মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন
পৃথিবীতে আমরা এখন ৮০০ কোটির বাসিন্দা৷ তার প্রাকৃতিক সম্পদ এই মানুষেরই অধিকারে৷ নদী, সমুদ্র, পর্বত, অরণ্যভূমি, ফসলের ক্ষেত— সব তারই দখলে৷ কোটি কোটি প্রাণীপুঞ্জের জন্মলগ্ন থেকে জলই তাদের জীবন৷ আজকের পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন এবং জলের প্রবল অপব্যবহারে ক্রমশ কমে আসছে জলভাণ্ডার৷ সুপেয় জল দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে৷ বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা শুনছি কিন্ত্ত মানুষ তাতে তেমন আমল দিচ্ছে না৷ উষ্ণায়নের প্রভাবে ফাটল ধরেছে মাটিতে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের জলতল৷ লবণাক্ত জলে মিশে যাচ্ছে মিষ্ট জলের ভাণ্ডার৷ বিশ্বজুড়ে ৩৬০ কোটি মানুষ এখন জল সংকটের মুখে৷ স্টেট অফ গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান আগামীদিনের জন্য আরও ভয়াবহ জলসংকটের বার্তা বহন করছে৷ আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরে ৫০০ কোটি মানুষ এই সংকটের সম্মুখীন হবে৷
আমাদের দেশেও আমরা এগোচ্ছি চরম জল সংকটের দিকে৷ জলের উৎস জলের প্রবাহ সবটাই নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর৷ একদিকে পৃথিবীর সঞ্চিত জলরাশি আর একদিকে নদী খালের প্রবাহ আর বৃষ্টিপাত৷ এই নিয়েই জলসম্পদ৷ কৃষিকাজের সবটাই প্রায় নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের ওপর৷ বৃষ্টির ৮০ শতাংশ জল আমরা পাই মূলত বর্ষাকালে৷ যেখানে বৃষ্টিই কৃষির প্রাণ, সেখানে খরা হল কৃষির সবচেয়ে বড় বিপদ৷ মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের বহু অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে খরাপ্রবণ৷ নামমাত্র বৃষ্টির জন্য এখানে জমা জলের সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না৷ অন্যদিকে জলস্তর ক্রমশ মাটির গভীর থেকে আরও গভীরে নেমে যাওয়ায় সংকট বেড়েছে৷
জল যেহেতু জনজীবন ও কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাই জলের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে জলসংরক্ষণের অন্য কোনও বিকল্প নেই৷ জল সংকটের মূলে আছে অনাবৃষ্টি৷ বৃষ্টির অভাব খরাকে অনিবার্য করে তোলে৷ গত ১৫০ বছরে খরা এসেছে বহুবার৷ অনাবৃষ্টির এই অভিশাপ দেখা গেছে ১৮৭৬, ১৮৯৯, ১৯১৮, ১৯৬৫ এবং ২০০০ সালেও৷ এর মধ্যে ১৮৯৯ সালের খরা এনেছিল বিভীষিকা৷ ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বছরের একটানা খরা আমাদের দেশে ১৫০ বছরের ইতিহাসে দীর্ঘতম খরা৷ খরার প্রকোপ যেহেতু উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বেশি তাই জলাভাব এখানে দুর্বিষহ জায়গায় পেঁৗছেছে৷ রাজস্থান, গুজরাতের রুক্ষ এলাকায় মাইলের পর মাইল হেঁটে মেয়েরা যায় জল আনতে৷ ভূমিতলে পাওয়া সেই জল কিছুদিন পরপরই নীচের স্তরে নেমে যায়৷ কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্সের সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ভারতের ২১টি মেট্রো শহরে জলস্তর প্রায় নিঃশেষ হওয়ার মুখে পেঁৗছে যাবে৷ নীতি আয়োগের প্রতিবেদন অনুযায়ী৷ ২০৩০ সালের মধ্যে যেমন আরও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তেমন জলের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে দ্বিগুণ৷ আবহবিদরা উল্লেখ করছেন আরও শুষ্কতম বছরের সম্ভাবনার কথা৷ কেন্দ্রীয় জল কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত জলের পরিমাণ আমাদের দেশে ৩৯০ কিউবিক মিটারের কাছাকাছি৷ এই জল কৃষিতে এবং পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার হয় ৮৯ শতাংশ, গৃহকাজে ব্যবহার হয় ৯ শতাংশ এবং শিল্পক্ষেত্রে ২ শতাংশ৷ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া জল আরও যত্নে সংরক্ষণ করতে হবে৷ এদিকে অত্যধিক ভূতল অনুসন্ধানে ঘা পড়ছে জলস্তরে৷ এতে জলের সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে৷ চল্লিশের দশকের শেষে যেখানে জলের লভ্যতা জনপ্রতি ছিল ৫০০০ ঘনফুট, এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৭০০ ঘনফুট৷
বিশ্বজুড়ে জলের ব্যবহারে বেড়েছে ১৯৬০ সালের পর থেকে৷ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ প্রথম ১৭টি দেশে, যেখানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করেন, সেখানেই সংকট তীব্র হয়েছে৷ এইসব দেশের শিল্প শহরাঞ্চলের প্রাপ্ত জলের ৮০ শতাংশ তারা ব্যবহার করে ফেলেন৷ সেখানেও মানুষ জল সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন৷ ভূতত্ত্ববিশারদরা বলছেন, জলের সরবরাহ ও ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য আরও বাড়ছে বলেও খরা বার বার দেখা দিচ্ছে৷ যার প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বজুড়ে আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ওপর৷ সভ্যতা ও তার জনজীবন শুধু স্থলভূমিতেই গড়ে ওঠে না, জীবনযাপনে জলই তার ভিত্তি৷ জলধারা প্রাণের শিরায় শিরায় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে৷
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজকের প্রযুক্তির যুগ, জল মানুষের ত্রাণকর্তা৷ তাই জলের সরবরাহ ও সংরক্ষণ আজ সবচেয়ে জরুরি৷ জলের উৎস যেমন শুকাচ্ছে, অপচয়ও তেমন বাড়ছে৷ জলের ঘাটতিও তাই বিশ্বজুড়ে৷ এই ঘাটতির প্রভাব পড়ছে সুপেয় জলে৷ যে জলের ৯৯ শতাংশ পাওয়া যায় ভূগর্ভ থেকে৷ ২০১৯ সালে চেন্নাইয়ের জলসংকট আন্তর্জাতিক শিরোনামে চলে এসেছিল৷ কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক তাই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদের মতো শহরগুলিতে৷ বড় শহরের জল সংরক্ষণ শুধু শহরকে বাঁচায় না, বাঁচায় পারিপার্শ্বিক অঞ্চলকেও৷ পরিষ্কার স্বচ্ছ জলের সংস্থান যেহেতু সীমিত তাই তার ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার৷ ছাড়তে হবে সুপেয় জলের অপচয়ের অভ্যাস৷ জলের জোগান যেহেতু অসম, তাই বৃষ্টিই অনেকটা ভরসা৷ প্রাকৃতিক জল সংরক্ষণ এবং ক্রমক্ষীণ হয়ে যাওয়া জলের স্তরকে আবার পূরণ করা সরকারি প্রশাসনের এক বড় দায়িত্ব৷ এতে ভূগর্ভস্থ জলের বহমান স্রোতের যেমন উন্নতি ঘটানো যায়, তেমনি গভীর জলাশয়গুলিতে জল সঞ্চয় করা সহজ হয়৷ বর্জ্য জলের ধারাকে ব্যবহার ও সাশ্রয়ের পথ খুঁজেছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এই জল পরিস্রুত পরিশোধিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেকদিন৷
ইতিহাস অনুসন্ধানে যত খরা, অনাবৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যাক না কেন, তখন ভূগর্ভে জমা ছিল অফুরন্ত জলভাণ্ডার৷ এই জল আজও মানুষের সহায়ক৷ এখন দ্রুত নগরায়ণের জন্য টান পড়েছে জলে৷ যথেচ্ছ জল ব্যবহার ও অপচয়ে সঞ্চিত জলরাশি অপ্রতুল হয়ে পড়ছে৷ আমাদের ১৪০ কোটি ছুঁই ছুঁই মানুষের দেশে গ্রামের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৫৬ হাজার৷ ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বাস করেন গ্রামাঞ্চলে৷ শুধু গ্রামাঞ্চল কেন, সারা দেশের অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পান না৷ শহর মিউনিসিপ্যালিটির বাইরে গ্রামের জনবসতিতে পানীয় জলের অভাব আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে৷ গ্রীষ্মে তা হয়ে ওঠে আরও নিদারুণ৷
পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ রয়েছেন পানীয় জল সরবরাহের পাইপ লাইনের বাইরে৷ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল এলাকায় জলকষ্ট বাড়ে বর্ষা চলে যেতেই৷ নদীর জলস্রোতও ক্ষীণ হয়ে আসে৷ গভীর নলকূপের জলে ক্রমশই বেড়ে চলেছে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের দূষণ৷ নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের বহুগ্রামে পরিস্রুত জল পেঁৗছে যাচ্ছে কম দামে সাধারণ মানুষের কাছে৷ নদিয়ার তেহট্ট ব্লকের জিতপুরের তাঁতিপাড়ায় দেখা হল এমনই তিনজনের সঙ্গে৷ যারা কয়েক বছর ধরে মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে ২০ লিটার করে জল পেঁৗছে দিচ্ছেন মানুষের দরজায়৷ ভূগর্ভের জলের অভাবে দেশে টিউবওয়েলের যুগ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ গভীর নলকূপও পর্যাপ্ত নেই৷ গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে বোতলবন্দি জল সাম্রাজ্য৷ সবার পক্ষে যা কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না৷
পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ মিষ্টিজল জমাট বেঁধে আছে মেরুপ্রদেশের হিমবাহে৷ উষ্ণায়নের প্রভাবে সেখান থেকে ভাঙছে বরফের স্তর৷ সমুদ্রের নোনা জলে মিশে জলস্তর বাড়িয়ে তা বয়ে আসছে উপকূলে৷ সুনামি আয়লা আমফান নদীবেষ্টিত সুন্দরবনের ভূমিতে৷ সামনে নদীর জলরাশি তবুও ব্যবহারযোগ্য সুপেয় জলের অভাব৷ মানুষের জীবনে এ এক অভিশাপের মতো৷
রাজস্থানের কুন্দিয়া গ্রামের মেয়েরা হাঁড়ি মাথায় জল আনতে যায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে৷ আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে মেয়েদের এই পথচলা এখনও থামেনি৷ জীবন বিন্যাসে জলই প্রথম ও প্রধান উপকরণ৷ জলেই ভাসমান প্রাণের উদ্ভব৷ প্রার্থণাহীনভাবে পাওয়া প্রকৃতির এই সম্পদের গুরুত্ব আমরা তেমন অনুভব করতে পারি না৷ যখন প্রকৃতির প্রাণসুধারস ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে তখনও মানুষ অসচেতন থাকবে কেন৷ একদিন হয়ত এমনও দিন আসবে যে দিন উষ্ণায়নে ভূপৃষ্ঠের জলভাণ্ডার আরও ফুরিয়ে যাবে৷ প্রসারিত সমুদ্রের লবণাক্ত জল ভাসিয়ে দেবে আমাদের জনপদকে৷