• facebook
  • twitter
Wednesday, 9 April, 2025

ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা দখল চলছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই

ইসলামের ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন ঘটে ৮ম শতকে, যখন মুসলিম আরবরা সিন্ধু প্রদেশে প্রবেশ করে। ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠা এবং ঘুরি সাম্রাজ্যের পতন ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেয়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও শাসনের মাধ্যমে ইসলাম ভারতে আরও শক্তিশালী হয়।

প্রতীকী চিত্র

সুদর্শন নন্দী

ধর্ম নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে উন্মাদনা। সবাই ভাবে আমার ধর্ম বড়। আর ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা দখল যুগে যুগে চলে আসছে। কিন্তু সবার কাছে তো তা নয়। অনেকের কাছেই ধর্ম মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করে। এ কথা স্বামী বিবেকানন্দ বারবার বলেছেন। ঠাকুরও মুক্তকণ্ঠে বলতেন, সকল ধর্মে সত্য আছে। সকল ধর্মই সত্য l স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, ধর্মের মুখ্যরূপ জীবপ্রেম, মানুষের সেবা। তিনি সব ধর্মকেই ভালবাসতেন। বলতেন একজন হিন্দু আরও ভালো হিন্দু হোক, একজন মুসলমান আরও ভালো মুসাল্মান হোক, একজন খ্রিষ্টান আরও ভালো ভাল খ্রিষ্টান হোক। কিন্তু সব দেশেই শাসক দল ধর্মকে শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগান। ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা দখল, প্রশাসন চালানো সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই।
আসি ইতিহাসের পাতায়।

আমরা জানি, খ্রিস্টান ধর্মের উত্থান ও প্রসারের সময় রোমান সাম্রাজ্যের সাথে খ্রিস্টানদের সম্পর্ক ছিল জটিল, যেখানে শুরুতে রোমানরা খ্রিস্টানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছিল এবং তাদের নিপীড়নও করেছে, কিন্তু পরে খ্রিস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের সরকারি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টানদের নিপীড়ন সাম্রাজ্য-ব্যাপী না হয়ে বিক্ষিপ্ত এবং আঞ্চলিক-নির্দিষ্ট ছিল। রোমানরা খ্রিস্টানদের কিছু আচরণকে সন্দেহজনক ও অপরাধী মনে করত। খ্রিস্টধর্মের উত্থান রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

এবার প্রাক ইসলাম অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের আগের কথা বলি। প্রাক-ইসলামী আরব ছিল একটি যাযাবর সমাজ, যাদের বেশিরভাগই ছিল বিভিন্ন গোত্র ও উপজাতিতে বিভক্ত। এই বেদুইন উপজাতি অনেকে ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনধারা বজায় রেখেছে। ক্রমাগত যুদ্ধ এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলাই ছিল আরব সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

মহম্মদের (সাঃ) আবির্ভাবের আগে আরবদের ধর্ম ছিল মূলত বহু দেব-দেবী ও জিনের প্রতি বিশ্বাস, যা স্থানীয় আরব বহুদেববাদ নামে পরিচিত ছিল, এর সাথে কিছু ইহুদি, খ্রিস্টান এবং জরথুস্ট্রীয় ধর্মের প্রভাবও ছিল।

মক্কার কাবা সহ বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় মাজারগুলিতে দেব-দেবীর পূজা করা হতো।
ইহুদি, খ্রিস্টান এবং জরথুস্ট্রীয় ধর্মের কিছু প্রভাবও প্রাক-ইসলামিক আরবে দেখা যায়।
ইতিহাসে আরব জাতির সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ইসলাম ধর্ম। ধর্মকে হাতিয়ার করে একের পর এক দেশকে তারা দখল করেছিল। সত্যি বলতে কি, আরবের বুকে বসবাসরত বিচ্ছিন্ন ও বহু দল-উপদলে বিভক্ত গোত্রের মানুষদের একই ছাদের নিচে আনতে সক্ষম হয়েছে ইসলাম।

এবার যিশুখ্রিস্টের নিরিখে ইহুদিদের কথায় আসি। আসি আরববাসীর প্রভাবিত হওয়ার ঘটনায়।
যীশুর শৈশব সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। জানা যায় যে তিনি নাজারেথে বেড়ে ওঠেন, তিনি এবং তাঁর পরিবার রাজা হেরোদের তাড়না থেকে পালিয়ে মিশরে চলে যান এবং তাঁর “পার্থিব” পিতা, যোষেফ, একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। যীশু ইহুদি ধর্মে বেড়ে উঠেছিলেন এবং বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতে, তিনি ইহুদি ধর্ম সংস্কারের লক্ষ্য

প্রায় তিন বছর ধরে, যীশু ১২ জন নিযুক্ত শিষ্যের (যারা ১২ জন প্রেরিত নামেও পরিচিত) সাথে ভ্রমণ করেছিলেন, বিশাল সংখ্যক লোককে শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে খ্রিষ্টধর্ম আরবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ের মধ্যে পূর্ব আরবের সমস্ত দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলে তারা অসংখ্য গির্জা প্রতিষ্ঠা করে। পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাইজেন্টিয়ানরা শক্তিশালীভাবে দক্ষিণ আরবে খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু করে।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, ইথিওপিয়া, পারস্য এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে আরব ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল, যা আরবে খ্রিষ্টধর্ম প্রসারে সাহায্য করে।
আবার দেখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানিরা ইহুদিদের ওপর সংগঠিত গণহত্যা চালায় যা খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষের চরম উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত।

আসি ভারতবাসীদের ধর্ম নিয়ে। ভারতে মুসলিম শাসনের আগে, হিন্দুধর্ম মূলত বৈদিক যুগের ধর্ম (ব্রাহ্মণ্যধর্ম) নামে পরিচিত ছিল এবং ধীরে ধীরে এটি একটি ব্যাপক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিকশিত হয়েছে। হিন্দু শব্দটি সিন্ধু নদ থেকে উদ্ভূত, যা সিন্ধু নদীর পাশে বসবাসকারী লোকেদের বোঝাতে ব্যবহৃত হত ।

ইসলামের আগমনের পর, ভারতীয় ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতির উপর এর প্রভাব পড়ে। ইসলামের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সম্পর্ক জটিল ছিল, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে সংঘাতও দেখা গেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে সহাবস্থানও ছিল।

ইসলামের ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন ঘটে ৮ম শতকে, যখন মুসলিম আরবরা সিন্ধু প্রদেশে প্রবেশ করে। ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠা এবং ঘুরি সাম্রাজ্যের পতন ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেয়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও শাসনের মাধ্যমে ইসলাম ভারতে আরও শক্তিশালী হয় l

কিছু ক্ষেত্রে, হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়েছে, বিশেষ করে যখন তারা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত বা তাদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করত।
কিছু ক্ষেত্রে, মুসলিম সমাজে ধর্মান্তরিত হওয়াকে সহজ করে দেওয়া হত, এবং কিছু হিন্দু পরিবার তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করত।

অন্যদিকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালে ভারতে, কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এই ধর্মান্তরের কারণ ছিল ব্রিটিশ মিশনারি ও শিক্ষকের কার্যকলাপ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, এবং জাতিগত বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

ধর্ম নিয়ে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যে শাসন কায়েম চলে আসছিল আজও তা বজায় রয়েছে। তা ভারতের গণতন্ত্রে নির্বাচন জেতার জন্য হোক বা কট্টর মুসলিম দেশে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যই হোক।