• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

প্রতিবাদী আন্দোলনেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ভূত দেখার ট্র্যাডিশন চলছে

সরকারবিরোধী পক্ষে আমজনতার মনে যেমন উচ্ছ্বাসের ঘোর লেগেছে, তেমনই অবিশ্বাসের ঘোর কাটাতে না পেরে শাসকশিবিরে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রচলিত ধারণাই মুদ্রাদোষে আত্মতুষ্টি খুঁজে চলেছে, ভাবা যায় ! শিরদাঁড়াতেই যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে, আত্মবিশ্বাসের স্বপ্ন।

রাজনীতির তীব্র প্রভাব ও প্রতাপে জনগণের অস্তিত্ব কতটা বিপন্ন, তা অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর সৎসাহসের অভাববোধেই বেরিয়ে পড়ে। আরজি করের অভূতপূর্ব প্রতিবাদী আন্দোলননের মধ্যেও শাসকের কণ্ঠে স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের ছায়া ক্রমশ কায়ারূপ লাভ করে। যেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মদত ছাড়া এরকম স্বতঃস্ফূর্ত ও ধারাবাহিক আন্দোলন দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। সেই অসম্ভবকে প্রতিবাদের ধারাবাহিক তীব্রতায় যত সম্ভব করে বিস্ময়কর করে তুলেছে,ততই তার নেপথ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির গভীর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আরও সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক প্রতিবাদের নাছোড় প্রকৃতি ইতিমধ্যেই সরকারের শিরঃপীড়ার চূড়ান্ত মনে হয়। শুধু তাই নয়, যা এতদিন জনগণ ভাবতেই পারত না, তাই যেন চোখের সামনে দেখছে সকলে। সরকারের আধিপত্য ও ঔদ্ধত্যের কাছে মাথা নত না করে জুনিয়ার ডাক্তারদের ঐক্য যেভাবে দাবি আদায়ে মুখোমুখি আলোচনা করে মেরুদণ্ডকে মানদণ্ডে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে, তা গণমাধ্যমের দৌলতে টানটান উত্তেজনার প্রহরের মধ্যে জনগণের তৃষ্ণার্ত দীর্ঘ প্রতীক্ষাতেই প্রকট হয়ে উঠেছে। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে যে রাজ্যের কয়েক কোটি মানুষের অধীর অপেক্ষাও ছিল, তা কারও বুঝতে অসুবিধা হলেও শাসক ও শাসকদলের হয়নি।

এজন্যই সেখানে বিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসে। অবশ্য তার সঙ্গে এতে সরকারের জনপ্রিয়তা হারানোর ভয় বা জনবিমুখ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার আতঙ্ক থেকে মুখরক্ষার করার প্রবণতাও সক্রিয় রয়েছে। অন্যদিকে কোনওভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যোগসূত্রকে ঢাল করে আন্দোলনটির অভিমুখকে নস্যাৎ প্রয়াসও তাতে জারি। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের বিচার চাওয়ার অছিলায় সরকার প্রধানের বিচার নয়, ‘চেয়ার চায়’ বলতেও দ্বিধা হয়নি। সেদিক থেকে যে-কোনও আন্দোলনের নেপথ্যে যে রাজনৈতিক দলের ইন্ধন থাকে, বা, সমর্থনেই সক্রিয় হয়, সেই ছকবন্দি ধারণা থেকেই আরজি করের প্রতিবাদী আন্দোলনেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে তাকে লঘু করা বা সরকারবিরোধী অভিসন্ধিমূলক বলে দাগিয়ে দিয়ে হেয় করার প্রবণতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেননা জনগণকে চুপ করিয়ে দিয়ে বা প্রতিবন্ধী করে রেখে তাদের প্রতিবাদ করার অধিকারকেই রাজনৈতিক দলগুলি দীর্ঘদিন ধরেই কুক্ষিগত করে রেখেছে বা জনগণ তা রাখতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে শাসক বা বিরোধী দলের মধ্যে কোনও তফাত নেই। যে কোনও প্রতিবাদ দেখলেই তাতে এক পক্ষ জনরোষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন বলে, অন্যপক্ষ রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট প্রতিবাদ বলে তা অস্বীকার করে। অথচ দুই পক্ষেই সত্যের অপলাপ ঘটে। যে পক্ষে জনরোষের প্রতিফলন দেখে, সেই প্রতিবাদের মধ্যেও রাজনৈতিক যোগ অত্যন্ত নিবিড়। আবার রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট বলে উপেক্ষা করলেও তাতে জনগণের সমর্থন বর্তমান। আসলে জনগণের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ক্রমশ অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। সেখানে আরজি করের প্রতিবাদী আন্দোলন দীর্ঘ দিনের ধারণাকে ভেঙে দিলেও অবিশ্বাসের ফেরে সন্দেহের ছায়া কায়া হয়ে উঠেছে।

যেখানে গণতন্ত্রের নামে দলতন্ত্রের রাজত্ব চলে, সেখানে জনগণ ভোটসর্বস্ব অস্তিত্বে পরিণত হয়। তার ফলে সেই ভোটকে করায়ত্ত করতে গিয়ে জনগণকেই আয়ত্তে আনার কৌশল অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। জনগণ সেখানে ভোটার মাত্র, তার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর দলের আধিপত্য ও ঔদ্ধত্যে বশীভূত হয়। শুধু তাই নয়, সেখানে দলসর্বস্ব অস্তিত্বে জনগণের নিজস্ব কণ্ঠস্বর ঐক্যের অভাববোধে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেই প্রতিবাদ করতে গেলেও রাজনৈতিক দলের সাহায্য নিতে হয়। আবার বিপদ থেকে উদ্ধারেও তার শরণাপন্ন হয় জনগণ। যেখানে দলীয় নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে জনগণের স্বতন্ত্র প্রতিবাদ করার বিষয়টি আপনাতেই অবিশ্বাস্য মনে হয়। দলদাসের রাজত্ব প্রতিবাদ শব্দটিই বেমানান হয়ে ওঠে। বাদী-বিবাদীর মধ্যেই যার রাজনৈতিক দলের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়,তার রেসে সামান্য ঘটনাই তিল থেকে তাল হয়ে ওঠে, প্রতিবাদে তার ঐক্য গড়ে তোলার ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে। সেখানে সেই প্রতিবাদকে সক্রিয় করার জন্যও রাজনৈতিক দলের সমর্থন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এজন্য কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে বা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে ঘোরতর অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ব্যর্থ জনগণই রাজনৈতিক দলগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, একান্তে নিজেদের মধ্যেই সরকারবিরোধী দলগুলোর সমালোচনা করে। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত ও ধারাবাহিক নাছোড়বান্দা প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হওয়ার বিষয়টি আপনাতেই বিশ্বাসের সদর দরজায় কড়াঘাত করে।

আর সেখান থেকেই শাসক ও শাসকদলের মুখে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের গভীর ষড়যন্ত্রের ভূত নানা কারণেই চেপে বসে। প্রথম দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব যেভাবে আন্দোলনে ফেনা তুলেছিল, অচিরেই তার স্বতঃস্ফূর্ত তীব্র গতিতে তুমুল জনস্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়তেই সেই ফেনা কেটে গিয়ে জনগণের আসল পরিচয় বেরিয়ে পড়ে। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলনের নেপথ্যে যে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই নেই, তা তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই শ্লোগান তুলে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে তুলেছেন। অন্যদিকে নিজেদের কেরিয়ারকে উপেক্ষা করে যেভাবে আরজি করের পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ডাক্তারি ছাত্রীর খুন করে ধর্ষণের নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁরা তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তাতে রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে দলীয় পতাকা ছেড়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই আমজনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এরকম অভূতপূর্ব আন্দোলন ইতিপূর্বে ঘটেনি। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যেভাবে সারা রাজ্য জুড়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সক্রিয় সামিল হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে যা কোনওভাবেই প্রতিহত করা যাচ্ছে না, তা তো অবিশ্বাস্য শুধু মনে হয় না, তার হিসাব মেলানোই দুরূহ হয়ে ওঠে। অথচ সব হিসেবনিকেশকে ভুল প্রমাণ করে আরজি করের বিপ্লবী আন্দোলন এখনও জারি।

আসলে আধুনিক ভোগবাদী সমাজের জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতিতেই রাজনৈতিক দলগুলির তীব্র প্রভাব বিস্তার করে। সেখানে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দ্বন্দ্ব যেমন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তেমনই সমাজে রাজনৈতিক প্রভাব আধিপত্য বিস্তার করে নাগরিক সমাজকেই রাজনৈতিক সমাজে পরিণত করে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে সামাজিক ঐক্যের চেয়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রাধান্য লাভ করে। সেক্ষেত্রে সামাজিক জীবন যেমন অকেজো হয়ে পড়ে, তেমনই রাজনৈতিক সমাজ ব্যক্তিগত জীবনকেও নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যাতেও রাজনীতি জড়িয়ে যায়। সেখানে দলীয় অস্তিত্বের বাইরে রাজনীতি নিরপেক্ষ চেতনাই আজ বিলুপ্তির পথে। সবকিছুর মধ্যেই রাজনৈতিক যোগ অত্যন্ত নিবিড় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভোগী মানুষ যেখানে পাওয়ার লোভ আর হারানোর ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে, সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হওয়ার কথা ভাবাই আত্মঘাতী মনে হয়। নিজে বাঁচলে বাপের নামের দেশে প্রতিবাদের কথা কল্পনা করাও বিপজ্জনক। অন্ধের দেশে আয়না খোঁজার মতোই তা ব্যর্থ মনে হয়। অথচ তার পরেও যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ ধেয়ে আসে, প্রতিবাদের মশাল অনির্বাণ হয়ে ওঠে, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত প্রতিবাদ জনস্রোতের রূপ লাভ করে, তখন তার লাগামহীন নাছোড় প্রকৃতি মরীয়া হয়ে ওঠে, তার শেষ দেখার উৎসবে মেতে উঠে বিজয়ের প্রতীক্ষায় আরও এগিয়ে চলে। সেখানে প্রতিবাদী আন্দোলনের নেপথ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অদৃশ্য শক্তি নেই, তার চেয়েও বড় শক্তি রয়েছে তার।

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি আজ তার পিছনে অদৃশ্যভাবেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার নামই মেরুদণ্ড। বহুদিন বাঙালি সেই দণ্ডটির অভাব অনুভব করতে করতে তা অভ্যাসে বিলুপ্ত হয়েছে বলে তার এক সময় মনে হয়েছিল। সেটিই আজ তার মনেপ্রাণে সমান সক্রিয়। তাকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয় কার সাধ্যি আর! সেই মেরুদণ্ডের মহাশক্তিতে প্রতিবাদহীন জনগণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা বিশ্বাসের ধারণাই আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। সেখানে মহাশক্তিতে বলীয়ান জনশক্তির তীব্র প্রভাবে শুধু শাসক বা শাসকদলই নয়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও বিস্মিত। এজন্য সরকারবিরোধী পক্ষে আমজনতার মনে যেমন উচ্ছ্বাসের ঘোর লেগেছে, তেমনই অবিশ্বাসের ঘোর কাটাতে না পেরে শাসকশিবিরে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রচলিত ধারণাই মুদ্রাদোষে আত্মতুষ্টি খুঁজে চলেছে, ভাবা যায় ! শিরদাঁড়াতেই যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে, আত্মবিশ্বাসের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন কখনও হারে না, হারিয়েও যায় না। সময় পেলেই জেগে ওঠে। আরজি করের স্বতঃস্ফূর্ত ও ধারাবাহিক আন্দোলনে সেই স্বপ্নের হাতছানিতে প্রতিবাদী বাঙালি তার শিরদাঁড়া সোজা করে স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে। বিস্ময়ের ঘোরে তা অবিশ্বাস্য মনে হওয়াই দস্তুর। তা তো প্রতিটি যুগান্তকারী বিপ্লবের মধ্যেই প্রতীয়মান।