মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ইজরায়েল-ইরান সংঘাত

প্রতিবারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে ‘অক্টোবর বিস্ময়’ বলে একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ জল্পনাকল্পনা হয়। এই ‘বিস্ময়’টা হলো হঠাৎ এমন কোনো ঘটনা, যা ভোটের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাচনী দৌড়ের হিসাব ওলট-পালট করে দিতে পারে। ইজরায়েল ও ইরান এখন সেই ‘বিস্ময়’ ঘটিয়েছে, যা থেকে ট্রাম্পই হয়তো সুবিধা পেয়ে যাবেন।কয়েক মাস ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হিজবুল্লাহর ওপর আঘাত না হানতে। গত মাসে ইজরায়েল আঘাত হানা শুরু করলে বাইডেন প্রশাসন ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যদের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে লেবাননে যুদ্ধবিরতির আহ্বান করেন। সেই আহ্বান উপেক্ষিত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বিভ্রান্তির সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহু সরকার তার ঘনিষ্ঠতম মিত্র ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দানকারীর আহ্বান, অনুরোধ বা ইচ্ছাকে ক্রমাগত উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে চলেছে। বাইডেন প্রশাসন গাজা ও লেবাননে সংযত হওয়ার জন্য ইজরায়েলকে আহ্বান করছে। পাশাপাশি সংঘাত বেড়ে গেলে ইরান ও অন্যান্য আঞ্চলিক শত্রুদের কাছ থেকে ইজরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতিমাত্রায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।ফলে ইজরায়েল সরকার এটা বুঝে গেছে যে বাইডেন প্রশাসনকে উপেক্ষা করায় তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। বরং ইরানের বিরুদ্ধে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে মাঠে টেনে আনা যায়, তাহলে লাভই লাভ।

যে কোনও সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে সমর্থন দেবে না— এমন আশঙ্কা সব সময়ই ক্ষীণ। আগামী দেড় মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এমন সময় তো তার প্রশ্নই ওঠে না। গাজা বিষয়ে নেতানিয়াহুকে কঠোর ভাষায় কথা বলার ভান করেছিলেন কমলা হ্যারিস। তবে এই বিপদের সময় তিনিও ইজরায়েলকে পুরোপুরি সমর্থন দিতে ও কঠিন অবস্থান দেখাতে চাইবেন। আর ইরানের বিষয়ে কোনো নরম অবস্থান দেখানোর ঝুঁকিও নেবেন না। সেই ১৯৭৯-৮১ সময়কালের জিমি কার্টারের সংকটের সময় থেকে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বৈরিতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই সবকিছুর পরও চলমান বিপজ্জনক পরিস্থিতি কমলা হ্যারিসের জন্য দুঃসংবাদই বয়ে আনতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো দাবি করে বসবেন যে তাঁর সময়কালে দুনিয়াজুড়ে শান্তি ছিল, কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের দুর্বলতা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি তো তাঁর এ দাবির সঙ্গে এখন বেশ খাপ খেয়ে যায়। প্রকাশ্যে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিলেও হোয়াইট হাউস হয়তো এখনো ইজরায়েলকে প্রত্যাঘাত এমনভাবে সংযত রাখার জন্য বুঝিয়ে যাচ্ছে যেন তা ভয়াবহ না হয় আর ইরানও যেন পাল্টা হামলা চালানোর বাধ্যবাধকতা অনুভব না করে।


আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর বাইডেন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে আর কোনো সংঘাতে জড়ানোর ইচ্ছা যে নেই, তা বহু বার হাবে ভাবে বলা হয়েছে।গাজা ও লেবাননে ইজরায়েলি সেনারা যুদ্ধরত থাকায় নেতানিয়াহু সরকার হয়তো বা নিজের স্বার্থেই ইরানের সঙ্গে এখনই সরাসরি সংঘাতে যাবে না। কিন্তু ইজরায়েল যদি ঠিক করে যে সে সরাসরি কঠোর পদক্ষেপ নেবে, তাহলে তারা হাসিমুখেই বাইডেন প্রশাসনের সংযত থাকার আহ্বান অবজ্ঞা করবে, যা আগেও করে এসেছে। হোয়াইট হাউসের আশা হলো, ইজরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করলে তারা ইজরায়েলের প্রত্যাঘাতের শক্তি ও ধরনের ওপর প্রভাব রাখতে পারবে। এদিকে এক বছর ধরে বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই আশঙ্কায় যে যুদ্ধ বাধলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও হয়ত যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনবে অথবা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় তৈরি করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি এখন পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার পথে। এ বছরে দ্বিতীয়বার ইরান ইজরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেগুলো বিধ্বস্ত করতে ইজরায়েলকে সহায়তা করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ইরানকে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে ইজরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল যৌথ সামরিক অভিযানের হুমকির আশঙ্কাজনক বার্তাই দেওয়া হয়েছে। এর আগে এপ্রিল মাসে ইজরায়েলকে পাল্টা আঘাত করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল এমনভাবে যেন ইরান তা কৌশলগতভাবে মেনে নেয়। ফলে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলা আর ঘটেনি। তবে এবারও সে রকমটা হবে, তেমন সম্ভাবনা কম মনে হচ্ছে। লেবাননে ইজরায়েল স্থল অভিযান শুরু করার মধ্য দিয়ে তার আঞ্চলিক শত্রুদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র খুলে দিয়েছে। তার আগে ব্যাপক আঘাত হেনে হিজবুল্লাহকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। ফলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইজরায়েল সরকার বেশ উল্লসিত যে শত্রুদের তারা এখন দৌড়ের ওপর রাখতে বাধ্য করেছে। তাই তারা ইরানের ওপরও জোরালো আঘাত হানতে চাইছে এই প্রত্যাশায় যে এতে করে দেশটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে এবং তার পারমাণবিক কর্মসূচিও অনেক পিছিয়ে যাবে। সদ্য সদ্য ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ইজরায়েল যে পাল্টা আঘাত হানতে পারে, সে ঝুঁকির কথাও ইরানের ভালোভাবে জানা আছে। ইরানে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে আরেক দফা মিসাইল ছুড়ে তাঁরা এখন নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই পা দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তেহরানে জুলাই মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার পর এখন হিজবুল্লাহর ওপর ইজরায়েলের আঘাতের প্রত্যুত্তর না দেওয়াটাও ইরানের জন্য বিরাট ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

যুদ্ধ ও প্রতিরোধের এক ক্রূর যুক্তি হলো যে যদি কোনো শক্তিধর দেশ তার বন্ধুদের রক্ষা করতে না পারে বা নিজ দেশের রাজধানীতে হামলার জবাব দিতে না পারে, তাহলে তার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আর এই দুর্বলতা আরেক দফা আক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে, যা প্রকারান্তে আবার দেশটির প্রভাব ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে।অনেক উত্তেজিত ইজরায়েলি সমর্থক চলমান মুহূর্তকে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওই ছয় দিনের যুদ্ধে ইজরায়েলের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত বিজয় মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যই বদলে দিয়েছিল। এটা ঠিক যে ইসরায়েলের জন্য এখন পরিষ্কারভাবে অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আছে বড় ধরনের বেশ কিছু ঝুঁকি। হিজবুল্লাহ ধুঁকছে বটে, কিন্তু তাদের ভান্ডারে যে ক্ষেপণাস্ত্র আছে, তা ব্যবহার করার সক্ষমতা ফুরিয়ে যায়নি। বরং তা দিয়ে ইজরায়েলের প্রধান শহরগুলোয় কয়েক দফা আঘাত হানতে পারবে।

ইজরায়েল লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে এই সপ্তাহে। এতে করে দেশটি হয়তো সংঘাতের এমন পাকচক্রে আটকা পড়তে পারে, যা বছরের পর বছর চলবে। আর তা ঘটবে এমন এক সময়ে, যখন তার সেনাবাহিনী গাজায় যুদ্ধরত। ইজরায়েলি বিমান হামলায় লেবাননে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ দীর্ঘ মেয়াদে হিজবুল্লাহর নতুন প্রজন্মের যোদ্ধা তৈরি করতে পারে। আজকে হামাস যোদ্ধাদের ৬০ শতাংশই তো আগেকার সংঘাতগুলোয় যারা অনাথ হয়েছিল, তাদের থেকে উঠে এসেছে বলে মনে করা হয়। কোনো সন্দেহ নেই, হিজবুল্লাহ ও হামাস ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে গাজা কীভাবে শাসিত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর ইজরায়েলের জানা নেই। লেবাননের দুর্বল তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়তো হিজবুল্লাহর কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে সক্ষম হবে না। এতে করে ইজরায়েল সীমান্তে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র দেখা দেবে। নেতানিয়াহু হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু আঞ্চলিক গোলযোগ যেসব বিপদ ডেকে এনেছে, সেগুলোই হয়তো একদিন তাঁর শেষ পরিণতি হিসেবে দেখা দেবে।