যে কোনও জিনিসের ব্যবহারিক প্রয়োগের উপরেই তার অস্তিত্বের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের ভোটসর্বস্ব অধিকার নির্বাচনকে উৎসবে পরিণত করলেও বাস্তবায়নের অভাববোধে তার পাঠটিই আজ বিপন্নপ্রায়। আরজি করের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী নাছোড় অস্তিত্বই সেই পাঠটিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা আমরা আকছার বলে থাকি। অথচ তার আসল সৌরভ যে তার দাসত্বে নয়,রাজত্বে, তা বুঝেও আমরা না-বোঝার অভ্যাস গড়ে তুলেছি। সৎসাহসের অভাব হলে অন্যায় দেখেও প্রতিবাদ নীরব হয়ে পড়ে। কেননা অসহায়ে সহ্য করে,বুদ্ধিমানে চোখ এড়িয়ে ভুলে যায়। আমরা সেখানে অভ্যাস করে নিয়েছি।
গণতান্ত্রিক সরকারের কাছেও আমাদের অধিকারবোধ নতজানু হয়ে যায়, অনুরোধ ও প্রার্থনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। সেখানে আরজি করের অভূতপূর্ব প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে গণতন্ত্রের অধিকারের পাঠটি আমাদের নতুন করে চিনিয়ে দিল। চাওয়া যখন প্রার্থনা হয়ে ওঠে,তখন তার ন্যায্য অধিকার খর্ব হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সেই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়ে শাসকে রূপান্তরিত হয় , তার ভাবমূর্তিতেও জেগে ওঠে রাজকীয় আধিপত্য ও ঔদ্ধত্য। যা ছিল গণতন্ত্রের উত্তরণের আধার,তাই হয়ে যায় গণতন্ত্রের পতনের আঁধার। সেই আঁধারে আলো ফেলে আরজি করের প্রতিবাদী আন্দোলন দেখিয়ে দিল জনগণের অধিকার কীভাবে চাইতে হয়। এই চাওয়া বা দাবিই তো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অধিকারের সৌরভ। তাতেই তো ‘রাজা সবারে দেয় মান, সে মান আপনি ফিরে পান’-এর আসল গৌরব। অথচ শাসক থেকে রাজা হয়ে ওঠা জনপ্রতিনিধিই জনগণকে মান না দিলেও তাদের কাছে নিজের মান ষোলো আনা প্রত্যাশা করে। আবার জনগণের চুপ করে থাকার মধ্যে সে সম্মান খোঁজে, চুপ করিয়ে রাখাতেই তার মানের প্রমাণ প্রদর্শন করে। সেক্ষেত্রে সেই আসল গৌরব আজ অস্তমিত সূর্যের মতো অপসৃয়মান মনে হয়। সেখানে আরজি করের প্রতিবাদী আন্দোলন আমাদের মনে নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলেছে।
আসলে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র থেকে আধুনিক চেতনায় বৈষম্যপীড়িত সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্রের উত্তরণ ছিল সময়ের অপেক্ষা। সেখানে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসনের চেতনা যেমন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে,সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার ত্রিবেণী সঙ্গমে তার প্রবাহ সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ সেখানে গণতন্ত্রের বৈপ্লবিক আবির্ভাবের আলো অচিরেই অপব্যবহারের শিকার হয়ে ওঠে। ক্ষমতায়নের স্বার্থে দলীয় শাসন ব্যবস্থা মাথা চাড়া দেয়, গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্র প্রাধান্য লাভ করে। সেখানে ক্ষমতালোভী মানুষের কাছেই সাধারণ মানুষের সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হতে থাকে, নতুন করে বৈষম্যের শিকারে পর্যুদস্ত জনজীবনে নেমে আসে বেঁচে থাকার লড়াই। গণতন্ত্রের আদর্শে ‘আমরা সবাই রাজা’র পরিবর্তে ‘রাজার সবাই আমরা’র দাসত্বের চেতনায় সেই ‘রাজা’ই প্রজা হয়ে ওঠে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রাজা বনে যায়। এজন্য গণতান্ত্রিক অধিকার রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দয়াভিক্ষার আর্জি হয়ে ওঠে।
মানুষের অধিকারবোধই যখন আবেদননিবেদনের চেতনায় স্বাভাবিকতা লাভ করে, তখন তার গণতন্ত্রের অধিকারের সৌরভ আপনাতেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গণতন্ত্রের নির্বাচনী অস্তিত্ব যত উগ্র রূপ লাভ করে,ততই তার জনবিচ্ছিন্ন মূর্তি প্রকট হয়ে ওঠে। ক্ষমতার আবর্তে যেখানে গণতন্ত্রের সুধার সুভাষ ছড়িয়ে পড়ার কথা,সেখানেই তার বৈষম্যের প্রকট অস্তিত্ব পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। যেখানে শাসক-শাসিত থেকে শোষক-শোষিতের বিভেদ ব্যবধান মুছে যাওয়ার কথা,সেখানে বিচ্ছেদে বিচ্ছিন্নতায় তা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতেই বৈষম্যের প্রকট অস্তিত্ব সময়ান্তরে মানুষের স্বাভাবিক অধিকারকে দমনপীড়নের শিকার করে তোলে। রাজনৈতিক দলতন্ত্রের চাপেই আজ গণতন্ত্রের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেখানে সর্বগ্রাসী দলীয় প্রভাবে মুখে গণতন্ত্র বললেও মনে তার সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারী মনোভাব। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার হরণ করেই শাসকের সর্বগ্রাসী অধিকার বিস্তার লাভ করে। যেখানে জনগণের অধিকার চাইতেও শাসকের দাসত্ব মেনে নেওয়ার প্রবণতা জারি থাকে,সেখানে অধিকার আপনাতেই আর্জিতে দয়াভিক্ষায় পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে আরজি করের অভাবিত বৈপ্লবিক আন্দোলন আমাদের গণতন্ত্রের আসল পথে সামিল হওয়ার পাঠটি হাতেকলমে শিখিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল কীভাবে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হয়, তার জন্য শিরদাঁড়া সোজা করে শাসকের মুখোমুখি হতে হয়।
যে গণতন্ত্র মানুষের সুদীর্ঘকালের আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত হয়েছে, আজ গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণের সেই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই চক্ষুশূল থেকে শিরঃপীড়া মনে হয়। যেন জনগণের আন্দোলন করার কোনও অধিকার নেই, আন্দোলন মানেই সরকারি ব্যবস্থাকে অমান্য করা। জনগণের স্বার্থে জনগণের নির্বাচিত জনগণের সরকারই জনগণবিমুখ রাজকীয় ভাবমূর্তিতে আজ জনবিচ্ছিন্ন। সেখানে মানুষের অভাবঅনটন দাবিদাওয়া শোনার সৌরভই না-শোনার অনীহায় স্বৈরাচারীর গৌরব হয়ে ওঠে। সেই জনগণকে তোয়াক্কা না করে নিজের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার স্বৈরাচারী মনোভাব যে গণতন্ত্রের পরিপন্থী, তা যে জনগণের দাসত্বকে পুঁজি করে দীর্ঘদিন চুপ করিয়ে রাখা যায় না,আরজি করের পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ডাক্তারি ছাত্রীর খুন ও ধর্ষণের নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রাজ্যের আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অথচ ধারাবাহিক সুদীর্ঘ প্রতিবাদী আন্দোলনের নাছোড় প্রকৃতির মধ্যেই তা প্রতীয়মান। সেখানে মানুষের মনের কথাই নানাভাবে প্রকাশমুখর। আরজি কর শব্দদুটিকে নিয়ে খেলতে গিয়েই খেলা উল্টে লেখা হয়ে যায় অসাধারণ একটি গণতান্ত্রিক পাঠ।
সেখানে ‘আর্জি নয়, কর’ থেকে ‘আর্জি নয়, দাবি কর’ উঠে আসে। গণতন্ত্রে কেউ রাজা নয়, অথবা সবাই রাজা। সেখানে অনুনয় বিনয় বা আবেদননিবেদন চলে না,চলতে পারে না,দাবিই তার অমোঘ অধিকার। সেই দাবির কথাই আরজি করের আন্দোলন শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়নি,হাতে গরম ও মুখে গরম চায়ের মতো আদায় করতেও পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এ তো শুধু জনগণ বা শাসকদলের ক্ষেত্রেই নয়, বিরোধী দলগুলোর ক্ষেত্রেও সমান জরুরি পাঠ, ভাবা যায়! অন্যদিকে আমরা গণতন্ত্র পেলেও গণতন্ত্রমনস্ক হতে পারিনি। সেক্ষেত্রে আরজি করের আন্দোলন একসময় থেমে গেলেও তার রেশ থেকে যাবে ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে, গণতান্ত্রিক পাঠের অপরিহার্য পাঠের আনুকূল্যে আমাদের সঙ্গেই।