• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

অনিয়ন্ত্রিত

কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য টাকা পড়ে রয়েছে। তা পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

বাড়ি ডুবছে। আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। শস্যখেত গভীর জলের তলায়। মানুষ বড় অসহায়।আর এ সবের জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্যোগহীন এই সরকার মানুষের বিড়ম্বনা বোঝে না— এই অভিযোগ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যিনি সম্প্রতি বন্যাক্লিষ্ট বর্ধমানে এসে প্রশাসনিক বৈঠকে কেন্দ্রকে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ-বন্যার জন্য ডিভিসি’র বাঁধগুলি থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জল ছাড়ার জন্য দায়ী করেন। মুখ্যমন্ত্রী বন্যা পরিস্থিতি দেখতে বাঁকুড়ায় যান, সেখানে তিনি জনসাধারণকে আশ্বাস দেন তিন বছরের মধ্যে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ করা হবে। আর একথা শুনে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘২০২৬ সালে মাস্টার প্ল্যান আমরাই করব।’

এখানে মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক ভাবেও কেন্দ্রীয় সরকারকে বিদ্ধ করেন এই বলে ‘রাজনৈতিক ভাবে যে লড়াই, আমাদের সঙ্গে লড়ো। কিন্তু জেনেবুঝে জল ছেড়ে মানুষের প্রাণ নিও না।’ মমতা বলেন, ‘ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলেই আমাদের দুর্ভাবনা হয়। নিজেদের বাঁচাতে বাঁধ থেকে জল ছেড়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী বন্যায় প্লাবিত জেলাগুলির খবর শুনে বলে দেন, ‘এটা ম্যানমেড বন্যা’। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, ফ্লাড কন্ট্রোল ডিভিসি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু কোনও কাজ করে না। বেশি বৃষ্টি হলে জলাধারের জলধরার ক্ষমতা বিপদসীমার ঊর্ধ্বে উঠলেই বাড়তি জল ছাড়া ব্যতিত বিকল্প কোনও পথ নেই। কিন্তু প্ল্যান করে নিয়ন্ত্রিত ভাবে জল ছাড়লে এই বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে ডিভিসি’র আপার ক্যাচমেন্টে যে জলরাশি সৃষ্টি হয়, তা বাঁধগুলিতে ধরা হয়। কিন্তু এই বাঁধগুলির জল ধরার ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা আছে— তার উপরে উঠলেই জল ছাড়তে হবে বাঁধকে রক্ষা করতে। আর বাঁধ ভেঙে গেলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এই রাজ্যের কয়েকটি জেলায় মানুষের বাড়িঘর জলের তলায় চলে যাবে।

ডিভিসি’র সঙ্গে জল ছাড়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজিয়া নতুন নয়। প্রতি বছরই বর্ষায় সাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে বেশি বৃষ্টি হয়। জল ধরার ক্ষমতা বিপদসীমার ঊর্ধ্বে উঠলেই, বাড়তি জল ছাড়তে হয়। এমন সময়ও আসে হঠাৎ বেশি জল ছাড়তে হয় জলাধারগুলি বাঁচাতে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও ডিভিসির জল ছাড়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা, পত্রযুদ্ধ চলত। কিন্তু সমস্যা যেমন ছিল, তেমনই আছে, কোনও পরিবর্তন হয়নি। এবারও এই ডিভিসির জল ছাড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বন্যা-প্লাবিত জেলাগুলির অবস্থ্য জানিয়েছেন। আর তার জন্য দায়ী হলো ডিভিসি থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়া। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার এবং বর্তমান সরকার উভয়েই কেন্দ্রকে দোষারোপ করছে জলাধার ড্রেজিং না করার জন্য। জলাধারগুলিতে ড্রেজিং করে বাড়তি পলি তুলে ফেললে, তাদের জল ধরার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বর্ষা বিদায় নিলে সে কথা আর ডিভিসি কর্তৃপক্ষের মনে থাকে না। তাই প্রতি বছরই এই জল ছাড়া নিয়ে কাজিয়া। আর বর্ষা বিদায় নিলে ডিভিসি কর্তৃপক্ষ চুপ!

যা হয় অন্যান্য বার বন্যার ক্ষতিপূরণ চেয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের চিঠি-চাপাটি চলে। কেন্দ্র একটি সমীক্ষক দল পাঠায়। দলের সদস্যরা বন্যা-ক্লিষ্ট জেলাগুলি ঘুরে দেখে কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু রাজ্য সরকার বন্যায় জেলাগুলির ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে যে অর্থ চেয়ে পাঠায়, মাসের পর মাস গেলেও মেলে না। যখন মেলে তার পরিমাণ এত কম যে সে অর্থে পুনর্বাসন সম্ভব নয়। এই অবস্থা প্রতিবছরই দেখা যায় কিন্তু কেন্দ্রের কোনও হেলদোল নেই। ড্রেজিং করতে অবশ্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, কিন্তু সে টাকার অভাবে তা সম্ভব হয় না।

কিন্তু কথা হল ডিভিসি কি প্রতি বছর বর্ষায় জলাধারগুলি থেকে অতিরিক্ত জল ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের চার-পাঁচটি জেলাকে প্লাবনের হাত থেকে না বাঁচিয়েই চলবে? বিষয়টি নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গেও ডিভিসি কর্তৃপক্ষের মধ্যেই বিরোধ চলেছে। জ্যোতি বসু যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন ডিভিসি’র ছাড়া জলে রাজ্যের অনেক জেলা প্লাবিত হয়। ডিভিসি কর্তৃপক্ষকে রাজ্যকে না জানিয়ে হঠাৎ অতিরিক্ত জল ছাড়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। জ্যোতি বসু তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন ডিভিসি থেকে এভাবে রাজ্যের অগোচরে জল ছাড়ার তীব্র নিন্দা করে। অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। তার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী লেখেনন, শুখা মরশুমে ডিভিসি’র জলাধারগুলিতে তাদের ড্রেজিং করার কাজ করতে হবে। কিন্তু সে কাজ অদ্যবিধি হয়নি। আর তার ফলস্বরূপ প্রতি বছরই ডিভিসি’র ছাড়া জলে প্লাবনের সৃষ্টি হয় বেশ কয়েকটি জেলায়। রাজ্যের কাঁধে বাড়তি বোঝা চাপে। বন্যায় ঘরছাড়া মানুষদের আশ্রয় দিতে হয়। দিতে হয় খাবার।

এবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্যায় বিধ্বস্ত জেলাগুলি পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এ ব্যাপারে একটি বিহিত করার আবেদন জানান। এখনও সে চিঠির জবাব পাওয়া যায়নি বলে নবান্ন সূত্রের খবর। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সমস্যার কি কোনও সমাধান মিলবে না? প্রতি বছরই বন্যায় ভাসবে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা? এবারও বন্যার কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হবে। ব্যাপক শস্যহানি হবে। প্রচুর সংখ্যক লোকের ঘরবাড়ির বিস্তর ক্ষতি হয়েছে।

বন্যার পর রাজ্যে যে সমস্যার উদ্ভব হয়, তা হল বন্যার্তদের পুনর্বাসন। রাজ্যের কোষাগারে এত অর্থ নেই, যা দিয়ে এই পুনর্বাসনের কাজ করা যায়। অথচ কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য টাকা পড়ে রয়েছে। তা পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।