• facebook
  • twitter
Friday, 18 October, 2024

বিদ্যাসাগর এখন গলার কাঁটা

এক আগুনের অনির্বাণ শিখা জনগণের মনে সুপ্তভাবে জেগে আছে। তাকে ভয় করে চলেছে রাজ্য সরকার। আর বর্তমান অনশন অবস্থান সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারকে পুজোর আগে এক চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল বিদ্যাসাগরের ২০৪তম জন্মবার্ষিকী। সেই দিন বিদ্যাসাগরের বাসভবনে প্রতিবারের মতো এবার জন্মবার্ষিকী পালনের কোনও সরকারি অনুষ্ঠান হয়নি। জন্মদিন উদযাপনের দিন মূর্তিতে মাল্যদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং কয়েকজন আধিকারিক। কারণ, আরজি কর কাণ্ডের প্রভাব। অন্যদিকে এইদিন কলকাতা শহরে অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে বিদ্যাসাগর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে। সেই রকম এক অনুষ্ঠানের উদযাপন কমিটির তরফ থেকে মুখপাত্র অনুষ্ঠানের শুরুতে জানালেন, ‘আমাদের মধ্যেও দ্বিধা ছিল এই আবহে এই অনুষ্ঠান করা যথোচিত হবে কি না। কিন্তু, আলোচনা চলাকালীন আমরা বুঝতে পারলাম যে, বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন (অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল রামমোহন স্মরণ) দুই মনীষীই নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি বিষয়ে সংগ্রাম করেছেন। বিশেষ করে বিদ্যাসাগরের জীবনের বেশির ভাগই ছিল এই সংগ্রামে নিবেদিত। তখন আমরা নির্দ্বিধায় এই অনুষ্ঠান পালনে ব্রতী হয়েছি।’ এই যুক্তি তাহলে রাজ্য সরকার দেখাতে পারছে না। কারণ কী? কারণ রাজ্য সরকার ভয় পাচ্ছে।

৯ আগস্টের ঘটনার পরে রিমঝিম সিংহ সামাজিক মাধ্যমে ডাক দিলেন ‘রাজ দখলের আন্দোলন’ আগস্টের ১৪ তারিখ। সেই শুরু। তারপর থেকে কলকাতা সহরাজ্যের, দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তায় নেমে এসেছেন আর স্লোগান দিয়েছেন ‘বিচার চাই’ বা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তাররা। এমন সার্থক আন্দোলন স্বাধীনতার পরে বাংলার মানুষ দেখেনি বলে অনেক বর্ষীয়ান মানুষ স্বীকার করেছেন। কোনও রাজনৈতিক দল এর মুনাফা তুলতে ভয় পেয়েছেন। কারণ প্রত্যেক দলই আয়নার নিজেদের ছবি দেখেন গোপনে, কিন্তু, প্রকাশ্য জনসভায় বা পথেঘাটে তাঁদের অন্য ভাবমূর্তি জাহির করেন। সেই ভাবমূর্তি যে আরজি কর কাণ্ডে বুমেরাং হবে, সেই বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। এমনকি আরএসএস-এর নেতা মোহন ভাগবত এই আন্দোলনচলাকালীন কলকাতায় এসেছিলেন এবং দলীয় কর্মীদের এই মুহূর্তে আরজি কর আন্দোলনে জড়াতে নিষেধ করেছিলেন।

আরজি কর আন্দোলনে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি কর্মসূচি কিছুদিন আগে স্থগিত করা হয়েছিল। তার কারণ ৩৫ দিন আন্দোলনের পরে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে প্রায় একক আলোচনা চালিয়ে একটি বাদে বাকি মূল দাবিগুলি মেনে নিতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন। অরাজনৈতিক স্তরে এরকম ঘটনা স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে আগে ঘটেনি বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ, এই আন্দোলন জাগিয়ে দিয়েছে মানুষকে, মানুষের ভয় কাটিয়ে দিয়েছে। রাতের পর রাত জেগে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে, লীন-দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে শহরের রাজপথ থেকে গলি, গলি থেকে আবাসনে। সেই লীন-অগ্নি মানুষের হৃদয়ে ধিকিধিকি জ্বলছে, এখন কিছুটা স্তিমিত।

মানুষ বুঝে গেছে যে অপরাধের অনেক চিহ্ন বা নথি লোপাট হয়ে গেছে বা বদলে দেওয়া হয়েছে। তাই সত্যিকালের অপরাধীকে না ধরা গেলেও যারা অপরাধে যোগসাজসের জন্য বা তথ্যপ্রমাণ লোপাট বা বিকৃত করার জন্য অভিযুক্ত হবেন তাঁরা যেন চরম শাস্তি পান। সেই জন্য মানুষ তাকিয়ে আছে শীর্ষ আদালত সহ বিভিন্ন আদালতের শুনানির দিকে। আর জুনিয়র ডাক্তাররা লক্ষ্য রেখে যাচ্ছেন তাঁদের বকেয়া দাবিগুলি সরকার রূপায়িত করছে কি না। এর মধ্যেই কনভেনশনের আয়োজন হয়েছে। তাতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই খানেই জুনিয়র ডাক্তাররা বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁরা কতটা স্বচ্ছ। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, আচারে আচরণে জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের স্ব্চছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন। তাই তাঁরা প্রতিনিয়ত পেয়েছেন মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা এবং সমর্থন।

সবাই জানেন রাজনৈতিক দলগুলি, সাধারণ মানুষ বাদ দিলে নিজেদের দলের কর্মীদের কাছ থেকে কীভাবে আনুগত্য আদায় করেন। হৃদয়ের যোগ সেখানে থাকে না। নেতারা যেমন দলের পাশাপাশি নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, ঘনিষ্ঠ কর্মীরাও সেরকম মনোভাবই পোষণ করেন। হৃদয়ের আকর্ষণের অভাব বামপন্থী দলের পতনের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়েছে আর এখন তা তো এক চরম সীমায় পৌঁছেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ করেছে রাজ্যের মানুষ। শিক্ষাক্ষেত্র সহ সাধারণভাবে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়েও শাসক দল নির্বাচনে কীভাবে লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করলেন, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মাথা ঘামাবেন। কিন্তু, স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও যে শিক্ষার থেকেও মারাত্মক দুর্নীতি চলছে তার নগ্নরূপ দেখে রাজ্যবাসী স্তব্ধ। যে ক্ষোভ মনের গভীরে জমে আসছিল তাতে চরম ইন্ধন জোগালো আরজি কর হাসপাতালে অভয়ার নির্মম নির্যাতন এবং মৃত্যু।

বকেয়া ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার দিকে রাজ্য সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ না চোখে পড়ায় জুনিয়র ডাক্তাররা আবার পূর্ণ কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু, সিনিয়র ডাক্তারদের পরামর্শে এবং সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে এবং সাধারণ মানুষের সমর্থনে যাতে ভাঁটা পড়ে সেই কারণে গত ৪ অক্টোবর তাঁরা ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন বকেয়া দাবি মেনে নেওয়ার জন্য। রাজ্য সরকার তো মানেনইনি, মুখ্যমন্ত্রীকে এক দুর্গাপুজোর মণ্ডপে ঢাক বাজাতে দেখেছে রাজ্যের আমজনতা। অবস্থার পরিণতিস্বরূপ জুনিয়র ডাক্তাররা ৫ অক্টোবর রাত ৮.৩০ থেকে এসপ্ল্যানেডে ডোরিনা ক্রসিংয়ে লাগাতার অনশন ধর্মঘটে বসেছেন।

এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। গান্ধিজির সেই সত্যাগ্রহ আান্দোলনের সঙ্গে একমাত্র এর তুলনা চলে। অনশন মঞ্চে সিসিটিভি ক্যামরা বসানো হয়েছে যাতে রাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারেন অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের। গান্ধিজি তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অহিংস বলেননি। তিনি এই আন্দোলনকারীদের বলতেন যদি এই আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করার মতো মানসিকতা থাকে তবেই যেও। আমাকে যেন দেখতে না হয় প্রতিপক্ষের দমনপীড়নের ভয়ে সশরীরে ফিরেএসেছো। ঠিক এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই এগোচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজোর চিরাচরিত রূপ কি দেখাতে চাইবেন বিভিন্ন পূজা কর্তৃপক্ষ? আর মানুষই কি মোবাইলে অনশনের ছবি দেখতে দেখতে আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন? কী ভাবছেন বিভিন্ন পুরস্কারদাতা সংস্থাগুলি। একটা দঁড়িপাল্লার একদিনে ডাক্তারদের অনশন আর অন্যদিকে পুজোকে জড়িয়ে এইসব কিছু।

রাজ্য সরকার হয়তো আশা করেছিলেন যে জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতির পথে গিয়ে রাজ্য সরকারের সুবিধা করে দেবেন জুনিয়র ডাক্তারদের জনগণের আদালতে দাঁড় করাবার প্রয়াসে। কিন্তু, সেই ফাঁদে পা দিলেন না জুনিয়র ডাক্তাররা।

অন্যদিকে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা এখনও পর্যন্ত কোনও অকাট্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার কথা আদালতে জানাতে পারেননি। নিত্যনতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে আসছেন। ভাবতে খারাপ লাগে সুপ্রিম কোর্ট ময়না তদন্তের গাফিলতির কথা বলার পরে টালা থানার প্রাক্তন ওসিকে গ্রেপ্তার করে জেরা শুরু করেছে। অপরাধ ঘটার পর প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হতে চলল। নিয়মমাফিক ৯০ দিনের মধ্যে কি চার্জশিট দাখিল করতে পারবে সিবিআই? সেই দিকে তাকিয়ে আছেন অধীর উদ্বেগে মৃতার পরিবার।

এক আগুনের অনির্বাণ শিখা জনগণের মনে সুপ্তভাবে জেগে আছে। তাকে ভয় করে চলেছে রাজ্য সরকার। আর বর্তমান অনশন অবস্থান সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারকে পুজোর আগে এক চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল।
এ রাজ্যের মানুষ দেখে অভ্যস্ত শাসক দলের একটি মুখ এবং তিনি মুখ্যমন্ত্রী নিজে। বিদ্যাসাগরের জন্মবার্ষিকীর মতো অনুষ্ঠানে তিনি কী অবতারে আবির্ভাব হবেন তার কৌশল ভেবে উঠতে পারেননি তিনি। তাই অনুষ্ঠানই বাতিল করে দিতে হলো। মানুষকে মাতিয়ে রাখার চিরপ্রচলিত কৌশল সেখানে খাটানো গেল না। তাই তিনি আগ্রহ দেখালেন না। বর্তমানে চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে এড়িয়ে যান বা মোকাবিলা করেন তাই দেখার।