আরজি করের বৈপ্লবিক প্রতিবাদ আকস্মিক নয়, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিস্কোরণ

স্বপনকুমার মণ্ডল

জল থিতিয়ে না এলে তার গভীরতা বোঝা দায় । উষ্ণতায় ফেনা দেখে তার গভীরতা অনুমান করলেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক । এজন্য শীতলতায় সেই ফেনা কেটে গেলেই তার তলদেশের গভীরতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । ঘটনার আকস্মিকতায় যেভাবে আরজি কর কলেজ ও হসপিটালে ধর্ষণ ও খুনের রহস্যময় নৃশংস দুর্ঘটনার কথা জানাজানি হতেই জনসাধারণের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ রাজ্য থেকে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে,তার রেশ তো কমেইনি, বরং উল্টে ন্যায়বিচারের দাবিতে তা তীব্রতর গতিতে ক্রমশ  সম্প্রসারিত হয়েই চলেছে । সেখানে We want justice মুখরিত জনস্রোত কূলভাঙা গতিতে যেভাবে গণআন্দোলনের রূপ লাভ করেই চলেছে,তা এতদিনের রাজনৈতিক দলের ছকবন্দি প্রতিবাদী আন্দোলনের ধারণাকেও ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের তীব্র জনস্রোত। ইতিপূর্বে রাজনৈতিক দলের প্রবল প্রতাপের কাছে জনসাধারণের নিজস্ব ভাষা কখনও ঐক্যবদ্ধ ভাবে মাথা চাড়া দিতে পারেনি, প্রতিবাদের দায়ও দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার স্বাভাবিকতায় সেই রাজনৈতিক দলগুলিই জনগণের গণকণ্ঠ হয়ে উঠেছে । মোদ্দা কথা দলগুলোই জনগণের প্রতিবাদের ঠিকা নিয়েছে মনে হবে।

প্রতিবাদবিমুখ ভয়ার্ত মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদে সামিল না হয়ে অন্যায়-অবিচারকে মুখ বুঝে সহ্য করে বেঁচে থাকার অভ্যাসকে যত আয়ত্ত করেছে,ততই তার প্রতি দলীয় দাসত্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছে । সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের প্রতিবাদকে নিজেদের স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করেনি,প্রত্যেক দলই জনগণের স্বার্থের কথা বলে আখেরে নিজেদের স্বার্থকেই সুরক্ষিত করেছে। শুধু তাই নয়,জনগণের মতামতকে দলগুলি নিজেদের ইচ্ছেমতো আরোপ করে জনগণ তাদের পাশে আছে বলে আত্মবিশ্বাস জাহির করে জনসাধারণকেই বিভ্রান্ত করে তুলেছে । শেষে নির্বাচনে দেখা যাবে বলে জণগণের প্রতিবাদ ভোটের ময়দানে নিঃস্ব করে দিয়েছে । সেদিক থেকে সরকারি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ও বিরোধী দলের পাতা ফাঁদকে অস্বীকার করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তথা আমজনতা যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী আন্দোলন সামিল হয়েছে,তা শুধু অভূতপূর্ব নয়, প্রতিবাদহীন সমাজে অভাবিতও। এভাবে দীর্ঘ দিন ধরে চলা গণআন্দোলন ইতিপূর্বে এই বাংলায় ঘটেনি।


৯ আগস্ট রাতে আরজি করে সেমিনার হলে একত্রিশ বছরের পোস্টগ্র্যাজুয়েটের শিক্ষানবিশ ডাক্তারি ছাত্রীর নৃশংস মৃত্যুর নারকীয় ঘটনা যখন ভোরের আলোয় জানাজানি হতে শুরু করে,সংবাদ মাধ্যমে তা অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । ময়নাতদন্ত থেকেই সেই মৃত্যুর নৃশংসতা প্রকট হয়ে ওঠে ও তা নিয়ে রহস্য ও গোপনীয়তা ক্রমশ জনমানসের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদ আন্দোলনে মূর্ত হয়ে ওঠে । আরজি কর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অসহযোগিতা,উপেক্ষা করার হেয় মানসিকতা থেকে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর ঘনঘটা থেকে আসল ঘটনাকে সরকারি ভাবে চেপে দেওয়া বা অপরাধীদের বাঁচানোর সন্দেহে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যেই সেই হসপিটালে একদল দুষ্কৃতী ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালিয়ে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে স্বাভাবিক ভাবেই জনগণেল ক্ষোভবিক্ষোভের বিস্কোরণ থেকে যে অভূতপূর্ব সরকারবিরোধী প্রতিবাদী গণআন্দোলন ধেয়ে এসেছিল,তাই ক্রমশ দেশ-দেশান্তরে তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে । সেই প্রতিবাদ কত তীব্র ও প্রভাবশালী ছিল, ১৪ আগস্টে মেয়েদের রাত দখলের অভিনব বৈপ্লবিক প্রয়াসের বিপুল সাফল্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে ।

শুধু তাই নয়, সেখানে বিচারের দাবিতে ঘটনার পর থেকে সেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ অবস্থান ও আন্দোলন যেভাবে দীর্ঘস্থায়ী নাছোড় প্রকৃতিতে এগিয়ে চলেছে,তাও অভাবিত ঐতিহাসিক ঘটনা। সাধারণত সময়ান্তরে জনরোষ কমে আসে,আন্দোলের গতিও শিথিল হয়ে পড়ে। অথচ সেক্ষেত্রে সরকারের সময়ের প্রতীক্ষায় জল ঢেলে যেভাবে সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের ক্রমশ আরও গতি লাভ করে লক্ষ্যভেদী সক্রিয়তায় মেতে উঠেছে,তা কোনও দলীয় রাজনীতির সক্রিয় সংযোগকে বড় করে দেখলে ভুল হবে। বিরোধী দলের যোগসাজশে আন্দোলনের বাড়বাড়ন্ত বলে গণআন্দোলনকে অস্বীকার করা বা ছোট করে দেখার মধ্যে সরকারি উপেক্ষাও জনমানসে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও সক্রিয় রেখেছে। সরকারের ঔদ্ধত্যে অন্ধত্ব অনিবার্য । সেখানে বিরোধী দলের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে সরকারের জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতাও অস্বাভাবিক নয় । সেখানে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর যে জনকণ্ঠেরই,তার বিশ্বাসে সরকারের অনীহা বর্তমান । আসলে দলীয় নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের বাইরে গণতন্ত্রের নামে চলা দলতন্ত্রে জনগণের স্বাধীন কণ্ঠস্বর থাকতে পারে না,থাকলেও তা কখনওই জোরালো হয়ে ওঠে না।

সেখানে এভাবে দিকদিগন্তে যেভাবে জনগণের বিভিন্ন স্তরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী মিছিল রাস্তায় নেমেছে, নানাভাবে ক্ষোভবিক্ষোভের আন্দোলনকে সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে মরীয়া হয়ে চলেছে,তা তো শুধু দলীয় বা সাংগঠনিক ভাবে সম্ভব নয়। সরকারের পাশে থেকে রাজ্যের জনগণ অনেকাংশেই সরে এসেছে,তার পরিচয় নানাভাবে বেরিয়ে পড়েছে । সেখানে সরকারি পদক্ষেপে এই আন্দোলনকে দমনপীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করা কখনওই আর সম্ভব নয়। অন্যদিকে এই প্রতিবাদী আন্দোলনও আকস্মিক নয়। মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভবিক্ষোভ, প্রতিবাদের বিস্কোরণই সময়ের প্রতীক্ষায় ছিল মাত্র। দেওয়ালে পিঠ অনেক আগেই ঠেকেছিল । প্রতিবাদহীন সমাজে যখন সুবিচার প্রত্যাশা অলীক কল্পনা হয়ে ওঠে, মুখ বুঝে থাকতে থাকতে মনের আর সাড়া পায় না,তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষও ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণঘাতী অন্যায়ের বিরুদ্ধে মরীয়া হয়ে রুখে দাঁড়ায়,সজোরে তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে । সেখানে আরজি করের নৃশংসতা সেই মানুষের মূক মুখে সজোরে ভাষা জুগিয়েছে, মেরুদণ্ডকে সোজা করে প্রতিবাদে সক্রিয় করে তুলেছে ।

অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের অভিশপ্ত জীবনই বলে দেয় তারা কোনও কালেই ভালো ছিল না। কন্যা,বধূ, মাতার ছকবন্দি জীবনে তার পরাধীন অস্তিত্বে তাদের কোনও নিজের ঘর নেই। আজীবন উদ্বাস্তুর মতো তাদের ঘর খুঁজে যেতে হয়। নারীকে যেটুকু সম্মান দেওয়া হয়েছে,তার মধ্যেও রয়েছে শৃঙ্খলিত সামাজিক শোষণ-শাসন। মেয়েকে মা বলে কাছে টেনেও দূরে ঠেলে দিয়ে সতী,সাধ্বীর চেতনায় বন্দি করা হয়েছে, দাসী থেকে দেবীতে উত্তরণ করে তার মানবী সত্তাকে উপেক্ষা আর অবজ্ঞায় অস্বীকার করা হয়েছে । দাসী বললে যেমন তার মানব সত্তাকে খাটো করা হয়, তেমনই দেবী বললে সেই সত্তাই অস্বীকৃত হয়। সেখানে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব শূন্যের মতো সংখ্যার সামনে মূল্যহীন হয়ে ওঠে । পুরুষের সহযোগীতেই তার কৃতিত্ব বিঘোষিত।

উনিশ শতকের আধুনিক পরিসরে নারী জাগরণে যে বীরাঙ্গনার পরিচয় উঠে এসেছিল,তার মধ্যেও তার বীরত্ব ঘরের বাইরে যেতে পারেনি। প্রমীলার বীরত্ব ‘রাবণ শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী’র পারিবারিক অস্তিত্বেই প্রতীয়মান । আসলে পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে জননীর রাজসিংহাসন বসিয়ে আদতে ধাত্রী আসনে ঠাঁই দিয়েছে, দেবী বানিয়ে তার মানবিক অস্তিত্বকেই বিপন্ন করেছে । পুরুষের আধিপত্যকামী শক্তির কাছে অসহায় নারী শুধু পরাধীন নয়, তার জীবনটাই পুরুষের জীবন্ত ভোগ্যপণ্যের শিকার হয়ে উঠেছে । সেবাদাসী থেকে উর্বর্ষীতে তা বিস্তার । আধুনিক বিশ্বে নারীদের অধিকার নিয়ে যতই আন্দোলন সোচ্চার হয়ে উঠুক, তার প্রতি মানবিক দৃষ্টির অভাব এখনও প্রকট। বিশ্বায়নের পণ্যসভ্যতায় নারীদের বিপন্ন জীবন যেখানে চোখের সামনেই স্বাভাবিকতা লাভ করে, তাদের নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতাই আধুনিকতার শিরোপা পায়, সেখানে পুরুষের কামনাবাসনা চরিতার্থতায় প্রমিলাদের নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করে। যেখানে নারীকে মানুষ বলেই স্বীকার করে না পুরুষশাসিত সমাজ,সেখানে তার প্রতি পাশবিক দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে ।

আধুনিকতার সোপানে নারীর অধিকার সচেতনতা বেড়েছে,শিক্ষাদীক্ষার বিস্তৃতি ঘটেছে,স্বনির্ভরতা এসেছে,কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিম বন্যতা একই থেকে গেছে আজও । এজন্য নারীদের খুনের সঙ্গে ধর্ষণের যোগ এত নিবিড় । ধর্ষণ তো শুধু শারীরিক ভাবে নিগ্রহ নয়,তার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তার অস্তিত্বকে করা। সেখানে ধর্ষণও খুন হয়ে ওঠে । আবার খুনের নেপথ্যেও থাকে ধর্ষণে বাধা থেকে প্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্র । শুধু তাই নয়, নারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধেও ধর্ষণের ভয়ঙ্কর পরিণতি নেমে আসে। সেখানে নারীর ক্ষেত্রে খুনের সঙ্গে ধর্ষণের যোগ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে। আরজি করের ক্ষেত্রে ধর্ষণ করে খুন থেকে খুন করে ধর্ষণের বিষয়টি উঠে রহস্যময় হয়ে উঠেছে । সেখানে যে রাত পুরুষকে পশু করে তোলে,নারীকে করে তার শিকার,সেই রাতের দখলেই ১৪ আগস্টে নারীদের ভূমিকা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ৯ আগস্টের ঘটনা যে সমাজজীবনকে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে,১৪ আগস্টের বৈপ্লবিক ঘটনাই তার প্রমাণ । ফেসবুকের একটিমাত্র পোস্টে ১৪ আগস্টের রাত শেষ হওয়ার আগে রাত দখলের আহ্বান সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাজ্য থেকে দেশ-দেশান্তরে নারীর পাশাপাশি পুরুষের হাতে সম্মিলিত ভাবে আলো জ্বলে ওঠে,তা তো প্রদীপ বা মোমবাতির অথবা মোবাইলের আলো নয়, একান্তভাবেই মন ও মননের আলো। উনিশ শতকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল যেমন নার্সের সেবার আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আরজি করের সেই তিলোত্তমা নিজের জীবন দিয়ে মানুষের মন ও মননে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। সেই আলো সুবিচারের মাধ্যমে দিনের আলোতে মিশে যেতে যত সময়ই লাগুক,আমরা প্রস্তুত । সেখানে ‘আরজি করের মতো করে দেব’র অন্ধকারের আতঙ্ক নয়,’আরজি করের মতো সুবিচার হবে’র আলোকিত আস্থা অন্ধকার মনে জেগে ওঠার প্রতীক্ষায় আমরা। রাস্তা তার যতই দুর্গম ও সুদূরপ্রসারী হোক,পথিকের আত্মবিশ্বাসের কাছে তা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র । দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত প্রতিবাদ আরজি করের নৃশংসতায় বেরিয়ে এসেছে মাত্র । সেক্ষেত্রে জনকণ্ঠের প্রতিবাদের অনির্বাণ দীপশিখা নেভায় কার সাধ্যি!