• facebook
  • twitter
Thursday, 24 April, 2025

শেয়ার বাজারের পতন অনিবার্য ছিল

এক দিনে ৫০ হাজার কোটি রিয়াল হারিয়েছে সৌদি পুঁজিবাজার। শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে সৌদি আরবের শেয়ার বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

সোমবার সকাল হতে না হতেই এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল ভারতের শেয়ার বাজারে। সেনসেক্স ও নিফটি দুই সূচকেই যেন একযোগে রক্তপাত ঘটলো। দিনের শুরুতেই দেখা গেল ৪% এর বেশি শেয়ার পতন। আর বাজার খোলার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তো সেনসেক্স একধাক্কায় ৪০০০ পয়েন্ট নীচে নেমে গেল। একটানা বিক্রির চাপে এবার মুখ থুবড়ে পড়লো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রধান ভরসার জায়গা শেয়ার মার্কেট। কিন্তু কেন এত বড় ধ্বস নামলো? আসলে কী ঘটনা ঘটেছে? আবারও কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ভারতের শেয়ার মার্কেট?

এই রক্তাক্ত পরিস্থিতির পিছনে রয়েছে পাঁচটি বড়সড় কারণ, যা বিনিয়োগকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন শুল্ক নীতি চাপিয়ে দিয়েছে প্রত্যেকটি দেশের উপর। যা গোটা বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারকে আরো আতঙ্কিত করে দিয়েছে। ট্রাম্পের মতে, “এটি একটি ওষুধের মত। কষ্টকর হলেও সবার প্রয়োজন।” আর এই ওষুধের কোপে পড়েই এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ, এমনকি আমেরিকার বড় বড় সূচকগুলি কার্যত গুঁড়িয়ে গিয়েছে। ন্যাশদকের ২০% এর পতনে শেয়ার মার্কেটের মুখ আরও থুবড়ে পড়েছে। ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতিও এই ধাক্কা সামাল দিতে পারল না।বর্তমানে ১৮০ টির বেশি দেশের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত বাজারকে চরম অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, এখনো বাজারে সেই প্রভাব পুরোপুরি দেখা যায়নি। তবে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যারিফের পরোক্ষ প্রভাব হয়তো ভারতের উপর সীমিত। কিন্তু আমেরিকায় যদি একবার মন্দ দেখা যায়, তাহলে ভারতের শেয়ার বাজার আরো বড়সড় ধাক্কা খেতে পারে। বর্তমানে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বিশ্বজুড়ে উৎপাদন খরচ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। যার ফলে কমছে লাভের পরিমাণ এবং বাড়ছে খরচের প্রবণতা। বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা এখন ৪০% থেকে ৬০%-এ গিয়ে ঠেকেছে। ভারতের ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশেষজ্ঞ সংস্থা,৬.৩% থেকে নেমে গিয়ে ৬.১%-তে পৌঁছে গিয়েছে। অর্থাৎ, মন্দার ছায়া এখন ভারতের উপরেও ঘনিয়ে আসছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এতটাই ভয় ছড়িয়ে গিয়েছে যে, তারা সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে এবং এর ফলে বিদেশী পুঁজি বাজার ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শুধু এপ্রিল মাসেই প্রায় ১৩,৭৩০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে বিদেশী সংস্থাগুলি। হ্যাঁ অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। এর ফলে বাজারে তারতম্য কমে গিয়ে পতনের গতি আরো রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে।আগামী ৯ই এপ্রিল আসছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সিদ্ধান্ত। ভারতের বাজার এখন আশা করছে সুদের হারে কিছুটা হলেও ছাড় মিলবে। অন্যদিকে ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে চতুর্থ ত্রৈমাসিক ফলাফল প্রকাশ। আর সেখানে প্রথমেই থাকছে টিসিএস-এর রিপোর্ট। এই রিপোর্টের ফলাফল এবং কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা বাজারকে কিছুটা সামাল দিতে সাহায্য করতে পারে। তবে শেয়ার বাজার মুখ থুবড়ে পড়ার পিছনে এটি অন্যতম এক কারণ।

শেয়ার বাজারের ওঠানামা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের এই পতন ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং বিনিয়োগকারীদের কল্পনার বাইরে। কারণ তাঁরা ট্রাম্পের শুল্ক বিপ্লবকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। সেটা যদি করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন যে এটাই অনিবার্য ছিল। বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব যেভাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে কাঁপাতে পারে, এই পতন হয়তো তারই বড় প্রমাণ। তবে এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছে ঘাবড়ে নয়, বরং বুঝে শুনে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবথেকে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শুধু ভারত নয় এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার বাজারেও বড় ধরনের ধস হয়েছে।

জাপানের নিক্কি ২২৫ সূচকের পতন হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচকের পতন হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তাইওয়ান ও সিংগাপুরেও শেয়ারের দাম কমেছে। তাইওয়ানে কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ এবং সিংগাপুরে কমেছে প্রায় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।গতকাল টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ইউরোপের শেয়ার বাজারেরও ধস নেমেছে। ইউরোপের শেয়ার বাজারের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা প্যান-ইউরোপিয়ান স্টক্স ৬০০ সূচকটি এদিন লেনদেন শুরুর পরপরই ৬ শতাংশ কমেছে। দিনের শুরুতে জার্মানির ডিএএক্স সূচকটি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জে দরপতন হয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এছাড়া বেলজিয়াম স্টক মার্কেটে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ফ্রান্সের শেয়ার বাজার সিএসি ৪০-এ ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ দরপতন হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক কৌশলগত পরামর্শক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়া গ্রুপের সহযোগী রিন্টারো নিশিমুরা বলেন, এই শুল্ক আরোপের প্রভাব নিয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা কাজ করছে। আর এ কারনেই শেয়ারের দামে এত বড় ধস হচ্ছে।

সোম ভারতে লেনদেন শুরু হওয়ার মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের ২০ লাখ কোটি টাকা বাজার মূলধন কমে যায়। একসময় বাজারের মূল সূচক সেনসেক্সের পতন হয়েছে ৪ হাজার পয়েন্ট। শেষ অধিবেশনের তুলনায় সূচকের পতন হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে বাজারের আরেক সূচক নিফটির পতন হয়েছে ১ হাজার পয়েন্টের বেশি। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্সভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টাটা স্টিল (-১০%), টাটা মোটরস (-৭.৮৬%), ইনফোসিস (-৬.৯৮%), টেক মাহিন্দ্রা (-৬.৩৬%) ও এলঅ্যান্ডটি (-৬.৪৫%)। পরে অবশ্য বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের কারণেই শেয়ার বাজারে এই রক্তক্ষরণ। এশিয়ার শেয়ার বাজারের পাশাপাশি মার্কিন শেয়ার সূচক নাসডাক ও ডাও জোন্সেরও বড় পতন হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের শুল্কনীতি ঘোষণার পরপরই। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের স্টক মার্কেট ফিউচার্স সূচকও অনেকটা পড়ে গেছে। গত সপ্তাহে মার্কিন শেয়ার বাজার ৬ লাখ কোটি ডলারের বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে।

শেয়ার বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতির এই পরিপ্রেক্ষিতে গত রবিবার (যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময়) এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, শেয়ার বাজারের কী হবে, আমি সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমাদের দেশ অনেক শক্তিশালী। এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প তার প্রশাসনের ব্যাপক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, বিশ্বের অনেক নেতা ‘একটি চুক্তি করতে মরিয়া’ হয়ে আছেন।

এক দিনে ৫০ হাজার কোটি রিয়াল হারিয়েছে সৌদি পুঁজিবাজার। শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে সৌদি আরবের শেয়ার বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত রবিবার একদিনেই ৫০ হাজার কোটি রিয়ালের বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে সৌদি আরবের শেয়ার বাজার। উপসাগরীয় অন্যান্য শেয়ার বাজারের একই অবস্থা। জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্যহ্রাস ও বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে দরপতনও উপসাগরীয় বাজারে পতনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। সৌদি আরবের শেয়ার বাজারের প্রধান সূচক তাদাউল অল শেয়ার ইনডেক্স (টিএএসআই) ৭০০ পয়েন্টের বেশি (৬ দশমিক ১ শতাংশ) কমে ১১ হাজার ২০০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। এই পতনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে সৌদি আরামকো। কোম্পানিটির বাজারদর ৩৪ হাজার কোটি রিয়ালের বেশি কমেছে। অন্যান্য উপসাগরীয় সূচকেও সামগ্রিকভাবে পতন দেখা গেছে। গতকাল কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনও শেয়ার বাজারের পতনের খরবও পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির জল কতটা গড়ায়, সেটাই এখন দেখার।