শোভনলাল চক্রবর্তী
শিরোনামের বাক্যটি বলেছিলেন জটায়ু, ফেলুদার যত কান্ড কাঠমান্ডু গল্পে।তবে আপাতত রাজ্য রাজনীতি ওই শব্দবন্ধে সরগরম— থ্রেট কালচার বা হুমকি-প্রথা। আরজি কর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় উঠে এসেছিল কথাটি। তার পর ক্রমে প্রকাশিত হল যে, শুধু আর জি কর নয়, শুধু মেডিক্যাল কলেজগুলিও নয়, এমনকি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রও নয়— এই হুমকি-প্রথা কার্যত রাজ্যের প্রতিটি পরিসরে কাজ করে চলেছে। তার কার্যপদ্ধতিটিও ক্ষেত্র-নির্বিশেষে অভিন্ন— যারা হুমকি দেয়, তারা প্রত্যেকেই শাসক দলের কোনও ক্ষমতাবান শিবিরের সঙ্গে যুক্ত; এমন শিবির, যাদের পক্ষে চাইলে কারও ক্ষতি করা সম্ভব, অথবা তা সম্ভব বলে একটি ধারণা বাজারে প্রচলিত আছে।
হুমকি-প্রথা হল সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অন্যায্য ‘খাজনা’ আদায়ের পদ্ধতিবিশেষ। অর্থাৎ, হুমকি-প্রথা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়ই, তা এমনকি কোনও পৃথক বস্তুও নয়— পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরে যে ‘খাজনা’ আদায়ের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, হুমকি-প্রথা তারই একটি বিশিষ্ট রূপ। বস্তুত, হুমকি বিনা কোনও ক্ষেত্রেই অবৈধ খাজনা আদায় করা মুশকিল। যে বস্তুটি কারও কাছে প্রাপ্য নয়, তা যদি কেড়ে নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে ছল অথবা কৌশলের তুলনায় বল-এ অনেক সহজে কাজ হয়— অন্তত শাসক দলের বাহুবলীদের তেমনই ধারণা। আর জি কর-কাণ্ডের প্রাবল্যে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান বা চোপড়ার জেসিবি-র মতো বাহুবলীদের কথা আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছে। সেই শাসকাশ্রিত গুন্ডাদের সঙ্গে আর জি করের হুমকি দিয়ে বেড়ানো ‘ডাক্তার-মস্তান’ অথবা টালিগঞ্জ চলচ্চিত্র শিল্পের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক শাসক দলের নেতার চরিত্রগত প্রভেদ নেই।
জেসিবির মতো গুন্ডা হাতে মারে; শহরের পরিশীলিত শিক্ষা বা শিল্পজগতের হুমকিদাতারা মূলত ভাতে মারার কথা বলে থাকেন। প্রয়োজনে তাঁদের হাতও যে চলে না, সে দাবি অবশ্য করা যাবে না। যে সব জায়গায় তাঁরা প্রত্যক্ষ আর্থিক খাজনা আদায় করেন না, সেখানে আনুগত্য আদায় করেন— আর্থিক খাজনা আদায়ের পথে কেউ যাতে বাধা না হন, তা নিশ্চিত করতে এই আনুগত্য জরুরি।আরজি কর-কাণ্ডের আবহে অভিযোগ উঠেছে, উত্তরবঙ্গ, বর্ধমান এবং মালদহ-সহ রাজ্যের কয়েকটি হাসপাতালে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আরও অভিযোগ, এই হুমকির শিকার হচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ওই হাসপাতালগুলিতে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর লোক এই ধরনের কাজ করছেন। পুরো বিষয়টির তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে।
আদালতের কাছে মামলাকারী আবেদন করেছেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে এ সবের তদন্ত করা হোক।এই বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষার উত্তরপত্র ফাঁস, শ্লীলতাহানি, দুর্নীতি, হয়রানির মতো অভিযোগ উঠছে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে। আদালত এতে খুবই উদ্বিগ্ন। রাজ্যের আইনজীবী জানান, ওই অভিযোগগুলি জানার পরে পদক্ষেপ করা হয়েছে। অনেক অভিযুক্তকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। হাই কোর্ট জানিয়েছে, এ নিয়ে কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং রাজ্য সরকারকে তা হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে।যাঁদের বিরুদ্ধে আরজি করে ভয়ের পরিবেশ তৈরির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের নামের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছেন আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ওই চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ। সন্দীপ হাসপাতালে নিজের ‘প্রভাব’ বিস্তার করে নানা ‘দুর্নীতি’-তে মদত দিতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা দাপিয়ে বেড়াতেন হাসপাতালে। উত্তরবঙ্গ, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ‘হুমকি সংস্কৃতি’র অভিযোগ ওঠে। প্রকাশ্যে আসে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, অভীক দে-র নাম। অভিযুক্তদের দফায় দফায় হাসপাতালে তলব করেছে তদন্ত কমিটি। তার পরেও কেন কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হয়নি, অভিযোগ জানিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আরজি কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার, ইন্টার্ন, ডাক্তারি পড়ুয়ারা। এর ভিত্তিতে ১০ জন চিকিৎসককে আরজি কর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও কড়া পদক্ষেপ করা হয়েছে।
সব অভিযুক্তের নামের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছেন আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের বিরুদ্ধে আরজি করে হুমকি ও ভয়ের পরিবেশ তৈরির অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও অভিযোগ, ওই চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পড়ুয়ারা কেউ তাঁদের কথা না মানলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত। শুনতে হত হস্টেল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও। রাত তিনটের সময় হস্টেলের ঘরে ডেকে চলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এ ছাড়াও, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হত ছাত্রদের। মিটিং-মিছিলে না এলে চলত হেনস্থা। হস্টেলেও নির্বিচারে চলত র্যাগিং। কখনও গভীর রাতে মদ আনতে পাঠানো হত অনুজদের। কমন রুমে সিনিয়রদের নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে দেখাতে হত। রাজি না হলে চলত বাবা-মা তুলে কদর্য গালিগালাজ। এমন নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ৫৯ জনের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযু্ক্তদের মধ্যে ৪৩ জনকে হস্টেল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
তৃণমূল-শাসনে এই হুমকি-প্রথাভিত্তিক খাজনা আদায়ের সংস্কৃতিটি সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী হয়েছে। তবে, বঙ্গভূমে এই প্রথার উৎপত্তিও তৃণমূল আমলেই ঘটেছে, এ কথা বললে সিপিএমের লোকাল কমিটির প্রেতাত্মাগুলিও অট্টহাস্য করে উঠবে। পার্টির ক্ষমতা ব্যবহার করে ভয় দেখানো, নাজেহাল করা, হুমকি দেওয়া, চাকরিক্ষেত্রে বিবিধ অসুবিধা তৈরি করা, এবং অতি অবশ্যই আনুগত্য ক্রয়— বাম আমলে এর প্রতিটি ঘটনা অতি নিয়মিত ঘটেছে। তৃণমূল আমলে এই অনাচারের তীব্রতা বেড়েছে। তার একটি বড় কারণ, এই জমানায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তির গণতান্ত্রিকায়ন ঘটেছে— অর্থাৎ, শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত যে কেউ এখন অবৈধ খাজনা আদায়ের অধিকারী।
খাজনার ক্ষেত্র— অর্থাৎ যে কোনও পরিসর, যেখানে সাধারণ মানুষ যে কোনও গোত্রের কাজ করে থাকেন— আয়তনে সীমিত, কিন্তু আদায়কারীর সংখ্যার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। অর্থশাস্ত্রের যুক্তি বলবে, এমন ক্ষেত্রে অতি-শোষণ অনিবার্য— অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় যা ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’ নামে খ্যাত। যে হারে শোষণ করলে ব্যবস্থাটি সুস্থায়ী হতে পারে, এই গোত্রের ‘কমন প্রপার্টি’-র ক্ষেত্রে শোষণের হারটি তার চেয়ে অনেক বেশি। এবং, শোষণের হার যত বাড়ে এবং শোষণযোগ্য সম্পদের পরিমাণ যত কমতে থাকে, খাজনা আদায়ের জন্য হুমকি ও বাহুবলের ব্যবহারও ততই অনিবার্য হয়ে পড়ে। যে ক্ষেত্রগুলি এত দিন খাজনা আদায়ের পরিসরের বাইরে থাকত, সেগুলিও তার অন্তর্গত হতে থাকে। অভিজ্ঞরা বলে থাকেন যে, বাম আমলে দুর্নীতিও চলত লোকাল-জ়োনাল-রাজ্য কমিটির নির্দিষ্ট ক্রমান্বয়ের নিয়ন্ত্রণে— ফলে, অতি-শোষণকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত। তবে, অতীতে কী হয়েছে, সে যুক্তি দিয়ে যে বর্তমানের অন্যায়কে কোনও ভাবেই সমর্থন করা চলে না, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন। এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়ভারটি শেষ পর্যন্ত তাঁরই উপরে বর্তায়।