কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম সম্প্রতি বলেছেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’— পুলিশ শুড অ্যাক্ট নাও’। ঠিক যেমন বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারি কর্মীদের উদাসীনতা দেখে বলেছিলেন, ‘ডু ইট নাও’। আর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘কাকে কাজের কথা বলব, চেয়ার টেবিলকে?’ এই দুই মুখ্যমন্ত্রীর একথা বলা সত্ত্বেও, সরকারি কর্মীদের কাজে ঢিলে দেওয়া অব্যাহত থাকে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁর অধীনে স্বরাষ্ট্র দপ্তর, কিছুদিন আগে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজ্যজুড়ে অভিযান চালিয়ে লুকনো অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করতে। তাঁর নির্দেশে কাজ হয়েছিল। পুলিশ রাজ্যের নানা স্থানে অতর্কিত হানা দিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও অন্যান্য মারণাস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল। কিছুদিন চলার পর পুলিশের সে কাজে ঢিলে পড়ে আর সেই সুযোগে এখন অনেক অস্ত্রশস্ত্র অন্য রাজ্যে বিসেষ করে বিহার থেকে কলকাতায় ঢুকছে। দুষ্কৃতীরা সেই অস্ত্র ব্যবহার করে খুন জখম চালাচ্ছে, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শোনা য়া? নানা মহলে। সম্প্রতি সোদপুরের একটি স্থান থেকে পুলিশ প্রচুর অস্ত্র, যা মজুত করা হয়েছিল, উদ্ধার করে।
অনেকের মুখেই শোনা যায় ‘পুলিশ পারে না, এমন কোনও কাজ নেই।’ কলকাতা পুলিশের ক্রাইম দমনে কৃতিত্বের পরিচয় দেখে তাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। সেই কলকাতা পুলিশের নজর এড়িয়ে বিহারের মুঙ্গের থেকে বহু অস্ত্র শহরে ঢুকছে বলে বলা হচ্ছে। অভিযোগ পুলিশ কোথা দিয়ে, কীভাবে এবং কী উপায়ে সেই অ্ত্র এখানে আসছে, তা ধরতে পারছে না। পরপর কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের সমালোচনা করেন শাসক দলের কোনও কোনও শীর্ষ নেতা যাঁরা তৃণমূলের সবদিক থেকে উন্নতি চায়। তবে পুলিশের একাংশ যে কাজে ঢিলেমির পরিচয় দিয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিরোধী নেতারাও পুলিশের এই ঢিলেমির সমালোচনা করেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসারদের দিয়ে একটি বৈঠকে বলেন, পুলিশের সব শাখাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। নীচুতলার পুলিশের কাজে অনীহা তিনি লক্ষ্য করেছেন। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে মানুষকে সেবা পরায়নতা দেখাবে। সেটাই মানুষ আসা করে পুলিশের কাছ থেকে। মুখ্যমন্ত্রী বৈটকে বলেন, পুলিশের একাংশের কাজে তিনি সন্তুষ্ট নন। রাজ্য পুলিশের সব শাখাকে আরও শক্তিশালী করার দায়িত্ব তিনি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন সিআইডিকে ঢেলে সাজানো হবে। কীভাবে, তার প্রস্তাবও তাকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন পুলিশের নীচুতলার কিছু কিছু কর্মী যে ভুলভ্রান্তি করছে, তা অবিলম্বে শোধরানো দরকার। অন্যায় করলে অথবা কাজে ঢিলেমি এবং গাফিলতির প্রমাণ পেলে সেই পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গে এই বৈঠকের পর পুলিশ প্রশাসন জেগে ওঠে। কয়েকজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, অপর একজনকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং পুলিশ যদি তার বা তাদের কর্তব্যে অবহেলা করে তার জন্য শাস্তি পেতেই হবে।
কলকাতা পুলিশের দু-একজনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলেও, কলকাতা পুলিশের সুনাম সুবিদিত। কলকাতায় কোনও আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজন হলে কলকাতা পুলিশ যেভাবে দর্শকদের কন্ট্রোল করে শৃঙ্খলার সঙ্গে, তা প্রশংসনীয়। দুর্গাপুজো এবং অন্যান্য পুজোয় কলকাতা পুলিশ দর্শনার্থীদের যে শৃঙ্খলার সঙ্গে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরার সাহায্য করে তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। সুতরাং কলকাতা পুলিশ সুনাম নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে। দু-একজন ভুরভ্রান্তি করলে সব পুলিশকে দোষী সাব্যস্ত করা অনুচিত। পুলিশ শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারক নয়, পুলিশকে মানবতারও পরিচয় দিতেও আমরা দেখি।
তবে পুলিশের প্রশিক্ষণ আরও উচ্চস্তরের হওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। নিয়োগের পর বারাকপুরের লাটবাগানে পুলিশের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়। কাজে ঢোকানোর পরও পুলিশকে মাঝে মাঝে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। তবে শহরে যেভাবে অন্য রাজ্য থেকে অস্ত্র ঢুকছে, তা বন্ধ করা অবিলম্বে প্রয়োজন। কারণ এই অস্ত্র দুষ্কৃতীদের হাতে যাচ্ছে এবং তার ব্যবহার হচ্ছে। কলকাতা ও বেঙ্গল পুলিশকে আরও কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী সেই নির্দেশই দিয়েছেন। আশা করা যায় এর আগে পুলিশ যেমন সারা রাজ্যব্যাপী অভিযান চালিয়ে অনেক লুকনো অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছিল, আবারও সেইরকম অভিযান চালিয়ে বাইরে থেকে যেসব মারণাস্ত্র শহরে ঢুকছে তা আসা বন্ধ করবে। গোয়েন্দা বিভাগকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। কারণ গোয়েন্দারাই পারে কোথা দিয়ে অস্ত্র শহরে ঢুকছে তার হদিশ দিতে।