• facebook
  • twitter
Tuesday, 22 April, 2025

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

গোড়ায় গলদ

প্রতীকী চিত্র

কুমারেশ চক্রবর্তী

এক লক্ষ ৫৪ হাজার ৯৩৮। পৃথিবীর প্রায় এক ডজন রাষ্ট্রের জনসংখ্যা এর কাছাকাছি কিংবা এর থেকে কম। অথচ ভারতে প্রাচীনতম হাইকোর্ট কলকাতা হাইকোর্টের শুধুমাত্র দেওয়ানি মামলা জমে আছে তা হল, এক লক্ষ ৫৪ হাজার ৯৩৮। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ফৌজদারী মামলা যার সংখ্যা ২৮,৩৩১ এবং original jurisdiction অর্থাৎ মূল এলাকার মামলা মানে মূলত যার সঙ্গে সংবিধানের জটিল প্রশ্ন জড়িত সেই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা জমে থাকার সংখ্যা ১৭,১৩১।

ভারতে অনেকের কাছেই এটা নিতান্তই একটা সংখ্যা! বিশেষ করে ভারতীয় প্রশাসনের উচ্চপদে যারা আছেন তাদের কাছে। অথচ ভারতের কোটি কোটি মানুষের কাছে এটা অত্যন্ত যন্ত্রণা, বেদনা এবং চোখের জলের ব্যাপার। কারণ অনেক চাওয়া পাওয়া, অনেক অবিচার অনেক অত্যাচার এই সংখ্যাগুলির সঙ্গে মিশে আছে। তারা বছরের পর বছর বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন, কবে সুবিচার পাবেন, কবে তাদের উপর থেকে এই নির্যাতনের মেঘ কেটে যাবে, ভেঙে যাওয়া চালে নতুন করে চাল তৈরি হবে। কিন্তু তাদের কথা কে ভাবে?কে খবর রাখে তাদের? এদের প্রয়োজন হয় তো শুধুমাত্র ভোটের সময়। ভোট এলে এদের দুয়ারে চলে আসে সরকার। ভোট এলে এদের কাছে হাজির হন তাঁবড় তাবড় নেতা মন্ত্রী। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। অথচ সারা বছর এদের খবর কেউ নেয় না, এদের পাশে কেউ থাকেনা, এদের দুঃখ যন্ত্রণার কেউ অংশ নেয় না। কিম্বা এদের দাবি-দাওয়া অভাব অভিযোগ মেটাবার চেষ্টা করে না। হ্যাঁ অবশ্যই প্রতিশ্রুতি দেন তারা। ঝুড়িঝুড়ি প্রতিশ্রুতি। একেবারে স্বপ্নের নীড় তৈরি করার স্বপ্ন দেখান এই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা, কখনো কখনো হাতে নগদ টাকা ধরিয়ে দেন। এর বেশি কিছু নয়, কারণ এরা হচ্ছে সাধারণ মানুষ । তাও আবার গরীব মানুষ।

আসলে তো গোড়ায় গলদ। আমরা গাছ না পুতেই ফল আশা করছি, ফুল আশা করছি, এটা তো অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বাস্তব সত্য এই কল্পনার দ্বারা কখনোই ঢেকে দেয়া যায় না। বড়জোর কলঙ্কিত করা যায়, সেই কারণেই সারা ভারত জুড়ে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আদালতে বিচার হবে কি করে? বিচারকই তো নেই, নেই মানে বিচারকের সংখ্যা কম। সারা ভারত জুড়ে প্রচুর বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টে এই মুহূর্তে ২৯ জন বিচারকের পদ শূন্য। সার্বিকভাবে কলকাতা হাইকোর্টের ৪০ শতাংশ বিচারকের পদ খালিপরে আছে। মোট চল্লিশ শতাংশ বিচারকের পদ শূণ্য। কি করে বিচার সম্পন্ন হবে? বিচারক হীন আদালতে তো আর বিচার কার্য সম্পন্ন হতে পারে না! তাই লক্ষ লক্ষ মামলা জমা পড়ে থাকছে। এই মুহূর্তে সারা ভারতে ৩৩ শতাংশ বিচারকের পদ ফাঁকা রয়েছে। এখানে শুধু হাইকোর্টের বিচারকের কথাই বলা হচ্ছে। একটি সরকার অনুমোদিত সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতের প্রাচীন হাইকোর্টগুলিতেই প্রচুর সংখ্যায় বিচারকের পদ ফাঁকা রয়েছে। আমি ভারতের প্রধান প্রধান ছয়টি হাইকোর্টের সংখ্যা উল্লেখ করছি, যেমন এলাহাবাদ হাইকোর্টে অনুমোদিত মোট বিচারপতি পদের সংখ্যা ১৬০ জন, বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ৮০ জন অর্থাৎ শূন্য পদের সংখ্যা ৮০, মানে ৫০ শতাংশ পদ ফাঁকা। বোম্বে হাইকোর্ট, এখানে অনুমোদিত বিচারপতির সংখ্যা ৯৪, বর্তমানে আছেন ৬৭ জন, মানে ২৭ টি বিচারকের পদ শুন্য রয়েছে, শতাংশের হিসেবে ২৮ শতাংশ। দিল্লি হাইকোর্ট, মোট বিচারপতি থাকা দরকার ৬০ জন আছেন ৩৫ জন। অর্থাৎ ২৫ বিচারপতির পদ ফাঁকা রয়েছে, শতাংশ হিসেবে একচল্লিশ শতাংশ। মাদ্রাজ হাইকোর্ট, সরকার অনুমোদিত বিচারপতি পদের সংখ্যা ৫৬, বর্তমানে রয়েছেন ৩৭ জন, অর্থাৎ মাদ্রাজ হাইকোর্টের পদ ফাঁকা রয়েছে শতাংশ হিসেবে ৩৪। এবার আসি কলকাতা হাইকোর্টের প্রসঙ্গে। কলকাতা হাইকোর্টে অনুমোদিত বিচারপতির সংখ্যা ৭২, বর্তমানে রয়েছেন ৪৩ জন বিচারপতি। দেখা যাচ্ছে কলকাতা হাইকোর্টে ২৯ বিচারপতির পদ শূণ্য। শতাংশের হিসেবের ৪০ শতাংশ বিচারপতি কম। সারা ভারতবর্ষে শূন্য পদের হিসেবে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে কলকাতা। সবচেয়ে বেশি পদ শূণ্য রয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্টে। সেখানে ৫০ শতাংশ বিচারপতির পদ শূণ্য ।তারপরে দিল্লি এবং কলকাতা। উভয়ের মধ্যে মাত্র এক সংখ্যার পার্থক্য। দিল্লিতে একচল্লিশ শতাংশ আর কলকাতায় ৪০ শতাংশ বিচারপতির আসন শূন্য রয়েছে।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? কেন সমস্ত ভারত জুড়ে এত বিপুলসংখ্যক বিচারপতির পথ শূণ্য? কেন বিশেষ করে হাইকোর্ট গুলিতে! এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আইনজীবীদের একটা বড় অংশ দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে । তাদের মতে রাজনৈতিক কারণে কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি নিয়োগ করছেন না। কলকাতা বার অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য হল, পূর্বে হাইকোর্টের প্রবীণ যোগ্য আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারপতি নিয়োগের প্রথা ছিল। অ্যাডভোকেটদের মধ্যে থেকে বাছাই করা নাম প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হতো, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের মাধ্যমে যেত কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকে। ভারতের প্রধান বিচারপতি সুপারিশ অনুসারে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক বিভিন্ন হাইকোর্টে বিচারপতির নিয়োগ করত। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে এই পদ্ধতি বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে শুধু কলকাতা নয় সারা দেশেই সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের অভিজ্ঞ যোগ্য ও প্রবীণ আইনজীবীদের মধ্য থেকেই হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হতো। এতে বিচারক সংক্রান্ত সমস্যা অনেকটাই সমাধান হতো। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি অনুসারে এই পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন দেশের বৃহত্তম আইনজীবীদের সংগঠন। সেই সংগঠন থেকে সরাসরি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনার অভিযোগ তোলা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, প্রধান বিচারপতির চেষ্টা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না।তাই কলকাতা হাইকোর্টের ২৯ জন বিচারকের আসন আজ শূন্য রয়েছে। ফলে কলকাতায় মামলা জমে পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। এই হাইকোর্টে শুধুমাত্র দেওয়ানি মামলায় জমে আছে এক লক্ষ ৫৪ হাজার ৯৩৮! এই অবস্থায় একটি রাজ্য বা দেশ সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ।

অবশ্য কলকাতা হাইকোর্টের মামলা জমে থাকার সমস্যা, নতুন নয় আগেও বিচারকের পদ ফাঁকা থেকেছে, যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ করা হয়নি এবং হাজার হাজার মামলা জমে গেছে। ২০১৬ সালে এই অবস্থা এমন আকার ধারণ করেছিল যে মামলাকারীদের অসুবিধার জন্য এক মাননীয় বিচারপতি রায়দান কালে মামলাকারীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন বিলম্বের জন্য। যদিও এ ব্যাপারে বিচারকরা দায়ী নন, দায়ী সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। তবুও বিষয়টিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই মাননীয় বিচারক মহাশয় এই ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এমনকি সেই মাননীয় বিচারপতি কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছিলেন। যা নিয়ে পরবর্তীকালে যথেষ্ট হইচই পড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন গণ দরখাস্ত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। তারা কলকাতা হাইকোর্টের শূণ্য পদে বিচারপতি নিয়োগের দাবি করেছেন, একই সঙ্গে তারা হাইকোর্টের যোগ্য প্রবীণ বিচারপতিদের থেকে বিচারপতি নিয়োগের যে পদ্ধতি ছিল তা পুনরায় চালু করার দাবি ও অনুরোধ জানিয়েছেন।

রাজ্যের একটি হাইকোর্টে কত বিচারপতি থাকবে অর্থাৎ অনুমোদিত বিচারপতি সংখ্যা ঠিক করার জন্য একটি পদ্ধতি আছে। মূলত তা স্থানীয় জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে। ইন্ডিয়ান ল কমিশন প্রায় প্রতি বছরই একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। ল কমিশনের ১২০ তম রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১ লক্ষ নাগরিকের জন্য হাইকোর্টে ৫০ জন বিচারপতি থাকা উচিত। যদিও কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক লোকসভায় যে রিপোর্ট পেশ করেছেন সেটা ভিন্ন। তারা এক পরিসংখ্যানে দাবী করেছেন যে, দেশে প্রতি এক লক্ষে ২১ জন করে বিচারপতি রয়েছে।

যদিও এই সংখ্যাটা সঠিক নয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের এক্তিয়ারে ১১ কোটি মানুষ রয়েছে। সেই অনুসারে কলকাতা হাইকোর্টে মোট বিচারপতির সংখ্যা আরো বেশি হওয়া উচিত। অথচ বাস্তব চিত্রটা কেন্দ্রীয় সরকার অন্যভাবে উপস্থিত করছেন। কলকাতা হাইকোর্টের বার কাউন্সিলের মতে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে একমাত্র আইনজীবীদের মধ্য থেকে কলিজিয়ামের মাধ্যমে নিয়োগ যদি আবার পুনরায় চালু করা হয়। প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখযোগ্য কলকাতা হাইকোর্টের বার কাউন্সিল আইনজীবীদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং সেই বার কাউন্সিলে সব ধরনের রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরাও থাকেন। তাই এই আবেদনকে সর্বদলীয় আবেদন বলা যেতে পারে। তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, বার কাউন্সিলে শাসক দলের প্রাধান্য সর্বদাই বেশি থাকে। কিন্তু তার জন্য বাংলাকে কেন বঞ্চিত করা হবে?

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং মাননীয় প্রধান বিচারপতি কলকাতা সহ বিভিন্ন হাইকোর্টগুলির এই সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং তাঁরা বারবার খুব আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করছেন শুন্যপদ পূরণের জন্য। কিন্তু জানা গেছে যে, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম হাইকোর্টগুলির বিচারপতি নিয়োগের জন্য বহু নাম সুপারিশ করলেও কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক এখনও কোন সাড়া দেয়নি। অর্থাৎ সমস্ত প্রক্রিয়াটাই ঝুলে রয়েছে। অবাক কান্ড! আইনজীবীদের এক অংশের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার কি ভয় পাচ্ছেন, বিভিন্ন মামলার রায় সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবে? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় সরকার এখন বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন?

News Hub