কুরুক্ষেত্রের করাল গ্রাসে বৃদ্ধতন্ত্রের চাকা

ফাইল চিত্র

তন্ময় সিংহ

ঝিলামের তীরে রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন সফল হলেও, কুরুক্ষেত্রে দিতে হল সিদ্ধান্তহীনতার খেসারত ও ঘোষিত হলো বৃদ্ধ­তন্ত্রের পরাজয়। বিপক্ষের প্রধান স্ট্রাইকার যেখানে মাঠ ছেড়ে দিয়েছে, শুধুমাত্র দলের খেলোয়াড়রা আশা ছাড়েনি সেখানে কিভাবে চ্যাম্পিয়ন দল নিজেদের জেতা ম্যাচ মাঠে ফেলে দিয়ে আসতে পারে তার উদাহরণ হয়ে রইল হরিয়ানার ফলাফল। নবরাত্রি চলাকালীন সারা দেশেই রক্তাল্পতায় ভোগা প্রধান দল বিজেপিকে অক্সিজেন দেবে হরিয়ানা। লোকসভা ভোটের পরে যে সমস্ত বিধানসভার ফলাফল আগের থেকেই ঠিক হয়ে গেছিল বলে মনে হচ্ছিল এবং রাজনৈতিক পণ্ডিতরা ঘোষণা করে দিয়েছিল তার একটি হল হরিয়ানা। জেতা ম্যাচ সাথে সারা ভারতের আবেগ নিয়ে হরিয়ানার বেটি, ভিনেশ ফোগট কংগ্রেসের যোগদান করায় মনে করা হয়েছিল “ডান ডীল” ।

প্রত্যাশা মতই এবারও মানুষের মনোভাব প্রতিফলনে ব্যর্থ বিভিন্ন অপিনিয়ন পোল ও এক্সিট পোল। বিজেপি নিজস্ব ম্যানেজারদের সার্ভে ও হরিয়ানার ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় আশা করায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাত্র চার বার হরিয়ানা বিধানসভায় প্রচার করতে এসেছেন দিল্লির উপকণ্ঠে হলেও। তবে আজকে জয়ের কৃতিত্ব বিজেপির নতুন প্রজন্মের নেতা ধর্মেন্দ্র প্রধান অন্যান্যদের মধ্যে বেশি পাচ্ছেন তার বুথ ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটির জন্য। মুখ্যমন্ত্রী খট্টরকে ময়দান থেকে সরিয়ে এবারের ভোটের ময়দানে সম্পন্ন অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া বিজেপির পক্ষে কাজ করেছে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী ন্যায়াব সিং সাইনির মেয়েদের জন্য “লাডলী বহেনা” জাতীয় স্কিম বিজেপির মরা গাঙে জোয়ার এনেছে। ভারতে চলতে থাকা সমস্ত বিধানসভার ভোটের ফলেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের শুরু হওয়া মহিলাদের সরাসরি একাউন্টে টাকা দেওয়ার এই স্কীমটি মধ্যপ্রদেশ হরিয়ানা সহ অন্যান্য রাজ্যে ক্লিন সুইপ করতে সাহায্য করছে শাসক কে।


অন্যদিকে কংগ্রেসের মধ্যে আমরা দেখি প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত হীনতায় ভোগা এবং বৃদ্ধ তন্ত্রের চাপ। দলের দুই প্রধান মুখ কে হবে মুখ্যমন্ত্রী সেই আশায় নির্বাচনের মাঝেও ভূপিন্দর সিং হুড্ডা ও শৈলজা দেবী কুস্তি করেছে এবং অনেকটা কমলনাথের ধাঁচে একটা জেতা রাজ্যকে, প্রবল সরকার বিরোধীতা সত্বেও সাধারণ মানুষের রায়ের প্রতিফলন ভোট বাক্সে তাদের পক্ষে ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটের দিন এলাকা ছেড়ে শৈলজা দেবী বসে আছেন সোনিয়া গান্ধীর কাছে দিল্লি তে। লোকসভা ভোটের সংবিধান বাঁচানোর লড়াইয়ের ফলাফল পক্ষে গেলেও, এই “বাবু বেটা” পলিটিক্স এবং বৃদ্ধ তন্ত্র যে মানুষ আর প্রশ্রয় দেবেনা হরিয়ানার ফলাফল তার প্রতিফলন। জোট রাজনীতির ক্ষেত্রেও রাহুল গান্ধী বর্তমানে যথেষ্ট উদার মনোভাব দেখালেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রকৃত বিজেপি বিরোধীদের সাথে জোট করার। অনেক ক্ষেত্রে ছোট দলগুলোর দ্বিচারিতা এবং কংগ্রেসের সিদ্ধান্তহীনতায় জোট ভেস্তে যায় এবং ভোটের ময়দানে তার কু খারাপ প্রভাব পড়ে। এখন পর্যন্ত হরিয়ানার মোট ভোটের ৩৯.৯% বিজেপি এবং ৩৯. ১ শতাংশ কংগ্রেস পেয়েছে সেখানে আপ ২% ভোট অন্যান্য শাসক বিরোধী দল গুলির ভোট অনেক বিধানসভার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়ে কংগ্রেসের যাত্রা ভঙ্গ করেছে। বিশেষত আপের মতন রাজনৈতিক দলের সাথে পথ চলা আগামী দিনে কতটা সুগম হবে‌ ও আগামী দিল্লির নির্বাচনে জোট আদৌও সম্ভব কিনা,সে বিষয়ে কংগ্রেসকে এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সুস্পষ্ট নীতি তৈরি করা উচিত।

ভোট শুরুর আগে, কংগ্রেসের সুপ্রিম লিডার রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সাথে পাই হরিয়ানার কুস্তির প্রধান মুখ ও সদ্য অলিম্পিকে দেশের নাম উজ্জ্বল করে আসা ভিনেশ ফোগত ও বজরং পুনিয়া সহ একাধিক খেলোয়াড় কে। ভিনেশ ফোগত তার বিধানসভা টি পনের বছর পর উদ্ধার করেছেন কংগ্রেসের পক্ষে। সময়ের দাবিকে মেনে নিয়ে রাহুল গান্ধী যদি এই বৃদ্ধ তন্ত্রের বদলে নতুন মুখদের সামনে এগিয়ে দিতেন এবং হরিয়ানার বেটিকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিতেন ভোটের আগে, তাহলে আজ ভোটের ফলাফল অন্যরকম হতো। ভারতবর্ষের প্রাচীন দলটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আর কতদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে‌ সম্পূর্ণরূপে দলের চলে আসা সিস্টেমকে বদলে দেশের শাসক দল বিজেপির ধাঁচে নতুন ক্যাডার ভিত্তিক একটি দল তৈরি করবে। সামনেই মহারাষ্ট্র ভোট সেখানে যাতে এই সিদ্ধান্ত হীনতা রাজ্য জুড়ে চলতে থাকা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় বাধা না হয়ে যায় তার জন্য অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত কংগ্রেস হাই কমান্ডের। রাহুল গান্ধীর ও উচিত, দলের সভাপতি কে নিয়ে সরাসরি সমস্ত দলের সাংগঠনিক কাঠামো থেকে শুরু করে নতুন প্রজন্মকে সামনে এনে কংগ্রেসের সম্পূর্ণ গঠনগত সংস্কার ও ত্রুটিপূর্ণ জায়গা গুলো মজবুত করা।

এরই মাঝে জম্মুর উপরে ভর করে বিজেপির যে লড়াই কাশ্মীর দখলের ছিল তা জম্মু এলাকাতে সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে সাফল্য পায়নি। কাশ্মীরের মানুষ তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স এর সাথে ই থেকেছে। রাহুল গান্ধী জোটে থাকলেও এবং কাশ্মীরে তার বিভিন্ন সময় উপস্থিতি মানুষের মনে আশা সঞ্চার করলেও কাশ্মীরের রায়ের প্রতিফলন মূলত ওমর আব্দুল্লাহ ও ফারুক আব্দুল্লাহর প্রতি মানুষের আস্থা। পিডিপির মুফতি এই ভোটে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও তিনিও হয়তো এই বিজেপি বিরোধী জোটে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণ করে কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ও সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে ওমর আব্দুল্লাহর সাথী হবেন। অন্যদিকে জম্মুর ভোট এককাট্টা বিজেপির পক্ষে থাকায়, মানুষের হয়ে বিরোধী স্বর হিসেবে কথা বলবে বিজেপি। ডোড্ডা বিধানসভায় আম আদমি পার্টি সফলতা পাওয়ায় উপত্যকায় নতুন একটি রাজনৈতিক দলের সূচনা হল।

২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনের সাময়িক বিপর্যয়ের পর, যেভাবে বিজেপি কিছুটা ব্যাক ফুটে থেকে নীরবে কাজ করে এসেছে ও সাংগঠনিকভাবে তার ফাঁকফোকর গুলো মাঠে নেমে শোধরানোর চেষ্টা করেছে তারই ফলাফল, এই কুরুক্ষেত্রের মাটিতে সমস্ত ধরনের বিরোধী প্রভাব থাকা সত্ত্বেও টানা তৃতীয়বারের জন্য আরও বেশি সিট নিয়ে বিজেপি বিজয়ীর জয় টিকা লাভ করল। সব মিলিয়ে রাজনীতিগতভাবে বিজেপি, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ড ভোটের আগে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে নিল হরিয়ানার এই জয় থেকে। কংগ্রেসের মধ্যে “ইনটেন্ট টু কিল” মনোভাবের অভাব এবং সময়ের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তন না করে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও বৃদ্ধ তন্ত্র কে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা রাজনীতিতে কংগ্রেসের পুনরায় উত্থানের জন্য ক্ষতিকারক হতে যাচ্ছে তা বুঝিয়ে দিল হরিয়ানার ফল, সময় থাকতে থাকতে যদি বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের হাইকমান্ড তথা রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, যদি না বৃদ্ধতন্ত্রের ও সিদ্ধান্তহীনতার কোন দাওয়াই বার করতে না পারে তাহলে আগামীতেও ব্যাকফুটেই থাকবে কংগ্রেস।