আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সারা বিশ্ব

আমেরিকার নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম ও কমলা হ্যারিস। ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

আমেরিকায় নির্বাচনের আর বাকি মাত্র কয়েকদিন। তার সর্বশেষ জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট ঘিরে হইচই। রয়টার্স-ইপসোস প্রকাশিত ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, শেষ মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন কমলা হ্যারিস, তাও মাত্র এক শতাংশের ব্যবধানে!আগামী ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প না কমলা হ্যারিস— হোয়াইট হাইসের বাসিন্দা কে হবেন? তা নিয়ে চলছে জল্পনা।
এত দিন পর্যন্ত অধিকাংশ জনমত সমীক্ষায় রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলার চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু ভোটের দেড় সপ্তাহ আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত জনমত সমীক্ষায় এগিয়ে যান ট্রাম্প। নতুন আর এক সমীক্ষায় ফের এগিয়ে গেলেন কমলা। সদ্য প্রকাশিত রয়টার্স-ইপসোস জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকার ৪৩ শতাংশ ভোটদাতার প্রেসিডেন্ট পদে পছন্দ হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন বাসিন্দা ট্রাম্পকে। অন্য দিকে, বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার প্রতি সমর্থন রয়েছে ৪৪ শতাংশ ভোটারের। বাকি ১৩ শতাংশ ভোট লিবারেটরিয়ান পার্টি, গ্রিন পার্টি-সহ বিভিন্ন দল এবং নির্দল প্রার্থীদের পক্ষে গিয়েছে।গত ২১ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১,১৫০ জন ভোটারকে নিয়ে জনমত সমীক্ষাটি চালিয়েছিল রয়টার্স-ইপসোস। সেই সমীক্ষাতে দেখা যায়, অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভোটারদের পছন্দ প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকেই। অভিবাসন-সমস্যা রুখতেও ট্রাম্পকে বেছেছেন ভোটারেরা। অন্য দিকে, দেশে চরমপন্থী রাজনীতির প্রসার রুখতে কমলার উপর ভরসা রয়েছে ভোটারদের।

এর আগে রয়টার্স-ইপসোসের গত ১৬ থেকে ২১ অক্টোবরের সমীক্ষাতেও এগিয়ে ছিলেন কমলা। সেখানে অবশ্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ফারাক ছিল মাত্র ২ শতাংশ ভোটের। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে ইমারসন কলেজ এবং এবিসি নিউজ়, সিবিএস নিউজ় প্রকাশিত রিপোর্টেও এগিয়ে ছিলেন কমলা। তবে ভোটের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, ততই কমছে ব্যবধান! শেষবেলায় প্রায় সব সমীক্ষারই রিপোর্ট বলছে, দু’জনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে।প্রসঙ্গত, গত রবিবার থেকে আমেরিকায় শুরু হয়ে গিয়েছে আগাম ভোটপর্ব। সেখানে ইতিমধ্যেই সে দেশের প্রায় তিন কোটি ২৫ লক্ষ ভোটদাতা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের আগেই আমেরিকার ৪০টি প্রদেশে শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যালট সংগ্রহ করে আগাম ভোটদানের পালা। সেখানে রবিবার প্রথম দিনেই ভোট দিয়েছেন আমেরিকার প্রায় এক কোটি ৪০ লক্ষ নাগরিক। প্রসঙ্গত, আমেরিকার ৫০টি প্রদেশের প্রতিটিতেই নিজস্ব ভোটিং পদ্ধতি রয়েছে। পোস্টের মাধ্যমে ব্যালট সংগ্রহ এবং পোলিং স্টেশনে সশরীরে গিয়ে আগাম নির্বাচনের দিন ভোটদানের ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন প্রদেশে। কোনও কোনও প্রদেশে আবার এক সঙ্গে তিনটি পদ্ধতিই প্রচলিত। অতিমারিকে হারালেও সমাজ যেন আজ আরও অসুস্থ। দাবানলের মতো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে বহু দেশ। স্বৈরাচারী শাসকদের থাবা দেশের সীমা অতিক্রম করে রক্তাক্ত আঁচড় কাটছে অন্য দেশে। ঠিক এই সময়ে আমেরিকার নির্বাচন যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।


গত কয়েক বছরে পৃথিবীর অনেক দেশের নির্বাচনেই ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর’ কাজ করেছে, ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মানুষ। অতিমারি ও যুদ্ধে জর্জরিত দেশের।মানুষ মূল্যবৃদ্ধি বা উদ্বাস্তু-সমস্যার দায় চাপিয়েছে ক্ষমতায় থাকা দলের উপরে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা-ভারাক্রান্ত মানুষ মানবতাবাদী উদারপন্থাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের দেশের উন্নতি চেয়েছেন। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিটি প্রচারসভায় বলছেন, ‘এই সরকার তোমাদের করের টাকা ইউক্রেনে, ইজ়রায়েলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।’ নিউ ইয়র্ক, বস্টনের রাস্তায় গৃহহীন মানুষেরা প্রশ্ন তুলছেন, ‘এই সরকার বহিরাগত শরণার্থীদের জন্য হোটেল ভাড়া করছে আর আমাদের ঠিকানা রাজপথ?’ তাঁরাই বলছেন, ‘ট্রাম্পকে ফেরত চাই।’

এই সব আগুনের ফুলকির সদ্ব্যবহার করছেন ট্রাম্প। তাঁর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত মামলা এখন ইতিহাস। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় এলে সবার উন্নতি হবে। কিন্তু এর বিপরীত স্বরও কি নেই? অবশ্যই আছে। দেশের নারীশক্তি জোট বেঁধেছে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে। তিনি প্রার্থী হতে রাজি হয়েই একটি অনলাইন বৈঠক করে অনুদান সংগ্রহের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন। গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব‍্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা চান দেশের মহিলারা, যা কনজ়ারভেটিভেরা মেনে নিতে পারছেন না। মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উঠে আসা কমলা বলছেন যে মূলধনের ওপর যে মাত্রাতিরিক্ত লাভ বা ‘ক্যাপিটাল গেন’ হবে, তার উপরে আয়কর বসবে, মধ্যবিত্তের আয়কর কমবে। এই ধরনের নীতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত শহরের মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমেরিকার গ্রামের মানুষেরা, যাঁরা অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ, আজও মনে করেন এ দেশটা তাঁদের।

কড়া অভিবাসন নীতি ও অন্য দেশকে সাহায্য করা বন্ধ হলেই তাঁদের উন্নতি হবে। তাঁরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাবতে পারেন একজন ‘শক্তিশালী’ পুরুষকেই।এই সামগ্রিক চিত্রের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটারেরা কোথায়?সমীক্ষা বলছে এঁদের মধ্যে ৬১% হ্যারিসের সমর্থক, ৩২% ট্রাম্পের। ভারতীয় সম্প্রদায়ের পারিবারিক গড় রোজগার বছরে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ডলার, যা এ দেশের সাধারণ মানুষের গড় আয়ের থেকে অনেকটাই বেশি। রোজগার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই রিপাবলিকান সমর্থকদের সংখ্যাও বেড়েছে। যদিও ভারতীয়দের প্রধান সমস্যা অভিবাসন, কিন্তু এ সমস্যা যাঁদের, তাঁরা ভোট দেন না। নাগরিক হয়ে তাঁরা যখন ভোটের অধিকার পান তখন অনেকেই এইচ১বি এবং গ্রিন কার্ডের জন্য সুদীর্ঘ অপেক্ষার কথা ভুলে যান। অধিকাংশ ভারতীয় মহিলাই অবশ্য হ্যারিসের সমর্থক। ভোটের ফলাফল যে ক’টি প্রদেশের উপরে নির্ভর করে মিশিগান তার মধ্যে অন্যতম, সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছেন ভারতীয়রা। বাইডেন-হ্যারিসের ইজ়রায়েল নীতিতে বিরক্ত অনেক মুসলিমই ঝুঁকছেন ট্রাম্পের দিকে। কিছু আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষ হাল্কা সুরে বলছেন, ট্রাম্প তাঁদের মতো, কারণ তিনিও গুলি খেয়েছেন। তবে অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গের মতে, ট্রাম্প নন, হ্যারিসই তাঁদের কথা ভাবছেন।

তরুণ ভোটারদের একাংশ উদারপন্থী হ্যারিসের পক্ষে, কিন্তু বর্তমান সরকারের ইজ়রায়েল নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা বিরক্ত হয়ে একটি তৃতীয় দল, গ্রিন পার্টিকে সমর্থন করতে চাইছেন। শিক্ষিত মানুষরা উদারনীতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হলেও অনেকেই বলছেন, মিশিগানে ফলের চাবিকাঠি গ্রামের শ্বেতাঙ্গ মানুষের হাতে। সত্যিকারের চাবিকাঠি কি এ বার বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সুচেতনাদের হাতেই? উদারপন্থী নারীদের ভোটই কি শেষ পর্যন্ত হ্যারিসকে এগিয়ে দেবে?