিনতি জানাচ্ছেন তাকে মারবেন না। সেই আকুল আবেদন, সেই অসহায়তার কথা, সেই প্রতিবাদী মহিলাদের কথা একটুও মনে পড়ল না বিশেষ পর্যবেক্ষকের? তার কাছে এই ঘটনাও কি শান্তির নমুনা? কেতুগ্রামের একটি বুথ ছাপ্পা ভােট হচ্ছে– ক্যামেরায় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামনে একজন সিআরপিএফ ওয়ান তা দেখছেন, কিন্তু বাধা দিচ্ছেন না— এটাও ‘অতি সামান্য ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হল। যদিও এই বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। যা প্রশংসাযােগ্য।


বেশি সংখ্যক কেন্দ্রীয় ফোর্স আনার ফলে ভােটারদের মনে নিরাপত্তা যে বেড়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাদের তাে ঠিক ঠিক মতাে পরিচালনা করতে হবে। আর এই পরিচালনার ভার যদি রাজ্য পুলিশের কর্তাদের হাতেই পুরােটা থাকে, তাহলে সে ব্যবস্থা ত্রুটিহীন হবে না, তা খােলাখুলিই বলা যায়। এবং তার যথেষ্ট প্রমাণও মিলছে বিরােধীদের কথায়। দু’টি বুথের ভিতর কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের গুলিও চালাতে হয়েছে– যদিও কেউ হতাহত হয়নি। বুথের ভিতর ওলি চালানাে– একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা! যা শুনে মুখ্যমন্ত্রীও অবাক। অবাধ ভােট হচ্ছে না বলেই তাে তাদের এই অ্যাকশন? তবুও পর্যবেক্ষক এবং রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের কথায়, শান্তিপূর্ণ ভােট। অবশ্য তাতে যােগ হয় ‘কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’ বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বা কেন হবে? তা যাতে না হয়, তার জন্যই তাে এত কেন্দ্রীয় ফৌজ, এত বিধি ব্যবস্থা।

এই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র দোহাই দিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি বাংলার ভােট নিয়ে শান্তি পেতে চায়, পাক। কিন্তু রাজ্যের মানুষ চান কোনও অশান্তির ঘটনাহীন ভোট। সবাই যেন অবাধে তাঁদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারেন। বাধাহীনভাবে, মুক্ত মনে অন্য রাজ্যে যদি তা হতে পারে, এ রাজ্যে তা হবে না কেন? কেন্দ্রীয় কাের্সের সাহায্যে ভােট করানাের রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে খরচ হচ্ছে কয়েকশ কোটি টাকা। তবুও যদি ভােট নির্বিঘ্নে হয়, শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে হয়।

অবশ্য শান্তিপূর্ণ ভােটের পরিপন্থী অন্য কারণও আছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস চাইছে ৪২ আসনের মধ্যে ৪২টাতেই জিততে। আর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) চাইছে সে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতে, যাতে কোনও ভাবেই শাসক দলের আশা পূরণ না হয়। আর শাসক দলের প্রার্থীরা, কর্মীরা, নেতারা মায় মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত এই ৪২-এ ৪২ যাতে ঘরে আসে, তার জন্য দুর্বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেনতেন প্রকারে, আর এই দুর্বার চেষ্টার ফলে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। প্রবল বাধা আসছে বিরােধী দলগুলির সমর্থকদের কাছ থেকেও– যা শান্তিপূর্ণ ভােটের পথে বাধা।

দাবি উঠেছে সব রাজনৈতিক দলগুলির এই মনােভাব পাল্টাতে হবে। অবাধ ভােটে হার জিত হলে তা মেনে নিতে হবে। কিন্তু সব আসনই আমাদের চাই, যে কোনও মূল্যে দলের এই অবস্থানের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। আর তা না হলে, ফৌজি এনে ভরে ফেললেও শান্তিপুণ, স্বাভাবিক ভােট হবে না। কমিশনের সাত দফায় নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। প্রথম দফায় যে ভুলভ্রান্তিগুলি হবে, পরের দফায় তা সংশােধন করে নেওয়া। কিন্তু তা করতে গিয়েও তাে ‘বিছিন্ন ঘটনা’ ঘটছেই। অবাধ ভােট হওয়ার বাকি যদি কোনও উপায় থাকে, তা খুঁজে বের করতে হবে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে।