শ্যামল ভট্টাচার্য
১৯শে আগস্ট রাত থেকে এখন পর্যন্ত ত্রিপুরা ও পূর্ব বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ত্রিপুরায় ২৪ জন আর বাংলাদেশে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ অসংখ্য মানুষ। ভেসে গিয়েছে কয়েক লক্ষ গবাদি পশু। এটি ত্রিপুরায় গত পাঁচ দশকের ভয়াবহতম বন্যা। ত্রিপুরায় ১৭ লক্ষ ও বাংলাদেশে ৩৬ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এই বিপর্যয়ের বিস্তৃতি ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে, মানুষের দুর্ভোগের সীমা-পরিসীমা নেই। বিদ্যুৎ না থাকায় অচল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। বেশিরভাগ মানুষের ঘরে শুকনো খাবারও নেই। যাঁদের বাড়ি ডুবে গেছে, তাঁদের উদ্ধার করতেও বেগ পেতে হচ্ছে ভারতের এনডিআরএফ, এসডিআরএফ ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের। ত্রিপুরায় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মুহুরী নদীর অববাহিকায় এই বন্যার শুরু। এখন তা গোমতি, তিতাস ও খোয়াই নদী ছাড়িয়ে সমগ্র ত্রিপুরার সমতল এলাকা এবং বাংলাদেশের পুরো পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে ভয়ানক আকার নিয়েছে!
অতীতে বাংলাদেশে মুহুরী নদীর জল ‘নির্ধারিত বিপদসীমা’ ছাড়িয়েছে বহুবার। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে গত দুই দশকে তৃতীয়বারের মতো এমনটা হলো। ২০১৭ সালে একবার, সেটা ছিল কার্তিকের মাঝামাঝি, ২০০৪ সালে জলসীমা বাংলাদেশের পরশুরাম পয়েন্টে সর্বকালের রেকর্ড সীমায় পৌঁছে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও ত্রিপুরায় তেমন সমস্যা হয়নি।
এবছরের চিত্রটা ভিন্ন। বাংলাদেশে এবার এই নিয়ে তৃতীয়বার জলের উপরিতল বিপদসীমা পার করেছে। ২ জুলাই একবার, ২ ও ৩ আগষ্ট দ্বিতীয়বার বিপদসীমা পার হয়েছে। এবার ভাদ্র মাসে এসে তৃতীয়বার! এবার ত্রিপুরা ও পূর্ব বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট থেকে একনাগাড়ে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। এরকম ঢল ও বৃষ্টি নাকি, বয়স্করাও আগে কখনও দেখেননি।
এবার প্রশ্ন হলো, এবছরের আগের দুবারের বন্যার সময় ত্রিপুরায় কোনও বাঁধ কি খুলে দেয়া হয়েছিল? এটি কি মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা? উত্তর হল, জলবিদ্যুৎ বাঁধের জল বর্ষায় ছেড়ে দেয়া রুটিন কাজ, তার ফলে নদীর ‘স্টেজ’ বা উপরিতলের জলপ্রবাহের উচ্চতা খানিকটা বাড়ে, কিন্তু তা ব্যাপক বৃষ্টি না হলে এককভাবে ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি করতে পারে না। তাছাড়া ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতি অনুযায়ী গত ২১ আগস্ট দুপুর ৩ টে পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান বন্যার প্রবণতা দেখানোর ডেটা বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, সন্ধ্যে ৬ টায় বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। যার ফলে যোগাযোগে সমস্যা হয়। তবুও, ভারত তথ্যের তাৎক্ষণিক প্রসারণের জন্য ডিজাইন করা অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
একে তো বৃষ্টিজনিত জলের প্রাবল্য, আবার অন্যদিকে সমুদ্রের স্টেজ সবচাইতে উঁচুতে থাকায় সেই জল সমূদ্রে নেমে যাওয়ার অবকাশ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বড় বন্যা অবশ্যম্ভাবী।
বাংলাদেশ ও ভারত সরকার প্রকাশিত ও গণমাধ্যমের তথ্যসূত্রাদি অনুসারে, উল্লিখিত তারিখ ও আগের দিনগুলোয় ত্রিপুরায় ও পূর্ব বাংলাদেশে ব্যাপক বৃষ্টি নদীর জলের উপরিতল বিপদসীমা পার করে তিনবারই বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা ঘটিয়েছে। আগের দু’বারে অবশ্য জল যত দ্রুত উঠেছে, ততই দ্রুত নেমেছে।
কিন্তু এবার এবছরের আগের দু’বারের মতো দ্রুত নামেনি। কারণ, প্রবল বৃষ্টি। খেয়াল করুন, এবছরের আগের দুটি বন্যার তারিখে না ছিল পূর্ণিমা, না অমাবস্যা। মুহুরী নদী ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের পরশুরামে ঢোকার পর মাত্র ৩০-৩২ কি.মি. পথ সোজা দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পরে। এত কাছে সমুদ্র হওয়ায় সমুদ্রের উপরিতল ঠিক করে দেয়, জল-নিষ্কাশনের হার কতটা দ্রুত হবে।
ভাদ্রের ভরা- কোটালে সমুদ্রের উপরিতল অগ্ৰহায়ণের মরা-কোটালের তুলনায় সমুদ্রের মুখে ২.৪৩ মিটার বেশি উচ্চতায় থাকে, তাই নদীর জল এই উত্থিত জলস্তম্ভে বাঁধা পায়, সেজন্যই নামতে দেরী হয়। ১৯ আগষ্ট ছিল পূর্ণিমা। তাই তিনদিন জল নিষ্কাশনের হার ছিল খুবই অনুল্লেখ্য। তিনদিন পর ২৩ আগস্ট রাত থেকে জল নিষ্কাশনের হার দ্রুততর হয়েছে।
গোমতী ত্রিপুরার বৃহত্তম নদী। গোমতীর একা কোনও উৎসমুখ নেই। একাধিক ঝর্নাপ্রতিম ধারা এসে এক হয়ে গোমতী নাম নিয়েছে। গোমতী পাহাড় থেকে এসে যেখানে একটু সমতলভূমিতে পড়েছে সে জায়গার নাম তীর্থমুখ। তীর্থমুখেই ডম্বুর বাঁধ তৈরি হয়েছে ১৯৬৮ সালে। এই বাঁধ দেওয়ার উদ্দেশ্য দু’টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ। শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হত তিনটি টারবাইনে তিন করে মোট ৯ মেগাওয়াট। ক্রমে মানুষের লোভে বন ধ্বংস ও পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে এখন বাঁধে তেমন জল থাকে না, তাই একটি টারবাইন কোনওমতে চলে, তাতে ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণেও ডম্বুর অত্যন্ত কাজে এসেছে। একদা কুমিল্লার দুঃখ বলা হত গোমতীকে। ডম্বুর থেকে ধলাই, গোমতী এবং সিপাহিজলা জেলার অন্তত দু’শো ছোটোবড়ো জনপদ ও করবুক অমরপুর, উদয়পুর, কাঁকড়াবন, মেলাঘর, সোনামুড়া শহর হয়ে গোমতী বাংলাদেশে গিয়েছে। ভারতীয় অংশে গোমতীর ক্যাচমেন্ট এরিয়া ২,৪৯২ বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে কেবল ৫৭১ বর্গকিলোমিটার সমতলে, বাকিটা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। ভারতীয় অংশে গোমতীর দৈর্ঘ্য ১৬৭.৪ কিলোমিটার।
ডম্বুর থেকে নেমে এলে একেবারেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের নালার মতো গোমতীর উপনদী একছড়া, হাতিছড়া, গঙ্গাছড়া, পিত্রাছড়া, ছনগাঙ, মৈলাকছড়া, সুরমা ছড়া এবং কাচিগাঙ ডম্বুর প্রকল্পের নিম্নধারায় গোমতীতে মিশেছে। সুতরাং এরা বাঁধের আওতায় আসেনি। বাঁধের ফলে যে জলাধার তৈরি হয়েছে তার আয়তন ৪০ বর্গকিলোমিটার। গড় গভীরতা ৩০ মিটার।
ডম্বুর থেকে ৫০ কিলোমিটার নীচে এসে গোমতীর উপরে একটি কৃষিবাঁধ আছে মহারানিতে। সেখান থেকে দুপাড়ে বহু ক্যানাল তৈরি করে দূর দূর কৃষিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি একটা উচ্চতার পর খোলা, তাকে ছাড়াবাঁধার বিষয় নেই।
ডম্বুর প্রকল্পের মূল জলাধার থেকে বাঁধের পাশ দিয়ে ক্যানাল দিয়ে নিয়ত জল মূল গোমতীতে এসে পড়ে। আর টারবাইন ঘোরাতে বহু ওপর থেকে বিশাল পাইপ দিয়ে জল আনা হয়। সে জল টারবাইন দিয়ে আপনি বেরিয়ে যায়। বাঁধটি কম খরচে করবার জন্য দুই পাহাড়ের মাঝখানে করা হয়েছে। উচ্চতা ৯৪ মিটার। তার বেশি হলে জল উপচে বেরিয়ে যায়। ত্রিপুরাতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২০০০ মিমি। এবার সাতদিনে হয়েছে ৮০০মিমি। জুন মাসে বর্ষা শুরু হওয়ার পর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ের আগেই এসব বাঁধ জলে পরিপূর্ণ ছিল। ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০শে আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ডম্বুর বাঁধের ধারণক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায় এবং ২০শে আগস্ট রাতে বাঁধের গেট খুলে দিতে বাধ্য হয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশকে আগে সতর্ক করা হয়নি, এই ধারণা ঠিক নয়।
ডম্বুর স্লুইস গেট খোলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল হওয়ার পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত জেলাগুলিতে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে হয়েছে- এই দাবি বাস্তবে সঠিক নয়।’
বিদেশ মন্ত্রক আরও বলেছে যে, ‘ আমরা উল্লেখ করতে চাই যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর ক্যাচমেন্ট এলাকায় গত কয়েক দিনে এই বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা প্রধানত বাঁধের নিচের দিকের এই বৃহৎ ক্যাচমেন্টের জলের কারণে হয়। ডম্বুর বাঁধ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে।’ প্রকৃতপক্ষে অতিবৃষ্টির কারণেই ফেনীসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় কেবল ভারতের ‘বাঁধ খুলে দেওয়ার’ বিষয়টিকে কটাক্ষ করেছেন।
তাঁদেরকে সবিনয়ে বলি, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মানচিত্রকে ভালভাবে দেখুন। দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার দুটি নদী। মুহুরি এবং ফেনী। এদের সঙ্গে গোমতীর কোনও সম্পর্ক নেই। এরা ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশ ঘুরে আবার ত্রিপুরায় ঢুকে আবার বাংলাদেশের দিকে গিয়েছে। এমনিতে সীমান্তবর্তী সাব্রুম এবং বিলোনীয়া শহরে সারাবছর তীব্র জলাভাব থাকে। এই দুই নদী থেকে জল তুলে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করে দুই শহরের মানুষের পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে চায় ভারত। বাংলাদেশ তাতে রাজি নয়। ফলে তীব্র জলসংকটে ভুগতে হয় এই দুই শহর ও আশেপাশের প্রায় লক্ষ মানুষকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল-নিনো, জেট স্ট্রিম, বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি লঘু চাপসহ বেশকিছু প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময়ে সক্রিয়ভাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে উঁচু এলাকাগুলো থেকে নেমে আসা ঢলই আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করেছে। জলস্তর ৪২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। জল না ছাড়লে ডম্বুর বাঁধ ভাঙতো, আরও বড় বিপর্যয় ঘটতো। এ কথা মানলেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
১) বৃষ্টি যে ভয়াবহ হবে, তা আবহাওয়া দপ্তরের অ্যাপ সাত দিন আগে থেকে বলছিল। তখন বাঁধের জল ছেড়ে খালি করা হল না কেন?
২) কিছুদিন আগে ডিভিসি আগে থেকে না বলে জল ছাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির ভয়াবহতা আগাম না জানানোয় কেরালার ওয়েনাদে ৪০০ মানুষ মারা গেছে। কবে থেকে আবহাওয়া ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হবে আমাদের দেশ?
৩) বাঁধ বানালেই হয় না। নদীর বুক থেকে পলি সরাতে হয়। জল ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হয়। না হলে বন্যা অবধারিত। নদীর গর্ভ খালি করার কাজ, ডি-সিল্টেশন, দুই দেশেই কার্যত হয় না। লোভের চোখ তাকিয়ে থাকে চর আর নদী ভরাটের জমির দিকে।
আজকের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতির রোষের পাশাপাশি দায়ী এই ভুল বাঁধ ও নদী ব্যবস্থাপনা।
(ঋণ : বাংলাদেশের জলবায়ু বিজ্ঞানী আহসান উদ্দিন আহমেদ, ত্রিপুরার কবি ও কথাসাহিত্যিক অশোক দেব এবং সাংবাদিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য।)