সঙ্ঘের ছক প্রকাশ্যে

দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন আছে বলে দাবি করে ‘এক দেশ এক ভোট’ ববেস্থা চালু করার দিকে অগ্রসর হলো কেন্দ্রের মোদী সরকার। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সুপারিশ তৈরি করতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল দ্বিতীয় মোদী সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালীন। প্রত্যাশা মতোই সেই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মোদী-শাহ তথা বিজেপি-আরএসএসের পক্ষে সুপারিশ জমা দিয়েছিল সর্বশেষ লোকসভা ভোটের সূচি ঘোষণার ঠিক আগেই। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সেই সুপারিশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করল। গণতন্ত্রকে আরও প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

এদিকে, দেশজুড়ে সব ভোট একসঙ্গে করানোর প্রস্তাবকে সরাসরি নস্যাৎ করে বিরোধী দলগুলি বলেছে, ভারতের জন্য এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। সঙ্ঘ পরিবারের গোপন কর্মসূচি অনুযায়ী এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করার জন্যই এই প্রস্তাব আনা হয়েছে। ভারতকে রাষ্ট্রপতি প্রধান দেশে পরিণত করতে চাইছে শাসক দল। তাদের এই পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছে বিরোধীরা। অন্যদিকে সরকারের প্রস্তাবকে যথারীতি স্বাগত জানিয়েছে কেন্দ্রীয় শাসক জোট। তবে সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনেই বিলটি পেশ করা হবে কিনা, তার সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, তৃতীয় মোদী সরকারের মেয়াদেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হবে।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ আদৌ বাস্তবসম্মত প্রস্তাব নয়। এই প্রস্তাব কাজও করবে না। যখনই কোনও নির্বাচন আসে, তখনই বাস্তব সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতে বিজেপি এইসব প্রসঙ্গ তোলে।’ পরে খাড়গে তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ সংবিধানবিরোধী। দেশ কখনওই এই প্রস্তাব মেনে নেবে না।

সিপিআই পলিটব্যুরো সদস্য তথা কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ হলো দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য সঙ্ঘ পরিবারের গোপন কর্মসূচি। দেশের বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতিকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার বৈচিত্র্যময়তায় অন্তর্ঘাত চালানোর ছক কষেই এই স্লোগান তোলা হয়েছে।


ভারতের রাজ্যগুলিতে পৃথক পৃথক পরিস্থিতি, পটভূমিও ভিন্ন। রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র মাথায় না রেখে শুধুমাত্র যান্ত্রিকভাবে নির্বাচন করানো হলে এবং জনগণের মতামতে অন্তর্ঘাত চালিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়া হলে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। কেন্দ্রের চলতি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ‘এক দেশ এক ভোট’ বাস্তবায়িত হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তারপরেই প্রকাশ্যে এলো কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টে কেন্দ্রের অনুমোদন। এই অসম্ভব ও অবাস্তব ভাবনার এই প্রস্তাব আনা হচ্ছে রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব করতে। দেশজুড়ে একদলীয় শাসন চাপাতে চায় বলেই বিজেপির এই ভাবনা। সংবিধানের মূল কাঠামো গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এর ফলে ধ্বংস হয়ে যাবে।

কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টেই বলা হয়েছে, তিনটি রাজ্যের হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ‘এক দেশ এক ভোট’ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এর কুফল ব্যাখ্যা করেছেন। এঁরা হলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি অজিতপ্রকাশ শাহ, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন গিরিশচন্দ্র গুপ্ত এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব ব্যানার্জি। এছাড়াও তামিলনাড়ুর প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ভি পালানিকুমার সহ আরও অনেকে এই পদক্ষেপের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন।

প্রসঙ্গত রামনাথ কোবিন্দ কমিটির ৮ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জনই ছিলেন সরকার-সমর্থক। বিরোধীদের তরফে একমাত্র সদস্য তৎকালীন লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরী এই কমিটির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গঠন দেখেই পত্রপাঠ সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছিলেন। সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই কমিটির শর্তাবলী দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত। এই কমিটি পুরোটাই লোকদেখানো। যেভাবে সাংবিধানিক বৈধতা সম্পর্কে সন্দিহান, অবাস্তব এবং পরিকাঠামোর দিক থেকে রূপায়ণের অযোগ্য একটি ভাবনা আচমকা দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে সরকারের অসৎ উদ্দেশ্যই স্পষ্ট হচ্ছে।’

দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র দুর্বল করতে গেরুয়া বাহিনী ও আরএসএসের এই ছক এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে। সংবিধান রক্ষা করতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকেই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।