সুবীর পাল
সাম্প্রতিক অশনি সংকেতের সুচনাটা হয়েছিল বাঘাযতীনে। এরপর সংক্রামক সিঁদুরে মেঘ ক্রমশঃ ছড়িয়েছে কখনও ট্যাংরায় তো কখনও মুকুন্দপুরে। আবার কসবার অট্টালিকা ছুঁয়ে বাগুইআটির স্কাই লাইন পেড়িয়ে বেলঘরিয়া, তপসিয়া সহ কলকাতা মহানগরীর নানা অলিগলির অশ্রুসজল আবাসিকেরা যে এখন দিশেহারা। তাঁদের একটাই অস্ফূট আর্তনাদ, ‘এইরে বহুতলগুলো তো হেলে গিয়েছে।’
সুতরাং সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সঙ্গত কারণেই কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধেই সৃষ্টি হয়েছে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে মেয়র ববি হাকিমের ঘোষণা, ‘বহুতল হেলে যাওয়া নিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়েছি। বিল্ডিং হেলে পড়লেই সেটা বিপজ্জনক এমন নয়। তাছাড়া বেআইনি ভাবে নির্মিত ফ্ল্যাট ক্রয়বিক্রয় ক্ষেত্রে দুইপক্ষ সমান দোষী।’ তথাপি জনসাধারণের অভিযোগের ফর্দ কিন্তু এযাবৎ যথেষ্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। অনেকে দূষছেন এই রাজ্যের পূর্বতন সরকারের আমলের বিরুদ্ধে। আবার বর্তমান বাংলার প্রশাসককেও কেউ কেউ কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। যদিও ক্ষুব্ধ জনতার চড়া নালিশের তীক্ষ্ণ নিশানার কেন্দ্রস্থল কিন্তু অবিচল ভাবে এক। তা হলো কলকাতা পুরসভা। সেখানে এ শাসক কি সে শাসক, এসবের মধ্যে কেউ ফারাক দেখতে চাইছেন না। তাঁদের একটাই সাফ বক্তব্য, ‘কলকাতার মতো একটা ঐতিহ্যমন্ডিত শহরে হেলে যাওয়া বহুতলগুলির সিংহভাগই যথাযথ নিয়ম মেনে নির্মিত হয়নি। এমনকি নির্মিত ক্ষতিগ্রস্ত ইমারতগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৫% ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারেরা মান্যতা পর্যন্ত দেননি অনুমোদিত প্ল্যানের ছাড়পত্রকে। অথচ কলকাতা পুরসভার উপস্থিতিতে অভিযুক্ত প্রোমোটারেরা এসব বছরের পর বছর ধরে কোন যাদুতে গড়ে তুলতে পারলো?’
আর ক্ষতিগ্রস্থ বহুতলের বাসিন্দাদের অবস্থা এই পরিস্থিতিতে, অনেকটা চক্রবূহ্যে ফেঁসে যাওয়া অভিমন্যু সম। অধিকাংশই জীবনের সর্বশেষ সঞ্চয় তথাকথিত প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়ে এমনতর মারণগৃহে ঢুকেছেন তো বাছাধন ঠিকই। মাথা গোঁজা ছাদের বাসনায়। কিন্তু পরিত্রাণের নির্গমন পর্বে তো অসহায়তার গোলকধাঁধা এখন অতি প্রকট। জীবনের জাঁতাকলে তাই তাঁরা আজ, ন যযৌ ন তস্থৌ। এযেন প্রোমোটারের টাকা কামানোর গবেষণাগারে কংক্রিটের খাঁচায় ঢোকানো হয়েছে একগাদা বাসিন্দা রূপী গিনিপিগকে।
আসলে কলকাতা জুড়ে চায়ের ঠেকে, সাংবাদিকের আড্ডায়, টিনএজারের ট্রিটে এখন একটাই আলোচনার বা সমালোচনার হটকেক, কলকাতায় বহুতলের ঢলে পড়ার টাটকা কাহানী। তবে সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুসারে, কলকাতা পুরসভার তরফে যতটা সম্ভব এহেন বেহাল নিমার্ণগুলোর ভারসাম্য ঠিকঠাক করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়র (এসওপি) সিস্টেম প্রয়োগ করার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে।
তবুও একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে মনে উঁকি দেয়, এমন ঘটনার প্রেক্ষাপট কি শুধুই এই তিলোত্তমা নগরীতেই? ভুল ভুল বস্ ভুল ভুল। স্রেফ তাৎক্ষণিক আবেগ বশতঃ যত দোষ নন্দ ঘোষের দিকে শুধু আঙ্গুল তুলে কি লাভ? যেখানে ভারতের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে এই হেলানো ভবণ ব্যাধি একেবারে সংক্রামকের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় যত্রতত্র। দৃষ্টান্তের কথা বলতে গেলে রুপোলি নগর মুম্বাই শহরই বা বাদ যায় কেন? সেখানকার ডিক্সন বিল্ডিং তৈরি হয়েছিল ১৮৮০ সালে। সেটিও কিন্তু বিপজ্জনক ভাবে টলে পড়েছিল। একই পথের পথিক ওই শহরেরই চিত্রা ভবণ। পুনের হেলিং ভবণ সহ এলাহাবাদের উচ্চ ন্যায়ালয় ভবণও তো একই সমস্যার শিকার। অন্ধ্রপ্রদেশের কোল্লাপুর মসজিদ, তামিলনাড়ুর নাজিরা মিনার, পাটনার সাহেবগঞ্জ মিনার, ঝাড়খন্ডের হোস্টিং মিনার, ওড়িশার তাজপুর মন্দির, রাজস্থানের ঘাটিয়া মিনার প্রমূখ সবই তো হেলানো কংক্রিট রোগের লম্বা তালিকায় বহুল প্রখ্যাত। এমনকি চেন্নাই, মুম্বাই, দিল্লিতে অজস্র বহুতলের হেলে পড়ার নজির জনসমক্ষে আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
এমনকি ভারত ছাড়াও তাতাম বিশ্বজুড়ে এমন বহুতলের ঢলে যাওয়ার ঘটনা কিম্বা বিশাল ভবণের স্থানান্তরের দৃষ্টান্ত রয়েছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি। আবার কিছু হেলে যাওয়া ভবণকে বিপদমুক্ত করে তোলার নিদর্শনও এই পৃথিবীতে রয়েছে পর্যাপ্ত হারে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে ঐতিহাসিক বহুতল পিসা টাওয়ার হেলে পড়ার জন্য আজও বিশ্বখ্যাত। ১১৭৩ সালে এই ৮ তলা বিশিষ্ট গীর্জার ঘন্টাঘরটি নির্মাণ হলেও ক্রমেই তা হেলতে শুরু করে। ইতালির এই শ্বেত পাথরের তৈরি টাওয়ারটি ১৯৯০ সালে ৪.৯৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ঢলে গিয়েছিল। এরপর ইস্পাতের রড ও বেশকিছু সেতুর মাধ্যমে এর সংস্কার কাজ শুরুর পাশাপাশি মাটির তলদেশে থাকা জমা জল নিষ্কাশন করে সেখানে কংক্রিটের ঢালাইয়ে ভরাট করা হয়। ফলস্বরূপ ২০০১ সালে ৪ ডিগ্রি হেলানো রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১০ সালে নানাবিধ পরীক্ষার পর ঘোষণা হয়, ৫৭ মিটার উচ্চতার সেন্ট মারিয়া অ্যাসুনটা ক্যাথিড্রাল অধীনস্থ পিসা টাওয়ারটি বর্তমানে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত।
একই দেশের বেলোনিয়া শহরাঞ্চলে আরও দু’টি বহুতল ইমারতের ঢলে যাওয়ার ঘটনাবলী বিশ্ববাসীর কাছে রীতিমতো চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। মধ্যযুগীয় সময়কালে তৈরি গ্যারিসেন্ডা টাওয়ারটির প্রথমাবস্থায় উচ্চতা ছিল ৯৭ মিটার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমানে এর উচ্চতা কমে দাঁড়ায় ৪৮ মিটার। আবার গ্যারিসেন্ডা টাওয়ারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাসিনেল্লি টাওয়ার। ১১ শো শতাব্দীতে যা গঠন করা হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার এটাই, এই দুটি বিশালাকার ভবণই ছিল আঞ্চলিক পর্যায়ের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কর্মক্ষেত্র। এই জোড়া বহুতল যথাক্রমে হেলে যায় ১.৩ ডিগ্রি এবং ৪ ডিগ্রি পরিমাপে।
আরও এক ঐতিহাসিক ভবণের কথা স্মরণ করলে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বেল এর প্রসঙ্গও সারা বিশ্বকে চমকে দেয়। ১৯৩০ সালে ২২ তলার এই বাণিজ্যিক ভবণটি তৈরি করা হয়। ৯৯.৫ মিটার উচ্চতার এই ভবণটি ছিল ইন্ডিয়ানা বেল টেলিফোন কোম্পানির সদর দফতর। আলোচ্য বিষয় হলো জায়গার সংকুলান মেটাতে ১৯৮৭ সালে পুরো বিল্ডিংটির স্থানান্তর ঘটানো হয় ভবণটিকে অক্ষত অবস্থায়। এই বিল্ডিংয়ের প্রতিটি পিলারের নিচে হাইড্রোলিক জ্যাক ও স্লাইডিং সিস্টেম প্রয়োগ করে ৫২ ফুট স্থানান্তর ঘটানো হয়। জনা ৬০০ কর্মী বিশিষ্ট এই স্থানান্তকরণ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্ট্র্যামব্লিন প্রজেক্ট।’ পরিপূর্ণ নিরাপদে এই বহুতলটির স্থানান্তর করতে সময় লেগেছিল ৩৪ দিন। এক লক্ষ কেজি ওজন সম্পন্ন ইন্ডিয়ানা বেলের ৯০ ডিগ্রি কোন ঘুরিয়ে জায়গা পরিবর্তন করতে প্রতি ঘন্টায় ১৫ ইঞ্চি দূরত্বে সরানোর কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র লাল ফৌজের দেশের শানসি প্রদেশে ৯৩৪ সালে হুঝহু প্যাগোডাটি নির্মিত হয়েছিল বৌদ্ধদের উপাসনালয় হিসেবে। এটি পৃথিবীর এক উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্য সমৃদ্ধ স্থাপত্য। অথচ ১৬ শো শতাব্দীতে এটি ঢলতে শুরু করে আলগা মাটির কারণে। কালক্রমে ৬.৫২ ডিগ্রি হেলে গেলেও এটিকে সোজা করা এখনও সম্ভব হয়নি। তবে সেটি যাতে এইরকম হেলানো অবস্থাতেও নিরাপদ থাকে তারজন্য প্রকৌশলগত কিছু অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
চীনের ঝিংচেন শহরে কাছে অবস্থিত রয়েছে আরও একটি প্যাগোডা। বৌদ্ধদের এই ধর্মীয় স্থলের নাম ইউনইয়াং প্যাগোডা। ৯ তলা বিশিষ্ট এই প্যাগোডার গাত্র শৈলী ঐতিহ্যগত ভাবে দর্শনার্থীদের কাছে আজও সমাদৃত। ১৯০০ বছরের পুরনো এই প্যাগোডাটি একসময়ে ৩ ডিগ্রি হেলে গেলে স্থানীয় স্তরে এর পরিবর্তিত নাম হয়ে ওঠে ‘হেলে থাকা প্যাগোডা।’ অবশ্য ১৯৯০ সালে চীন সরকার এর সংস্কার কাজ শুরু করলে প্যাগোডাটি পূর্বাবস্থার ভারসাম্যে ফিরে আসে সফল ভাবে।
১৩ শো শতকে জার্মানির উত্তরাঞ্চলে স্যুট্রাল্যান্ডে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত সুরহুসেন চার্চ। এটি টিল্টেড চার্চ হিসেবেও সুপরিচিত। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নিপুণ স্থাপত্যের কারুকার্য সমগ্র বিশ্বের ভ্রমণকারীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। অথচ ভিতের তলার মাটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার কারণে ভবণটি বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়েছে। ৫.১৯ ডিগ্রি পর্যন্ত হেলে গেলে ১৯৭০ সালে এটির মেরামত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বেশ কয়েক বছরের লাগাতার প্রচেষ্টায় কিছুটা হলেও ঢলা অংশ ঠিক করা সম্ভব হয়।
জার্মানির থুরিঙ্গিয়া অঞ্চলের অন্য একটি চার্চও হেলে গিয়েছে পিসা টাওয়ারের অনেকটা অনুকরণে। আনুমানিক ৫০০ বছরের পুরনো চার্চটির নাম ব্যাড ফ্র্যাঙ্কেনহুসেন চার্চ টাওয়ার। এটি আচমকা হেলে যেতে শুরু করে ১৭৪০ সালে। সর্বশেষ ৪.৮ ডিগ্রি কোনে হেলে গিয়েছিল। জার্মানির এটি একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। মজার ঘটনা এটাই, ২০০০ সালে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এটির পরিপূর্ণ ভারসাম্য স্থিতিশীল করা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া ব্রিটেন সহ রাশিয়াতেও পৃথিবীর নামজাদা ইমারতের হেলে যাওয়ার পটভূমি বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে।
উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনস্টার এলাকায় রয়েছে বিগ বেন বা এলিজাবেথ টাওয়ার। আদতে এটি একটি দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ঘন্টাঘর যা ব্রিটিশদের গর্বের প্রতীকও। মহান স্থপতি অগাস্টাস পুগিন এর নান্দনিক দেওয়াল শৈলীর রূপ দেন। ১৮৫৯ সালে নির্মিত হলেও পরবর্তীতে এটি টলে পড়ে ০.২৪ ডিগ্রি অবস্থানে। আবার রাশিয়ার দিকে নজর ঘোরালে হেলানো নেভিয়ানস্ক টাওয়ারের কথা অবশ্যই মনে আসবে। এটি সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত অত্যাধুনিক এক বিখ্যাত আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল। এটিও ভূতাত্ত্বিক ত্রুটির কারণে হেলে যায় ৩ ডিগ্রি। এহেন হেলে যাওয়ার কারণে একসময় রাশিয়া জুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। পর্যাপ্ত সংরক্ষণের কারণে বর্তমানে এটি এক নিরাপদ ভবণ বলেই জানা গিয়েছে।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘সব পাখি মাছ খায়, দোষ হয় মাছরাঙার।’ হায়রে বেচারা তিলোত্তমা নগরী!