সংবাদমাধ্যমের একাংশের একপেশে প্রচার সত্ত্বেও এবারের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিফলিত হল ‘গণতন্ত্রের জয়’৷ প্রায় দেড় মাস ধরে চলা ভারতের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক উৎসব শেষ হয়েছে৷ তার ফলও প্রকাশ্যে এসেছে৷ সেই ফল থেকে এটা প্রমাণিত, এক শ্রেণির পদলেহী সংবাদমাধ্যমের একপেশে, নিরন্তর চাটুকারিতা সত্ত্বেও আশানুরূপ সাফল্য পায়নি বিজেপি তথা এনডিএ জোট৷ ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে দেশের মানুষ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘গণতন্ত্র’ কী চায়৷ জনতা নিশ্চিত করেছে, গণতন্ত্র এক ‘বহুত্ববাদী’ ধারণা এবং সে-ধারণা একক আধিপত্য-বিরোধী৷ তাই গত দশ বছর ধরে একক গরিষ্ঠতার পরে বিজেপিকে থামতে হয়েছে৷ বলা বাহুল্য, তৃতীয়বারের জন্য বিজেপিই সরকার গড়বে, তবে জোট বেঁধে, আর বন্ধনসূত্র অনেকটা নির্ভর করবে শরিক দলগুলির উপর৷ জোট-শরিকদের উপেক্ষা করে একচ্ছত্র শাসন আর চালানো সম্ভব নয়৷ পারবে না সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংখ্যার জোরে একের পর এক জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করতে৷ তাই এবারের নির্বাচনকে অবশ্যই ‘গণতন্ত্রের জয়’ বলা যেতেই পারে৷
গণতন্ত্রে শাসকের সমালোচনা করাটাই রীতি৷ জনগণ আধিপত্যবাদীদের না হারালেও, একেবারে ঠিক বার্তা বিজেপির কাছে পৌঁছে দিয়েছে৷ মানুষ মতাদর্শহীন রাজনীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে৷ জনমুখী প্রকল্পের অবদান ফিরিয়ে দিয়েছে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে৷ এবং শাসনযন্ত্রে বিরোধীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে৷ বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূল শর্ত, একাধিক দলের উপস্থিতি৷ প্রায় সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা বিজেপিকে জোট-রাজনীতিতে যেতে বাধ্য করেছে এই ভোটফল৷ বলা হচ্ছে, দেশের মানুষ সহ্যের শেষ সীমায় পৗঁছে গিয়েছিল৷ তারই বহিঃপ্রকাশ জনতার রায়৷ একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা৷ গত কয়েক বছরে সরকারের নীতির বিরোধিতা করলেই গায়ে ‘ছাপ’ মেরে দেওয়া হচ্ছিল— ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ থেকে শুরু করে ‘আরবান নকশাল’ ইত্যাদি৷ ‘দেশদ্রোহী’ বলে জেলে পরে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে বিস্তর৷ তা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমে এবং সাংবাদিক-বৃত্তের একাংশ নীতি ও আদর্শ থেকে সরে আসেনি৷ সরকারের দমন-নীতি, কণ্ঠরোধ, সামাজিক মাধ্যমে সরকার-ভক্তদের নিয়ত শাসানি-হুমকি উপেক্ষা করেই অকুতোভয়ে কাজ করে গেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপ, নীতিপঙ্গুত্ব ও ব্যর্থতার সমালোচনা করেছে উচ্চাকিত কণ্ঠে৷
অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের একাংশের আচরণ ছিল ‘অন্ধভক্ত’-র মতো৷ সরকারের কোনও খারাপ কিছু তাদের নজরে পড়ত না৷ আবার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলছিল, হাওয়া বুঝে রং বদলাচ্ছিল৷ কারণ, তারা হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধামাধারী, মদতপুষ্ট অথবা রাজনৈতিক সহযোগী শিল্পপতির অর্থে পুষ্ট বা তাদের মালিকানাধীন৷ এই প্রেক্ষিতে বৈদু্যতিন সংবাদমাধ্যমের তুলনায় অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছে সংবাদপত্র গোষ্ঠীকে৷ অবশেষে ফল স্পষ্ট৷ প্রচারের ঢক্কানিনাদ থেকে শুরু করে এক্সিট পোলে চমকপ্রদ ভবিষ্যৎবাণী— সবেতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারি আনুকূল্যপুষ্ট সংবাদমাধ্যম৷ এটাই তো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সাফল্য৷ সর্বান্তকরণে ও সর্বাত্মকভাবে বিকিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধেই এই ভোটের ফল৷ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)— যাদের সংগঠন, অর্থবল, নেপথ্যের সংঘ পরিবারের সামাজিক ইঞ্জিয়িারিং সফল করার সক্ষমতা কিংবদন্তি-প্রতিম, তাও হিন্দি বলয়ে তাদের এই শোচনীয় পরাজয় আরেকবার এটাই বুঝিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সুযোগ-সবিধা বঞ্চিত, পিছিয়ে-পড়া মানুষের থেকে চোখ সরিয়ে নিলে যে কোনও ক্ষমতাদম্ভী শাসকেরই এই পরিণতি হতে বাধ্য৷
মানুষই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস ও নিয়ন্ত্রক৷ মদগর্বী শাসক যখন এই সরল সত্য ভুলতে শুরু করে, মানুষই তাদের শাস্তি দেয়৷ অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পাওয়া এটাই প্রমাণ করে৷