পুলক মিত্র
দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে হিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় কুমার ভাল্লাকে মণিপুরের নতুন রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা বারবার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়েছে। কেন অশান্ত এই রাজ্যে একবারও যেতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সেই প্রশ্নে বারবার আলোড়িত হয়েছে দেশ। কখন প্রধানমন্ত্রী এই রাজ্য সফরে যাবেন, কিংবা আদৌ যাবেন কি না, এসব প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি আরও দুটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেগুলি হল, কেন মণিপুর সফর এড়িয়ে যাচ্ছেন মোদি? হিংসা দমনে ব্যর্থ ওই রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংকে কবে অপসারিত করা হবে?
বীরেনের ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর দয়ার ওপর। মোদি চাইলে যে কোনও সময়ে তাঁকে সরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে পথে হাঁটার তাগিদ অনুভব করেননি তিনি। আগামী দিনে বীরেন কতটা পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে রাজ্যভার সামলাতে পারবেন, সে প্রশ্নও উঠে আসছে।
৩ মে, ২০২৩ তারিখে দুই কুকি তরুণীকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটানোর পর তদানীন্তন রাজ্যপাল অনুসুইয়া উইকেকে এক মাসের মধ্যেই মণিপুরের ইউফায়েড কম্যান্ড-এর সভাপতিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩-এর ১৭ জুন দিল্লিতে উচ্চ-পর্যায়ের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকে তাঁকে ডাকা হয়নি। এখন বারবার উঠছে সেই একই প্রশ্ন। কেন প্রধানমন্ত্রী মণিপুর সফরে যাচ্ছেন না? বীরেন সিংকে পুতুল মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে রেখে মোদীর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবে কি? মোদির মণিপুরে না যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে যতই সমালোচনার ঝড় ওঠুক, এখনও পর্যন্ত মৌনব্রতই পালন করে চলেছেন তিনি। এটা ঠিক, মোদির নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে। তাঁর মনের ভাষা বোধগম্য করা বেশ কঠিন। তিনি কী ভাবছেন, কী করতে চলেছেন, তা শুধু বিরোধী শিবির কেন, তাঁর দলের নেতাদের পক্ষেও তা বোঝা কঠিন হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে একটাই পথ। নিজস্ব বুদ্ধি, অনুমানের ওপর ভরসা করা।
স্মৃতির সরণি ধরে একটু পিছনে ফেরা যাক। ২০২৩-এর ২৭ মার্চ। সেদিন মণিপুর হাইকোর্ট এক রায়ে ঘোষণা করে যে, নাগা এবং কুকিদের মতো মেইতেই সম্প্রদায়কেও তপশিলি উপজাতির মর্যাদা দিতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর হতেই উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য অশান্ত হয়ে ওঠে। কুকিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পাল্টা প্রতিরোধে নামে মেইতেই সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ। ৩ মে কুকি মহিলাদের নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এর মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হল যে, মণিপুরে মেইতেই সম্প্রদায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ, কুকিরা তাদের অধীনে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছাড়া কিছুই নয়।
শুরু হয়ে যায় মেইতেই-কুকি গৃহযুদ্ধ, যার জেরে প্রায় ২৫০ জন নিহত এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হন। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এত হিংস্র হয়ে ওঠে যে, তাদের ভয় পেতে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীও। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২০০ জন জঙ্গি তাদের এক সদস্যের মুক্তির দাবিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাসভবনে চড়াও হয়ে তাণ্ডব চালায়। পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে মায়ানমার-যোগও রয়েছে। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অনেক ফাঁক রয়েছে এবং জাতিগত সম্পর্কের জেরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে সীমান্ত পারাপার করে থাকে। সেই সঙ্গে রয়েছে মাদক পাচারের সমস্যা। আসলে মণিপুর সমস্যা অত্যন্ত জটিল। সেপ্টেম্বর ২০২২-এ মায়ানমারের ৪,৩০০ নাগরিককে সীমান্ত থেকে ফেরত পাঠানো হয়। প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে, প্রায় ৪০ হাজার নাগরিক মিজোরামে ঢুকে পড়ে।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক বিভেদ মণিপুরের সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। এছাড়া, জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে মণিপুরের এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে মণিপুর জুড়ে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার জন্য কংগ্রেস-বিজেপি, দুই দলকেই দায়ী করা যায়। বিজেপি ‘ভুয়ো এনকাউন্টার’-এর অভিযোগ তুলে কংগ্রেস জমানাকে কাঠগড়ায় তুলে থাকে। অন্যদিকে, বিজেপি ব্যাপক হারে ‘আটকে’র পথে হাঁটছে। একে অন্যকে দোষারোপ করার এই পালা চলছে, মোদি যেভাবে হামেশাই জহরলাল নেহরুকে নিশানা করে থাকেন। কিন্তু রাজনীতির আঙিনায় তা মোটেই সুস্থতার লক্ষণ নয়।
গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে ওই রাজ্যে মোদির প্রচারে না যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কংগ্রেস। অন্যদিকে, ২ বার মণিপুরে গিয়েছেন রাহুল গান্ধী। নির্বাচনে মণিপুরের দুটি আসনেই জয়ী হয় কংগ্রেস। দলের নব নির্বাচিত সাংসদ আনগোমচা বিমল আকোইজাম সংসদে বলেছিলেন, “মোদি মুখ খুললে, আমি চুপ হয়ে যাব।”
মোদি কেন মণিপুর প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন? এর পিছনে বেশ কিছু কারণ দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বর্তমানে মণিপুরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। স্বাভাবিক নিয়মে সেখানে ২০২৭-এর গোড়ার দিকে ভোট হওয়ার কথা। বলতে গেলে, ২ বছর দীর্ঘ সময়। মোদির রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, এত আগে থেকে তিনি ভোটের জন্য গা গরম করার পক্ষপাতী নন। তিনি যথাসময়ে ময়দানে নামবেন, এমনটাই ধারণা রাজনীতির কারবারীদের।
৫৪৩ আসনের লোকসভায় মণিপুর থেকে দু’জন সাংসদ নির্বাচিত হতে পারেন। যদি এই দুটি আসন বিরোধীদের দখলেও যায়, তাতে লোকসভায় তাঁর দলের শক্তির খুব হেরফের ঘটবে না। গত নির্বাচনে তাই ঘটেছে।
মণিপুরে ক্ষমতার লাগাম রয়েছে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের হাতেই। নাগা এবং কুকি সম্প্রদায়ের হার বেশ কম। এখানে মেইতেই সম্প্রদায় জনসংখ্যার হার ৫৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০ শতাংশ কুকি এবং ২০ শতাংশ নাগা সম্প্রদায় রয়েছে। এছাড়া, স্বাধীনতার সময় থেকেই গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ অত্যন্ত সক্রিয়। তবে চমকপ্রদ তথ্য হল, রাজ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার পর মণিপুরের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মহম্মদ আলিমুদ্দিন নামে একজন মুসলিম।
এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে অবৈধ মাদকের ভূমিকা রয়েছে। সীমান্ত সংক্রান্ত অবস্থানের কারণে মায়ানমার এবং থাইল্যান্ড থেকে এখানে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করা হয়। দলীয় তহবিলে অর্থের জোগান বাড়াতে মাদক পাচারের সুবিধা নিয়ে থাকে ক্ষমতাসীন দল। বর্তমানে সেখানে ক্ষমতার রয়েছে বিজেপি। এছাড়া এই এলাকায় উত্তেজনা বজায় থাকার অর্থ হল, দেশের বাকি অংশে ভারত ও মায়ানমার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার দাবি ওঠা। আন্তর্জাতিক মাদক পাচার ও অনুপ্রবেশের মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের কাছে এটিই হল সবচেয়ে সহজ পথ। কুকিদের স্ব-শাসনের অনুমোদন না দেওয়ার পিছনে রয়েছে কর্পোরেট জগতের খেলা। মণিপুর অরণ্য-সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য। কুকিদের জীবনজীবিকার সঙ্গে এই বনাঞ্চল বিশেষভাবে জড়িত। তাই কর্পোরেট জগতের নজর রয়েছে কুকিদের দিকে। আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের বেশ কয়েকজন বড় শিল্পপতির ঘনিষ্ঠতা আমাদের অজানা নয়।
তবে মণিপুরের ভৌগোলিক অবস্থান ও ওই অঞ্চলের সুরক্ষার স্বার্থে মোদি সরকারের অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ২০২৩-২৪-এর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, গোটা উত্তর-পূর্বে হিংসার ঘটনার ৭৭ শতাংশই ঘটেছে মণিপুরে। ২০২৪-এর ৩ জুলাই রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে কংগ্রেসের দিকেই আঙুল নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু শুধু দোষারোপ করেই কি সমস্যার সমাধান হবে? দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কি তৎপর হওয়া উচিত নয়?