শোভনলাল চক্রবর্তী: শুধু আমাদের রাজ্যেই নয়, আরও অনেক রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার টালমাটাল অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে৷সব রাজ্যেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ অজস্র! সত্তরের দশকের শেষার্ধে সবার জন্য শিক্ষা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি দেশের সমস্ত রাজ্যে রূপায়িত হওয়া শুরু হয়৷ সকলেই মেনে নেন যে, নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রথম সোপান হল ৫-৯ বছর বয়সের শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা৷ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের স্কুলে নিয়ে আসা খুব সহজসাধ্য ছিল না৷তবে কেন্দ্র ও রাজ্যের এবং কিছু কাল ইউনিসেফ-এর যৌথ প্রচেষ্টায় সর্বশিক্ষা অভিযান অত্যন্ত সফল ভাবে রূপায়িত হয়েছিল৷ স্কুলছুটদের জন্য সেতু পাঠক্রম বা ব্রিজ কোর্স, মিড-ডে মিল প্রকল্প, প্রশাসনিক পরিকাঠামো এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সমন্বিত উদ্যোগে স্কুলশিক্ষা অগ্রাধিকার পেয়েছিল৷ স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছিল, স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের বণ্টন হয়েছিল৷ এ রাজ্যে স্কুলের অপ্রতুলতার জন্য শিশু শিক্ষাকেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনও হয়েছিল৷
গোলমাল বাধল শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশে, এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের পদে পদে মতবিরোধে৷বহু কাল ধরে সরকারি স্কুলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং অর্থবানরা ছেলেমেয়েদের চড়া টাকা দিয়ে বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছে৷ অথচ, সরকারি স্কুল, বিশেষত জেলা স্কুলগুলি থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র কর্মজীবনে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন৷ ইদানীং শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতির যে খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্ত্ত তা দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত নয়৷কেন্দ্র-রাজ্যের শত বিরোধ সত্ত্বেও তারা শিক্ষা ধ্বংসে সমান সক্রিয়৷ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে আরও বলতে চাই, এই ধ্বংসের বীজ বপন হয়েছিল আশির দশকের পরে, তৎকালীন কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ কিছু রাজ্য সরকারের উদ্যোগে৷ বর্তমানে কেন্দ্র (বিজেপি) এবং রাজ্যের (তৃণমূল কংগ্রেস) সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্র (কংগ্রেস) এবং রাজ্য (সিপিএম) সরকার শিক্ষা ধ্বংসের বিষয়ে একই জায়গায় অবস্থান করছে৷
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতিতে শিশুকে তিন থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত ‘ফাউন্ডেশনাল স্টেজ’-এ পড়াতে বলেছে৷ ক্লাস ওয়ানের আগে শিশুকে তিন বছর অঙ্গনওয়াডি়তে পড়াতে হবে, এবং তার সঙ্গে এখনকার ক্লাস ওয়ান এবং ক্লাস টু মিলিয়ে মোট পাঁচ বছর হল ফাউন্ডেশনাল স্টেজ৷ এই অঙ্গনওয়াডি়র পরিকাঠামো কী রকম, আমরা জানি৷ উপযুক্ত বিল্ডিং, শিক্ষক নেই, জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার নেই৷ তার উপর যদি প্রাইমারির শিশুরা অঙ্গনওয়াডি়তে ভিড় করে, সেই পরিবেশ কেমন হবে? ঘরের বাইরে কর্মরত শ্রমিক পরিবারের তিন বছরের শিশুকে কে স্কুলে নিয়ে যাবে? অঙ্গনওয়াডি় কেন্দ্রগুলিতে প্রাক্-প্রাথমিক পাঠদানের জন্য যত শিক্ষকের পদ প্রয়োজন, তা পূরণ হবে কি না, এবং সেই শিক্ষকদের খরচ কে বহন করবে, অঙ্গনওয়াডি়র জন্য নতুন করে বিল্ডিং তৈরি হবে কি না, এর কোনও কিছুই শিক্ষানীতিতে বলা নেই৷ অথচ, এটাই হল একটা শিশুর ভিত গড়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়৷
আশির দশকে এ ভাবেই প্রথমে পরিকাঠামো গডে় না তুলে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হল৷ দুটো বা একটি রুমে চারটে ক্লাস, দু’-এক জন শিক্ষক, অথচ বিদেশের অনুকরণে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হল৷ না পডে়ই পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে পড়ছে৷ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের দায়িত্ব পডে় গেল ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের নাম লিখতে, সাধারণ যোগ বিয়োগ করতে, সাধারণ বাক্য তৈরি করতে শেখানো৷ একুশ শতকের প্রথমে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় প্রথম সারি থেকে চলে এল শেষের দিকে৷ অভিভাবকরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকলেন৷ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং অন্যান্য বেসরকারি স্কুল গডে় উঠতে লাগল৷ এখন তো ক্লাস এইট অবধি পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে৷কেরল, রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্য এই জাতীয় শিক্ষানীতিকে সরাসরি মেনে নিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্য বিরোধিতার ভান করেও জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক সুকৌশলে চালু করছে৷ কিছু দিন আগে আমাদের রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে সংঘাত দেখা দিয়েছিল, সেটা কেন্দ্র বা রাজ্য শিক্ষানীতির সংঘাত নয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খবরদারি কে করতে পারবে, এই নিয়েই ছিল তাদের সংঘাত৷ এই সংঘাতের সঙ্গে ছাত্রস্বার্থের কোনও সম্পর্ক ছিল না৷
১৯৮৬ সালে তৎকালীন কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া তৈরি করেছিল৷ মনমোহন সিংহের উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণের নীতি যে ধনীর স্বার্থই রক্ষা করছে, বর্তমানে জনগণ হাডে় হাডে় টের পাচ্ছে৷ মোদী সরকারের শিক্ষানীতি (২০২০) রাজীব গান্ধীর শিক্ষানীতিরই (১৯৮৬) কিছু পরিবর্তিত রূপ৷কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির আদলে এই রাজ্যেও চালু হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা, নো ডিটেনশন পলিসি, অস্থায়ী শিক্ষকের আধিক্য, প্রশাসনিক কর্তাদের দ্বারা শিক্ষা পরিচালনা, চার বছরের ডিগ্রি কোর্স, স্কুল স্তরেই সিমেস্টার প্রথা, প্রাক্-প্রাথমিককে প্রাথমিকে যুক্ত করা, ত্রিভাষা নীতি ইত্যাদি৷ জাতীয় শিক্ষানীতির পরোক্ষ ভয়ঙ্কর দিক হল, নতুন নিয়োগ নয়, নিয়োগ হলেও অতিথি শিক্ষক-আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়ে স্কুল-কলেজ চালানো৷ রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেও অনেকটা এই নিয়মেই চলছে৷২০১২-য় কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন স্কুল এলাকায় বিজ্ঞানপাঠ কেন্দ্র খুলেছিল; পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল আড়াইশোর বেশি৷ ২০১৪ থেকে বরাদ্দ কমতে থাকে, ২০১৮-তে বন্ধ হয়ে যায়৷ একটি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক সংগঠন রাজ্য সরকারকে প্রস্তাব দেয়, তারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কেন্দ্রগুলি চালু রাখবে৷ সরকার প্রস্তাবটি নাকচ করায় কেন্দ্রগুলি উঠে যায়৷ আজ স্কুলে-স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষার যে সঙ্কোচন, এ যেন তারই অশনিসঙ্কেত৷সঙ্কেত আরও মর্মান্তিক এক সত্যের: কেন্দ্রে-রাজ্যে শত বিরোধ সত্ত্বেও শিক্ষার অধোগতিতে তাদের অবদান পাল্লা দিয়ে৷ এক পক্ষেরও যদি শুভবুদ্ধি হয়, তা হলে বাংলার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বাঁচে৷
প্রকৃত শিক্ষার মূল্যায়নের সূচকগুলি ঠিক কী হবে? যদি চেনা প্রশ্নের চেনা উত্তর না খুঁজে এক জন ছাত্র কোনও জটিল প্রশ্নের তল খোঁজার চেষ্টা করে যায় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, তবে তার সেই ‘জানার মাঝে অজানার সন্ধান’-এর মূল্য দিতে, মূল্যায়ন করতে আমরা আগ্রহী হব তো? যদি কোনও স্কুল ছাত্রদের এই রকম মুক্তচিন্তার পরিসর তৈরি করে দেয়, তার কদর আমরা করব তো? এক বার ফিরে তাকাই রবীন্দ্র-দর্শনের দিকে, যার ভিত্তিভূমিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয়কে৷ তাঁর কথায়, “এখানে তোমরা কেবল বই পড়োনি, সংগীতে উৎসবে জীবন এখানে বিচিত্র হয়ে উঠেছে৷… এখানকার ছাত্ররা উপাধি নিয়ে চলে যাবে, পরীক্ষা-পাশের মন্ত্রে মার্কামারা হয়ে বেরোবে, এর জন্য এখানে আমি আমার শক্তি নিয়োগ করি নি৷… এখানে বিদ্যা ও প্রাণের গভীর যোগসাধনের চেষ্টা হয়েছে৷” তিনি ছাত্রদের স্কুলজীবনে যে ‘সমগ্রতার আদর্শ’ আর ‘প্রীতির ধারা’-র কথা বলেছেন, তার এক কণাও কি আমরা স্মরণে রেখেছি?শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার৷ তাই এই ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ একেবারে প্রাথমিক কর্তব্য৷ সরকার সেই বিষয়ে উদাসীন থাকলে শিক্ষার প্রসারে তার সামগ্রিক সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে৷ বহু সরকারি স্কুলে না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক, কোনও জায়গায় শিক্ষক থাকলেও ছাত্রেরা অনুপস্থিত৷ কোথাও গবেষণাগার নেই, এমনকি উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষও নেই৷ সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলগুলির এই শোচনীয় অবস্থার কারণেই অভিভাবকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷
এ বিষয়ে সরকারি উদাসীনতা এমনই যে, কোন বয়সের শিশু কতটা গুনতে পড়তে লিখতে শিখল, তার সঠিক হিসাব শিক্ষা দফতর থেকে না পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল৷ অথচ, এই বিষয়গুলির সঙ্গে রাজ্যের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জডি়য়ে আছে৷ সেই কারণেই ত্রুটি মেরামতের দায় সম্পূর্ণ বর্তায় সরকারের উপরে৷শিক্ষা পোর্টালের ‘প্রযুক্তির গোলমাল’ বলে সেই দায় এড়ানো যায় কি? ক্ষতি তো অনেক দিন ধরেই হয়ে চলেছে, তবে অতিমারির কাল থেকে তার মাত্রা আরও বহুগুণ বেডে়ছে৷ রাজ্য জুডে় এমন বহু ছেলেমেয়ের খোঁজ মিলছে, যাদের নাম স্কুলের খাতায় লেখা থাকে, কিন্ত্ত তারা নিয়মিত স্কুলে যায় না, অনেকে কার্যত যায়ই না৷ যারা যায়, তাদের অনেকেই কিচ্ছু শেখে না— ক্লাস সেভেনে পড়ছে কিন্ত্ত ক্লাস ওয়ানের বই পড়তে শেখেনি, যোগবিয়োগ করতে পারে না, এমন ছাত্রছাত্রী এ-রাজ্যে বিস্তর৷ এ-সবই আমাদের জানা, কিন্ত্ত জানা বলেই, বহুচর্চিত বলেই, দ্বিগুণ ভয়ানক৷ চরম সর্বনাশের তথ্য-পরিসংখ্যানও যখন সমাজের চোখে বাসি খবর হয়ে যায়, সংবাদপত্রের পাঠক হাই তুলে পাতা উল্টে যত রাজ্যের দাদাদিদিদের কয়েক সহস্র রজনী অতিক্রান্ত বস্তাপচা কুনাট্যরঙ্গে মনোনিবেশ করেন, তার চেয়ে বেশি ভয়ানক আর কী হতে পারে? পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ ঘনতমসাবৃত খাদের অতলে তলিয়ে যেতে চলেছে৷ কথাটা ভয়-দেখানো অতু্যক্তি নয়, ভয়ঙ্কর সত্য৷ যাঁরা সরকার চালান তাঁরা নিজেদের নূ্যনতম কর্তব্যগুলি সম্পাদন করতে চাইলে সত্যের মূর্তি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কারণ ছিল না৷ শিক্ষা, বিশেষত স্কুল স্তরের শিক্ষা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পডে়৷ দেশের আইন-আদালতের বিচারেও সে-কথা স্বীকৃত হয়েছে অনেক কাল আগে৷ স্কুলবাডি় তৈরি করে দিলে আর স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়ে রাখলেই সেই দায়িত্ব পালিত হয় না, শিশুদের লেখাপড়াটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়৷ অনেক রাজ্যেই বহু সরকারি স্কুলে এ ব্যাপারে বিরাট ঘাটতি৷ কার সঙ্গে তুলনা করলে পশ্চিমবঙ্গের হাল একটু ভাল দেখায়, সেই অসার আত্মপ্রশস্তির উপকরণ সংগ্রহে ব্যস্ত না থেকে শিক্ষা দফতরের কর্তারা সমস্ত স্কুলের হাল ফেরানোর জন্য একটা সত্যিকারের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লে আজ আমরা অন্য ছবি দেখতাম৷