শোভনলাল চক্রবর্তী
রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশ হল৷ ছক্কা হাঁকাল তৃণমূল৷ কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর চব্বিশ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালডাংরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর-সহ সব জায়গাতেই উড়ল সবুজ আবির ৷ মাদারিহাট আসন হাতছাড়া হল বিজেপি’র ৷ রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপি-কে উড়িয়ে ঘাসফুল ফোটাল তৃণমূল৷ জুলাই ও নভম্বর মিলিয়ে রাজ্যে মোট ১০টি বিধানসভা উপনির্বাচনে সব ক’টি আসনেই বাজিমাত করলেন মমতা-অভিষেক৷
আরজি কর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সমাজমাধ্যমে বামেরা ভোটের নাম দিয়েছিলেন দ্রোহের ভোট। কিন্তু সুফল ঘরে তুলতে পারলেন না বামেরা৷ সিপিআইএম(এল)-এর সঙ্গে জোট বেঁধেও দাগ কাটতে ব্যর্থ লাল ঝান্ডা ৷ ছ’টি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হল বাম ও কংগ্রেসের। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে ধারাবাহিকতা দেখেছিল বাংলা। যে আন্দোলনে মূলত উদ্বেল হয়েছিল শহর এবং জেলার মফস্সল বা ছোট শহর। যে আন্দোলন থেকে শাসকদলের বিরুদ্ধে স্বর উঠেছিল। কিন্তু আরজি কর আবহে রাজ্যের ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনে সেই নাগরিক আন্দোলনের কোনও প্রভাবই পড়ল না! ছ’টি আসনের মধ্যে নৈহাটি এবং মেদিনীপুর— এই দু’টিই ‘শহরের আসন’ ছিল। নৈহাটি কলকাতা লাগোয়া। শুধু তা-ই নয়, আরজি করের নির্যাতিতার বাড়ির ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে নৈহাটি। সেখানে দাঁড়াতেই পারেনি বিরোধীরা। দাপট দেখিয়ে জিতেছে তৃণমূল।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোট এবং গত লোকসভায় বিধানসভাওয়াড়ি যে ব্যবধান ছিল নৈহাটিতে, তা-ও ছাপিয়ে গিয়েছে জোড়াফুল শিবির। নাগরিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে। যদিও উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের কেউ প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন যে ভোটের ফল নিয়ে তাঁরা আদৌ কোনও কথা বলবেন কি না, তা নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন।নৈহাটিতে ২০২১ সালে তৃণমূল জিতেছিল প্রায় ১৯ হাজার ভোটে। ২০২৪ সালের ব্যারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত এই বিধানসভায় তৃণমূলের ‘লিড’ কমে হয়েছিল ১৫ হাজার। উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজারে পৌঁছেছে।
অন্য দিকে, মেদিনীপুর আসনে ২০২১ সালে তৃণমূলের জুন মালিয়া জিতেছিলেন ২৪ হাজারের বেশি ভোটে। কিন্তু সেখানেই লোকসভা ভোটে জুনের ‘লিড’ কমে হয়েছিল দু’হাজারের কিছু বেশি। উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৩ হাজার। আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে ঝান্ডাহীন হয়ে সব থেকে বেশি সম্পৃক্ত ছিল বামেরা। কিন্তু দেখা গেল, এই দুই আসনেই বামেরা জামানত খুইয়েছে। অর্থাৎ, আন্দোলনের কোনও সুফল তারা ইভিএমে তুলতে পারেনি। বিজেপিও আরজি কর নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ করে গিয়েছে। নাগরিক আন্দোলনে সে ভাবে ভিড়তে না পারলেও পৃথক ভাবে আন্দোলন জারি রেখেছিল পদ্মশিবির। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’। কিন্তু কোনও কিছুতেই কিছু হল না।
কেন হল না, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে বাম শিবিরের নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, নাগরিক আন্দোলন হলেও সমান্তরাল কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। প্রক্রিয়াও ছিল না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সিপিএম নেতৃত্বের মতে নানা সমীকরণ মাথায় রেখে মানুষ উপনির্বাচনে ভোট দেন। এই ভোটে সরকার বদলের বিষয় থাকে না। ফলে এ দিয়ে নাগরিক আন্দোলনকে মাপা ঠিক হবে না। তাঁরা হয়ত আপাতত এই তত্ত্ব খাড়া করবেন যে পরবর্তী কালে যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষ সার্বিক ভাবে মতদানের সুযোগ পাবেন, যখন বদলের প্রেক্ষাপট থাকবে, তখন এই আন্দোলনের প্রতিফলন দেখা যাবে। তবে এ কথা মানতেই হবে যে ভোটে প্রতিফলন হল না মানে নাগরিক আন্দোলন বা তার স্বতঃস্ফূর্ততা নস্যাৎ হয়ে গেল তার কোনও মানে নেই।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন যে, ২০২৬ সালের ভোটে নৈহাটি, মেদিনীপুর তো বটেই, তালড্যাংরা আর মাদারিহাটও তাঁরাই জিতবেন। এ কথা ঠিক যে, সাধারণত উপনির্বাচনে শাসকদলই জেতে। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। বামজমানার শেষ পাঁচ বছরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা কেন্দ্র করে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এ-ও বাস্তব যে, সেই সময়ে সমান্তরাল ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনও ছিল। এবং সেই আন্দোলনের ‘মুখ’ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখা গিয়েছিল ২০০৯ এবং ২০১০ সালে বাংলার তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। সেই তালিকায় ছিল কলকাতার পূর্ব বেলগাছিয়াও। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর আসনে পরাস্ত হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী।
আরজি কর পর্বে নাগরিক আন্দোলন পুরোপুরি ‘অরাজনৈতিক’ ছিল না। তবে সেই আন্দোলন ছিল দলহীন, পতাকাহীন। বিরোধী পরিসরে বাম এবং বিজেপির ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ পতাকাহীন আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই আন্দোলনের ‘লেজুড়’ হয়েছিল।বাম এবং বিজেপি নেতাদের এটা বুঝতে হবে যে নির্বাচনী রাজনীতিতে তৃণমূলের গণভিত্তি অনেক গভীরে প্রোথিত। সংগঠনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র (ইকনমিক ইকোসিস্টেম) তৈরি করে ফেলেছে তৃণমূল। সরকারি বিভিন্ন ভাতা ছাড়াও তৃণমূলের সঙ্গে থাকার সুবাদে প্রতিটি এলাকার বহু মানুষ পেট চালাচ্ছেন। তাঁরা যে সবাই দুর্নীতিতে রয়েছেন তা নয়। কিন্তু তাঁদের কাছে তৃণমূল রুটিরুজি। এই অংশই তৃণমূলকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। তবে সামাজিক ভাতার প্রভাব যে প্রতিটি ভোটে পড়ছে, তা মানতেই হবে। গত লোকসভা ভোটে শহরাঞ্চলে খারাপ ফল করেছিল তৃণমূল। যার ভিত্তিতে দলে রদবদলও করতে হয়েছিল। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নাগরিক আন্দোলন দেখে অনেকেরই বক্তব্য ছিল, লোকসভা ভোটের ‘মনোভাব’ই প্রতিফলিত হচ্ছে রাস্তায়। কিন্তু উপনির্বাচন তেমন কথা বলেনি। তৃণমূলের জন্য এর চেয়ে ‘স্বস্তিদায়ক’ আর কীই বা হতে পারে।
উপনির্বাচনের ফলকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিরোধী দলনেতারা ঘুরিয়ে মহারাষ্ট্রে হিন্দুত্বের জয় হয়েছে বলে শেষে উপনির্বাচনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অবশ্যই প্রভাব রয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন। উপনির্বাচনে ভোটই হয় না বলে অনেক বিরোধী নেতা লোকসভায় “দেখে” নেওয়ার কথা বলেছেন৷ নৈহাটি, মেদিনীপুর, তালডাংরা ও মাদারিহাট ২৬-এর নির্বাচনে তাঁরা জিতবেনই এমন কথাও বলেছেন।
তবে হিসেবে দেখা যাচ্ছে উপনির্বাচনে হেরেও ধূপগুড়িতে লোকসভার নিরিখে কুড়ি হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি ৷ তৃণমূলকে উৎখাত করতে গেলে তাঁদের আরও বেশি করে রাস্তায় থাকতে হবে। কিন্তু সেটা কে করবে? এই ভোটের সঙ্গে আরজি করের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, বলছেন বিরোধীরা।এই বলে তাঁরা আদতে একটি কল্পনার দুনিয়ায় ঘুরে মরছেন। আবাস যোজনার বেনিয়ম নিয়ে মানুষ বিরোধীদের বক্তব্য শুনেছেন। ভোটের দিন সন্ত্রাসও দেখেছেন। ভোট করতে দেওয়া হয় নি ,ভোট হয়েছে বলেই জানা নেই, বিরোধীদের এই সব বক্তব্য তাঁদের সাধারণ মানুষের থেকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
অপর দিকে মমতা নিশ্চয় দেখানোর চেষ্টা করবেন যে তাঁর দল ছটা আসনে জিতেছে মানেই আরজি করে যা হয়েছে সব সঠিক। কেউ বলবে না ছাত্রীর উপর ধর্ষণ-খুন সব ঠিক, কারণ আমরা জিতেছি। তাহলে মহারাষ্ট্রে বলতে হয় যে, বিজেপি কাজ করেছে ।আদতে বিজেপি সেখানে শুধুই বিভেদ সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছে। মানুষের মধ্যে সংঘাত করে জিতেছে। এখানেও সন্ত্রাস, বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন হয় না, একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে,তবে এখানে আরেকটা জিনিস হয়, মানুষকে কিছু সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়। উপনির্বাচনের ফলকে আরজি করের ঘটনা অস্বীকার করার সঙ্গে সমীকরণের মত মিলিয়ে দেওয়া ভুল হবে। অন্যায় দেখলে মানুষ প্রতিবাদ জানাবে,এটাই নিয়ম। তৃণমূলের মুখপাত্ররা এই ফল দেখে যদি আর জি কর কান্ডের বিচারে বসেন,তবে মস্ত ভুল করবেন।সেক্ষেত্রে তৃণমূলকে দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ভুগতে হবে।
এই উপনির্বাচনে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন বিষয় তা হল, বিজেপির দখলে থাকা মাদারিহাট আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। নিজেদের শক্তঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মাদারিহাটেও পরাজিত বিজেপি। তবে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের মতে উপনির্বাচনে এসব ফল হতেই পারে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ২০২৬-এ বাংলায় ক্ষমতায় আসবেন তাঁরাই। মাদারিহাট বিধানসভায় এই কাজ করতে প্রথমবার জয়ের স্বাদ পেল তৃণমূল কংগ্রেস৷ উপনির্বাচনে ২৮ হাজার ১৬৮ ভোটে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জয়প্রকাশ টোপ্পো ৷ এর জন্য মাদারিহাটবাসীকে বিশেষ অভিনন্দন জানিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ টোপ্পো পেয়েছেন ৭৯ হাজার ১৮৬টি ভোট৷ তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী রাহুল লোহার পেয়েছেন ৫১ হাজার ১৮টি ভোট৷ ২০১৬ থেকে এই আসন ছিল বিজেপির দখলে৷ তার আগে এই আসনে আধিপত্য ছিল আরএসপি’র৷ এবার মনোজ টিগ্গা আলিপুরদুয়ার থেকে লোকসভা ভোটে জিতে সাংসদ হওয়ায় মাদারিহাট বিধানসভায় উপনির্বাচন হয়৷ একদিকে, মাদারিহাটে তৃণমূলের জয়, দলকে চাঙ্গা করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু, এই ভাবে বিরোধী শূন্য বাংলা শেষ কবে ছিল সেই নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। বিরোধীহীন গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অশনি সঙ্কেত।সুতরাং যাঁরা ভোটের ফলাফলে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত মানবিক আবেদনের পতন দেখছেন,শিক্ষার অবনমন দেখছেন, অতটা না হলেও ব্যাপারটা চিন্তার।