মধ্যরাতের শহর দখল আন্দোলন: সমাজের মানসিকতার বড় উত্তরণ

প্রবীর মজুমদার

১৪ আগস্ট মধ্যরাতে নারীরা কোনওরকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া যেভাবে রাজপথ অধিকার করার আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল  হলেন, এ ঘটনা অভূতপূর্ব এবং ঐতিহাসিক। হারিয়ে যাওয়া একটি পরিসর উন্মোচিত হল ঐতিহাসিকভাবে-রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে অতিক্রম করে “তৃতীয় পরিসর”। এ সম্ভাবনাকে পরম যত্নে, মমতায়, পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। একে যেন আমরা ধ্বস্ত না করি ।

১৪ আগস্ট মধ্যরাতে যাঁরা পথে হেঁটেছেন তাঁদের অনেকেই হয়তো কোনও নির্দিষ্ট দলের সমর্থক নন। দলহীন তবে তাঁদের রাজনীতিবোধহীন বলা যায় না। এই সময়কে যদি ক্রান্তিকালীন করতে হয়, তবে উদারমনস্কদের হাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকতে হবে। কে শঙ্খধ্বনি তুলবেন, কে বাঁশি বাজাবেন বা কে শিস দেবেন তাকে শাসন করার সময় এটি নয়। শঙ্খধ্বনি এই অঞ্চলের সংস্কৃতিরও অংশ। পথে নেমেছেন ভীত,  ক্রুদ্ধ মানুষ। গ্রামেগঞ্জেও নারীবাহিনি রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। এঁরা সকলেই হুইসল ব্লোয়ার। যাঁরা নামেননি, তাঁরা হয়তো পরের বার নামবেন। অথবা নামবেন না। কে নামলেন না, সেই হিসেব করে কী হবে?


বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিজস্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাঁরা তাঁদের মতো সংহতি জানিয়েছেন, অথবা জানাননি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভাল না লাগতেই পারে। আগের জমানাতেও এমন অনেক বিদ্বজ্জন, কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ছিলেন যাঁদের ভূমিকা বহু মানুষের পছন্দ হয়নি। সকলকে সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তিক্ততা সরিয়ে রেখে আন্দোলনে যোগ দিতে হবে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে। বিশাল  গণজোয়ারে সাত রঙের মানুষ আসবেন, সকলের দাবি এক নয়, অধিকারও সমান নয়। তাই তাঁদের নিয়ে চলতে গেলে নেতৃত্বকে, সংগঠকদের হতে হবে যুক্তিনিষ্ঠ, রাজনীতিসচেতন এবং অবশ্যই উদারমনষ্ক। শুধু কেতাবি কথা নয়, কখনও কখনও সাধারণ মানুষ বলে যাঁদের দেগে দিচ্ছি তাঁদের থেকেও জরুরিভিত্তিতে শিক্ষা নিতে হয়।

সমাজের মূল মেরুদণ্ড-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। আর জি কর একাধারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আরজিকরে শিক্ষানবীশ ডাক্তারের মৃত্যু সমাজের মেরুদণ্ডে আঘাত এনেছে। একজন এমডি পাঠরতা চিকিৎসকের কাছে এটা তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- দ্বিতীয় বাড়িও বটে। সেই শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষাক্ষেত্রেই ধর্ষিতা হয়ে খুন হচ্ছেন। এর কী ব্যাখ্যা হবে জানা নেই। অন্যদিকে মেয়েটি কর্মরতা চিকিৎসক। একজন নাইট ডিউটিতে থাকা চিকিৎসককে নিজের হাসপাতালে ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে! একজন মহিলা তাঁর কর্মস্থলেই নিরাপত্তাহীন। যে বার্তাটা জনমানসে যায় সেটা আতঙ্কের। ঘটনাটি শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে কলুষিত করেনি। সমাজের ভিতটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।

১৪ আগস্ট মধ্যরাতে কলকাতা ও রাজ্যের অন্য শহরগুলো প্রমাণ করল শহুরে বিদ্বজ্জন বিনাও মানুষ রাস্তায় নামতে পারেন, চলতে পারেন। তাঁদের আর বিদ্বজ্জন নামের যষ্টির প্রয়োজন নেই। সূচনার উত্তাল রাত শেষ হল। তবে এই রাতই প্রতিবাদের শেষ রাত নয়। এ সবে শুরু। কাজ পরে রয়েছে প্রচুর। আমাদের দাবিগুলোকে সূচিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের আশু দাবি তিলোত্তমার ভয়াবহ হত্যার সঠিক বিচার। আমাদের দাবি রাতের শহরে নারীর পথে চলবার অধিকার সুনিশ্চিত করা। দুর্নীতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বলতে হবে। আশু দাবি আদায়ের পথরেখা তৈরি করতে হবে। সকলকে নিয়ে সেই দাবি আদায়ের লড়াই করতে হবে। সেই দাবি আদায় করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা যেন তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

যে সমাজ ধর্ষকদের তৈরি করে, যে সমাজ তিলোত্তমাদের অসহায়তার চরম সীমায় ঠেলে দেয় – সেই সমাজ, সেই পুরুষতান্ত্রিকতা, সেই সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বিধান কে ঠিক করবে? কারণ সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত না করলে, আগামীদিনে আরও অনেক তিলোত্তমা নিজের মত করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হবে। নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে নারী নির্যাতনের  জন্য দায়ী।

সঠিক সময়ে অপরাধের সঠিক বিচার হলে এই অপরাধ বাড়তো না। একে তো বিচার হয় না অধিকাংশ ঘটনার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আজও নৃসংশতার বলি হতে হচ্ছে মেয়েদের। একের পর এক নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসায় বারবার লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা।প্রশ্ন উঠছে, কেন আরও কঠোর করা হচ্ছে না ধর্ষকদের শাস্তি? কেন ধর্ষণের শাস্তির বিচার প্রক্রিয়ার এত শ্লথ গতি?

এই পুরো ঘটনা প্রবাহে যে মৌলিক প্রশ্নটা উঠে আসছে, তা হল ন্যায়ের ও সাম্যের প্রশ্ন। বস্তুত প্রশ্ন উঠছে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও। যথাযথ আইনি পরিকাঠামো তৈরি করা এবং নীতি প্রণয়ন তথা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উচিত সব নাগরিকের জন্য সাম্য তথা ন্যায় নিশ্চিত করা এবং এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে বিভেদের স্থান থাকবে না। এই আলোকে সামরিক উত্তরাধিকার নিয়মাবলীর পুনর্বিবেচনা করা সময়ের দাবি। এটাও বলা দরকার যে সোশাল মিডিয়ায় আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত না হয়। সোশাল মিডিয়ায় আমাদের অংশগ্রহণ যেন সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে মজবুত করে, সেদিক লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

নির্ভয়া, কাশ্মিরের বাচ্চা মেয়ে আসিফা, হাথরাস, কামদুনির পড়ুয়া মেয়েটি তারও আগে ২০০৪ সালে মণিপুরের মনোরমা- ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে খুন হওয়ার মিছিল চলছে। সর্বশেষ সংযোজন আর জি করের ডাক্তার মেয়েটি। আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সামাজিক বোধকে এই মৃতদের অনুক্ত প্রশ্ন কি একবারও বিদ্ধ করছে না? কেন শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্য একজন মানুষকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে হবে? কিসের সুরক্ষা? তার দেহের এবং জীবনের সুরক্ষা? কেন এই “পবিত্র” পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ তার সুরক্ষা সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হবে বারংবার? উত্তর দিতে হবে, কেন তাদের বেলাতেই কেবল সুরক্ষার প্রসঙ্গ আসবে?কেন সমাজ তাকে নিজের শারীরিক পার্থক্য নিয়ে বাঁচা একজন “মানুষ” হিসেবে গ্রহণ করবে না? আর কত ধর্ষণ, হত্যা, রক্তাক্ত শরীর আর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখতে চায় “সমাজ”? ঠিক কতটা দেখলে তৃপ্তি হবে সমাজের চোখের, মনের, ধর্ষকামিতার? এই “ইতরের দেশ” কি সভ্য হবে? উত্তর কি কেবল বাতাসেই ভেসে বেড়াবে?

ন্যায়ের ও সাম্যের প্রশ্নে চলমান আন্দোলন সমাজের মানসিকতার বড় উত্তরণ! এ কী কম পাওনা! কিন্তু তারপর? কে জানে কোথায় শেষ হবে এই আন্দোলন? কত সহজে আমাদের মুখ বন্ধ করা চলে, তা তো জানি— শুধু ধমকে দিলেই হয়তো একেবারে দমে যাব! যাব কি?