পুলক মিত্র: এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বারবার ৪০০-র গণ্ডি পেরনোর কথা বলতে শুনেছি৷ যেমনটি শুনেছিলাম ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে৷ তখন মোদির মুখে শুনেছিলাম ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের কথা’৷ তখন তিনি ক্ষমতায় এলে বছরে ২ কোটি তরুণ বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ নির্বাচনী জনসভাগুলিতে জোর গলায় তাঁকে বলতে শুনেছি, সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কালো টাকা তিনি দেশে ফেরাবেনই৷ আর প্রতিটি ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে পৌঁছে দেবেন৷
তারপর তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হলেন৷ কিন্ত্ত না, কোনও প্রতিশ্রুতিই তিনি রাখেননি৷ বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি হয়নি৷ কালো টাকাও দেশে ফেরেনি৷ দশ বছর পর, ৪০০-র বেশি আসনে জেতার স্লোগান নিয়ে ময়দানে নেমে পড়লেও, এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে আমরা ‘৪০০ পার’-এর সেই স্লোগান আর শুনতে পাচ্ছি না৷ অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির অন্য নেতারাও এ নিয়ে জোর গলায় কিছু বলছেন না৷ এমনকি সংবিধান বদলে দেওয়ার যে হুঙ্কার শোনা গিয়েছিল, তাও এখন ক্রমশ চাপা পড়তে শুরু করেছে৷ হঠাৎ কেন পিছু হঠলেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা৷
প্রবীণ বিজেপি নেতা তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংকে দিয়ে বলতে বাধ্য করা হয়েছে, বিজেপি ফের ক্ষমতায় এলে, দেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটাবে না, কিংবা সংরক্ষণও তুলে দেবে না৷ এক ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদি মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য রাজনাথ বলেছেন, ‘সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার প্রশ্নই নেই৷ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের দেশে সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে৷ আমি আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের কখনও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তনের কোনও প্রয়োজন হবে না৷’
২৩ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের আকোলায় প্রচারে যাওয়ার পথে অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে, তফশিলি জাতি/তফশিলি উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ তুলে দেবে না৷’ বিজেপি আবার দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরলে, সংবিধানের পরিবর্তন ঘটাবে, এই ধারণা কেন তৈরি হয়েছে? শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভোটে যে নির্বাচনে জেতা যাবে না, একথা মোদি, শাহরা ভালভাবেই জানেন৷ ২০০৯ সাল থেকে ওবিসি-দের মধ্যে বিজেপির শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৯ সালে বিজেপি যেখানে ১৭ শতাংশ ওবিসি ভোট পেয়েছিল, ২০১৯-এ তা বেড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশে পৌঁছে যায়৷ এই ভোটের হার কমে যাবে, যদি সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হয়৷
বিজেপি নেতারা বলে এসেছেন, ৪০০ পেরনোর অর্থ সংবিধানে পরিবর্তন৷ দেশজুড়ে বিজেপি নেতারা এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, ৪০০ আসনে জিতে তাঁরা সংবিধানে বদল আনতে চান৷ কিন্ত্ত এখন তাঁরা আর ‘৪০০ পার’-এর কথা বলছেন না৷ কারণ, ভোটারদের মধ্যে সংবিধানের পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়ে পড়লে, দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসি ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবেন৷ সংবিধান সংশোধন করে সংরক্ষণ তুলে দিলে, তার মাশুল তাঁদেরই বেশি দিতে হবে৷
১১ মার্চ আরএসএস-ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা তথা কর্নাটকের সাংসদ অনন্তকুমার হেগড়ে বলেছেন, ‘৪০০ আসনের টার্গেট রাখার অর্থ হল, সংবিধান সংশোধন৷’ এবার অবশ্য অনন্তকুমারকে লোকসভায় দাঁড়ানোর টিকিট দেওয়া হয়নি৷
২ এপ্রিল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া জ্যোতি মিরধা বলেছিলেন, সংবিধানের বদলের জন্য তাঁর দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন৷ উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের ২ বারের সাংসদ এবং অযোধ্যার দীর্ঘদিনের বিধায়ক লাল্লু সিং এক জনসভায় বলেছেন, সংবিধান পরিবর্তন বা নতুন সংবিধান তৈরির জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন৷
মীরাটের বিজেপি প্রার্থী অরুণ গোভিলের একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাঁকে বলতে শোনা গেছে, আগামী দিনে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে এবং এর মধ্যে ক্ষতিকর কিছু নেই৷ তিনি বলেছেন, ২০২৪-এ বিজেপি ক্ষমতায় এলে সংবিধান বদল করবে৷ তাঁর কথায়, ‘সময়ের সঙ্গে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছে৷ পরিবর্তন হল উন্নয়নের প্রতীক৷ এটা খারাপ কিছু নয়৷’
বিজেপিকে শৃঙ্খলাপরায়ণ দল বলে মনে করা হয়, যার নির্দিষ্ট মতাদর্শ রয়েছে এবং দলের সাংসদ ও অন্যান্য নেতারা সেই শৃঙ্খলার অংশীদার৷ তাই কেন্দ্রীয়ভাবে এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয়ে থাকলে, দেশের নানা প্রান্তের নেতারা কেন একই সুরে সংবিধান বদলের কথা বলবেন৷ এবং গত কয়েকমাস তা আরও গতি পেয়েছে৷
ঘটনা হল, আমাদের দেশে বর্তমানে যে সংবিধান (পড়ুন সংরক্ষণ ব্যবস্থা) চালু রয়েছে, বরাবরই তার বিরোধিতা করে এসেছে আরএসএস, বিজেপি৷
৩০ নভেম্বর, ১৯৪৯-এ আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গ্যানাইজার’-এ লেখা হয়েছিল, “আমাদের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে খারাপ দিক হল, এর মধ্যে ভারতীয়ত্ব নেই৷ সংবিধানের প্রণেতারা ব্রিটিশ, আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন এবং অন্যান্য দেশের আদলে সংবিধান তৈরি করেছেন৷ কিন্ত্ত এতে প্রাচীন ভারতীয় সাংবিধানিক আইন, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির কোনও অস্তিত্ব নেই৷’
আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তাঁর সংগঠনের মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’তে ২০১৫ সালে লিখেছিলেন, সংরক্ষণ ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত৷ আসলে বিজেপির শীর্ষ নেতারা এক সময় ভেবেছিলেন, রামমন্দিরের ওপর ভর করে তাঁরা অনায়াসে নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়ে যাবেন৷ কিন্ত্ত এখন তাঁরা বুঝতে পারছেন, ক্ষমতায় ফেরার পথ খুব একটা মসৃণ হবে না৷ রাজনৈতিক নেতাদের এমনিতেই মানুষ বিশ্বাস করে না৷ তার ওপর গত ১০ বছর ধরে ভারতীয় জনতা পার্টির যে মিথ্যাচার মানুষ দেখেছেন, তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি৷
গান্ধী পরিবারকে নিশানা করে মোদি পরিবারতন্ত্রের কথা বললেও, মানুষ বুঝতে পারছেন, বিজেপিও একই দোষে দুষ্ট৷ এবং তার চেয়েও খারাপ৷ মোদির সংখ্যালঘু ভোট মেরুকরণের খেলাও খুব একটা কাজে আসছে না৷ এ ধরনের রুচিহীন, কদর্য খেলায় ক্ষিপ্ত দেশের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ৷
রামমন্দিরকে পিছনে ফেলে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এবারের ভোটে বড় ইসু্য হয়ে উঠেছে৷ কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা থেকে শুরু করে যেভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হল, তাতে মোদির প্রতিহিংসাপরায়ণতার ছাপ দেখতে পাচ্ছেন দেশবাসী৷ বিজেপিকে এখন মানুষ ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে উপহাস করতে শুরু করেছে৷ বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতির সঙ্গে এখন ভারতবাসী পরিচিত হয়ে উঠেছেন৷ ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতর এখন বিজেপির প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি৷
কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে এবার উদার, অবাধ ও গণতান্ত্রিক বাতাবরণ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যা রাজনৈতিক মহলের বিশেষ নজর কেড়েছে৷ সেইসঙ্গে গরিব ও আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি, মধ্যবিত্ত, শিল্প মহল (কোনও কর সন্ত্রাসের হুমকি নয়) প্রত্যেকেরই স্বার্থরক্ষার বার্তা দেওয়া হয়েছে এই ইশতেহারে৷
মোদি তথা বিজেপি রাহুল গান্ধীকে আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য করে তুলেছে৷ বিজেপির আইটি সেল সমাজমাধ্যমে রাহুলের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে চলেছে৷ ভারত জোড়ো যাত্রা এবং ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার মাধ্যমে রাহুল তাঁর সম্পর্কে ধারণা একেবারে বদলে দিয়েছেন৷ তাঁর চোখেমুখে এখন আত্মবিশ্বাসের ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ মোদির চেয়ে রাহুলের বিশ্বাসযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে৷ ২০১৪ সালের পর থেকে কংগ্রেসের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন মোদি, যার ফায়দা তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ এখন বিজেপি রাহুলকে যতই হাস্যকর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন, তাতে আখেরে লাভ হচ্ছে রাহুলেরই৷
এবারের ভোটে বড়সড় প্রভাব ফেলতে চলেছেন তরুণ ভোটাররা৷ তা আঁচ করেই নানা টোপ দিতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতারা৷ ব্যতিক্রম নন প্রধানমন্ত্রীও৷ এখন শুধু ৪ জুনের অপেক্ষা৷