• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

‘কোটা ফ্যাক্টরি’ বহন করছে উচ্চ শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের দুই তৃতীয়াংশ

পর্দার আড়ালে তখন চলছে রাজনীতির কারবারি আর শিক্ষার পাটোয়ারিদের মধ্যে এক অসুস্থ আঁতাঁত, আর্থিক দেওয়া-নেওয়ার যোগসাজশ। শিক্ষা ও শিক্ষার্থী, দুই-ই এই ‘চক্রে’ ঘুরে মরছে।

রাজস্থানের শহর কোটা-র নাম শোনেননি, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়া সন্তানের উচ্চ মধ্যবিত্ত মা-বাবাদের মধ্যে এমন লোক বিরল। একটা শহর, যার অর্থব্যবস্থা বহুলাংশে দাঁড়িয়ে আছে আইআইটি-র প্রশিক্ষণের কোচিং সেন্টারের উপর। কোটায় শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসার পরিমাণ বছরে ৬০০০ কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর সেখানে নাম লেখায় গড়ে দু’লক্ষ পড়ুয়া, শ্রেষ্ঠ হওয়ার লড়াইয়ে। প্রতি দিন তৈরি হয়ে চলে সেই পরীক্ষার জন্য, এক বার যে বৈতরণি পার করতে পারলেই অনন্ত সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকবে। ‘সফল’ বলে চিনবে লোকে।

তবে, মাসকয়েকের পুরনো সরকারি তথ্য বলছে, ‘কোচিং ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া’ কোটায় গত চার বছরে আত্মহত্যা করেছে ৫২ জন পড়ুয়া। এই সংখ্যা এখন বেড়েছে। দেখা গিয়েছে, আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে প্রথম সারিতে জায়গা করেছে ঠিকঠাক রেজ়াল্ট করতে না পারা, অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ার ভয়। কারণের তালিকায় উপরে রয়েছে মা-বাবার প্রত্যাশা পূর্ণ না করতে পারার হতাশা, শারীরিক ক্লান্তি, মানসিক ক্লেদ।হেরে যাওয়ারাই অবশ্য একমাত্র নয়। দু’তিন বছর একনিষ্ঠ সাধনার পরে সোনার মুকুট পরে বেরিয়ে আসে কিছু ছাত্রছাত্রী। আমরা সেই বিজয়ীদের দেখি। সমাজ দেখে। পাড়া দেখে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় যে বিজ্ঞাপনগুলো বেরোয়, অনেক ছবির শেষে সেখানে স্থান পায় কয়েকটা শূন্য ফ্রেম। নীচে লেখা থাকে, আমাদের ছাতার তলায় এলে পরের বছর এখানে ছাপা হতে পারে তোমার ছবিও। মা-বাবারা সেই বিজ্ঞাপন দেখেন। আর, আশার আঁকশি দিয়ে গেঁথে ফেলেন সন্তানসন্ততিকে। সেই সন্তানদের মধ্যে যারা পারে, তারা পারে। আর যারা পারে না, তাদের মধ্যে কেউ মধ্যরাতে ঘরের দরজা এঁটে জীবন শেষ করে ফেলে। দু’চার দিন পরে গন্ধ বেরোয়। ঘরের দরজা ভাঙা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি কোচিং সেন্টারের সবার আগে প্রয়োজন অভিজ্ঞ মনোবিদের। যারা ইঁদুরদৌড়ে শামিল হতে পারছে না ঠিকঠাক, তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলা প্রয়োজন। যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি এঞ্জিনিয়ারিং নয়, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চেয়েছিল, অথবা নাটক করতে চেয়েছিল, তাদের কোচিং-এর জাঁতাকল থেকে মুক্তি জরুরি। আশাহত বহু বাবা-মা শেষ অবধি মেনেছেন যে, সন্তানের মনের খবর জানতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন প্রতি দিন। শেয়ার মার্কেটের রিপোর্টের মতো তাঁদের মোবাইলের পর্দায় রোজ সকালে হাজির হয়েছে ছেলেমেয়ের উন্নতির গ্রাফ। কিন্তু সন্তানের আখেরে কিসে ভাল, তা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি কোচিং সেন্টারের কেউ।কত জন পড়ুয়া স্বেচ্ছায় দু’তিন বছরের এই নির্বাসন মেনে নিয়েছে, আর কত জন বাধ্য হয়েছে নিছক বাড়ির চাপে— এ নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি না জানা নেই। জানা উচিত। খবরে পড়েছি, আত্মহনন করা এক ছাত্রের ঘর থেকে নাকি শেষের কয়েক দিন, রাত্রিবেলা ভেসে আসত গোঙানির আওয়াজ, কান্নার শব্দ। মনের গভীরে গুমরে মরছে আরও অনেকেই। দেরি হয়ে যাওয়ার আগে ওদের কথা শোনা আমাদের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

বিমানে যাত্রা করে কোটায় পৌঁছতে গেলে আজও জয়পুরেই নামতে হয়। সেখান থেকে আরও সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। কোটায় বিমানবন্দর থাকলেও কম সংখ্যক যাত্রীর কারণে ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক উড়ান বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দরটি ফের চালু করা হবে কি না, তা নিয়ে তর্ক হয়। আন্তর্জালে দেখলাম, এক দল অভিভাবক বলছেন, “বিমান পরিষেবা চালু হলে ছেলেমেয়ের মুখগুলো ইচ্ছে করলেই দেখতে পাই। ওরা যে পড়ে পড়ে ক্লান্ত।” অন্য এক দল বলছেন, “এ সব ঠুনকো সেন্টিমেন্ট রাখুন তো মশাই! প্লেন চালু হলেই দুম করে বাড়িতে আসার বায়না করবে মাসে একটা শনিবার। এখন একটা দিনও পড়া নষ্ট করা চলবে না।” যুক্তির পিঠে যুক্তি চাপে। তর্ক বাড়ে তর্কে। শুধু পড়ুয়াদের মনের খবর শোনার চেষ্টা করে না কেউ।খবরে প্রকাশ, রাজ্যের বেসরকারি প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোকে লাগাম দেওয়ার জন্য রাজস্থান সরকার একটি বিল আনতে চলেছে। টপারদের মাথায় মুকুট পরিয়ে বিজ্ঞাপনের দিন নাকি শেষ হতে চলেছে দ্রুত। পড়ুয়ার মনের স্বাস্থ্য কেমন আছে, মনোবিদের তত্ত্বাবধানে তা নিয়মিত পরখ করতে বাধ্য থাকবেন প্রশিক্ষণ শিবিরের কর্তাব্যক্তিরা। মার্কশিটের পাশাপাশি তা শেয়ার করা হবে পড়ুয়ার পরিজনদের সঙ্গেও। বাস্তবে এই বিলের প্রয়োগ কতটা হবে জানি না। যে সন্তানের কপালে যুদ্ধজয়ের তিলক এঁকে কোটায় পাঠিয়েছেন, সেই ছেলে কিংবা মেয়ের মনের খবরে আগ্রহ থাকবে তো মা-বাবার? তারা ফিরে আসতে চাইলে হাসি মুখে দরজা খুলতে পারবেন তো, তাকে নিজেদের সমূহ পরাজয় না ভেবে?

জাতীয় শিক্ষানীতি যখন চালু হল, একপ্রস্ত কথা উঠেছিল দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ কোচিং সেন্টারগুলি নিয়ে। সেই সব কোচিং সেন্টার, ভারতের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী যেখানে পড়তে আসেন স্বপ্ন নিয়ে: ডাক্তারি এঞ্জিনিয়ারিং-সহ প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন, দেশের নামীদামি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন। বলা হয়েছিল, জাতীয় শিক্ষানীতি এই কোচিং সেন্টারগুলির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না। কাঁটা যে সত্যিই হয়নি, বরং কোচিং সেন্টারগুলির ছেলেমেয়েদের থেকে নেওয়া অর্থের ভাগীদার হচ্ছে সরকার, তার পরিমাণও বাড়ছে বছর বছর— প্রমাণ পাওয়া গেল সংসদে।

কোচিং সেন্টারগুলি ছাত্রছাত্রীদের থেকে যে টাকা নেয়, তার উপর ১৮% জিএসটি পায় সরকার। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কোচিং সেন্টারগুলি থেকে পাওয়া মোট জিএসটি-র সরকারি খতিয়ান দিলেন, সেই সূত্রে এই তথ্যও জানা গেল: ২০২০-২১’এ জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হওয়ার বছরে কোচিং সেন্টারগুলির ব্যবসা ছিল ১২,৩০৭ কোটি টাকার, চার বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০,৬৫৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি উল্লেখ করার, এ বছর বাজেটে উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থ ৪৭,৬২০ কোটি। অর্থাৎ কোচিং সেন্টারে পড়ুয়ারা ব্যয় করছেন বাজেট বরাদ্দের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান অর্থ! যে শিক্ষানীতিতে বুক বাজিয়ে বলা হয়েছিল স্কুল স্তর থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনে আসবে ‘ভিতর থেকে’ পরিবর্তন, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা হবে এমন যাতে দায়সারা যাচাই নয়, বিষয়ের স্পষ্ট ধারণা ও সার্বিক জ্ঞান লাভ হল কি না বোঝা যায়— এই কি তার পরিণাম?

কোচিং সেন্টারের ক্রমবর্ধমান রমরমা কি উল্টো কথা বলছে না? সর্বভারতীয় স্তরের ভর্তি তথা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলি একে তো কেন্দ্রের হাতে, আবার তার একটা বড় অংশ ‘এমসিকিউ’ পদ্ধতিনির্ভর। কোচিং সেন্টারগুলি বিপুল অর্থের বিনিময়ে, বজ্রকঠিন নিয়মের শিকলে পড়ুয়াদের বেঁধে সেই পদ্ধতি গিলিয়ে ছাড়ে। ছাত্রছাত্রীরাও জানে তাদের কাছে ওটুকুই প্রত্যাশিত এবং এ কাজ করাতে পারে শুধু কোচিং সেন্টারগুলিই। তাই পরিবারের যাবতীয় সঞ্চয়টুকু নিয়ে তারা হাজির হয়, ঘর বা হস্টেল ভাড়া করে থাকে, এক অমানুষিক চাপ ও প্রত্যাশার জাঁতাকলে নিজেদের সঁপে দেয়। তার পরিণতি আজ চোখের সামনে: কোটায় অগণন আত্মহত্যা, দিল্লিতে কোচিং সেন্টারের বেসমেন্টে বন্যার জল ঢুকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু। কোচিং সেন্টারের এই ‘শিক্ষা’চিত্র জাতীয় শিক্ষানীতির চরম ব্যর্থতার প্রমাণ। তা বুঝিয়ে দেয়, ভারতীয় ও বিশ্বশিক্ষা নিয়ে কেন্দ্র গত চার বছর ধরে যে বড় বড় কথা বলে আসছে তা কেবল কথার কথা, কার্যক্ষেত্রে কোচিং সেন্টারগুলি থেকে আসা ক্রমবর্ধমান জিএসটি-প্রাপ্তিযোগেই সে সন্তুষ্ট। আর কোনও অঘটন বা দুর্ঘটনা ঘটলেও দায় তার নয়, আইন-শৃঙ্খলা নজরদারির দায়িত্ব তো রাজ্য সরকারের।

কেন্দ্রের জাতীয় শিক্ষানীতি আসলে সেই যবনিকা, যার সামনে বসে থাকা দেশবাসী ভাবছেন না জানি কোন ভারতীয় ও বিশ্বশিক্ষার সুদূরপ্রসারী উদ্‌যাপন শুরু হবে চোখের সামনে। পর্দার আড়ালে তখন চলছে রাজনীতির কারবারি আর শিক্ষার পাটোয়ারিদের মধ্যে এক অসুস্থ আঁতাঁত, আর্থিক দেওয়া-নেওয়ার যোগসাজশ। শিক্ষা ও শিক্ষার্থী, দুই-ই এই ‘চক্রে’ ঘুরে মরছে।