বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার কথা স্মরণ করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন’ তার যাত্রা শুরু করল। কিন্তু কবেতক এই ট্রেন তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে তা এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কারণ এই ট্রেন যে জায়গা দিয়ে যাবে তার বেশির ভাগ অংশে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়নি। এই নির্বাচনী ট্রেন তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগতে পারে। রেললাইন বসানোর কাজ যত দ্রুত হবে, ততই নির্বাচনের কাজ ত্বরান্বিত হবে।
নোবেল জয়ী ইউনূসের এই ‘হেঁয়ালিতে’ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে বেশ কয়েকদিন আগেই নির্বাচন ত্বরান্বিত করার দাবি জানিয়েছিল এই দল। তাঁর এই হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে বিএনপি নেতাদের মনে হচ্ছে ইউনূস তাঁর এই পদ আঁকড়ে ধরে থাকতে চান অনেকদিন। নির্বাচন করতে যে নানা গড়িমসি করছেন, তা তাঁর মন্তব্যে বোঝা যায়। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনের আগে তাঁর অনেক কাজ করতে হবে। তা হল সংস্কারের কাজ। গত গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের যে বিপুল সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে, তা আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে। তাঁর প্রধান কাজ শুধু নির্বাচন নয়, ‘গণতন্ত্রের ভিত্তি’ স্থাপন।
তাঁর অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁকে যে কোনও প্রকারেই হোক বাংলাদেশে নিয়ে এসে তাঁর উপযুক্ত বিচার করা। শুধু তিনি নন, তাঁর সহযোগী আওয়ামি লিগ নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রীরা যাঁরা এখন পালিয়ে রয়েছেন, তাঁদেরও বিচারের মঞ্চে এনে দাঁড় করানো। তাছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে, দেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা— তার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হবে। ইউনূস আরও বলেন, হাসিনা একজন স্বৈরাচারী। দেশকে ধ্বংস করে এখন সে ‘ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছে’। তাঁর অপরাধের বিচার না করে তিনি পদ ছাড়বেন না। আমরা আইনের পথেই হাসিনাকে দেশে নিয়ে এসে বিচারের ব্যবস্থা করব।
বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, সংবিধান সংশোধন করা ইউনূসের কাজ নয়, সেটা করবে নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, সেই সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হল দেশের আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক উন্নতি করে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তদারকি সরকারের কাজই হল দেশে যে অরাজকতা চলছে, যেভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটছে, তার অবসান করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। জামায়াত ইসলামি, মৌলবাদী এবং পাকিস্তানপন্থী দলও তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়। নির্বাচনে জেতা দল ক্ষমতায় আসবে, সেই দল প্রয়োজনে বিচার, সংবিধান সংশোধন এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ করবে।
ইতিমধ্যে ইউনূস খানের তদারকি সরকার দু’টি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। তার একটিতে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কেউ অবৈধ সরকার বললে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যটিতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ আদালতের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে আওয়ামি লিগ এবং তার ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে তদারকি সরকার। কিন্তু বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষপাতি তাঁরা নন। বরং নির্বাচন যখন হবে, তখন এই দলকেও ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত। গত ১৫ বছরের শাসনে শেখ হাসিনা দেশের যে ক্ষতি করেছেন, দেশের সম্পদ, অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, তা জেনেও যদি বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামি লিগের প্রার্থীদের ভোট দেন, তাহলে তাঁদের কিছু করার নেই। তবে তাঁরা চান না এই দল নিষিদ্ধ হোক। কিন্তু বিএনপি দলের নেতাদের একটা বড় অংশ চায় এই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক তার অপকর্মের জন্য।
দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, যখন ইউনূস তদারকি সরকারের প্রধান হলেন, তখন তিনি বলেছেন বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চান না। আবার বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেছেন, যে ইউনূস খান ৭৫ বছর বয়সেও ব্যাঙ্কের এমডি’র পদ ছাড়তে চান না, তিনি এখন তদারকি সরকারের প্রধান হিসেবে অনির্দিষ্ট কাজের জন্য থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়।
তদারকি সরকারের প্রধান আবার বলেছেন, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল যদি চায় নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, তার জন্য তিনি রাজি আছেন। তবে সংস্কার না করে নির্বাচনের পক্ষপাতি তিনি নন। তাহলে আবার অরাজকতা ফিরে আসবে।