নিরন্নের সংখ্যা বাড়ছে

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কারও নীচে ঠাঁই হয়েছে ভারতের। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তা বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেই প্রকাশ্যে এসেছে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, বর্তমানে চরম দারিদ্র্যে দিনে কাটছে প্রায় ১২ কোটি ৯০ লক্ষ ভারতবাসীর। তাঁদের গড় দৈনিক রোজগার ২.১৫ ডলারেরও কম বা মাত্র ১৮১ টাকার মতো। অর্থাৎ প্রায় ১৩ কোটি ভারতবাসীর কাছে দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই দায় হয়ে পড়েছে। ঘটনাচক্রে, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের মতো ইস্যুতে বিরোধী শিবিরের অভিযোগ সদর্পে উড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। বরং সাত লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতির গাজর ঝুলিয়ে চলেছে। যদিও বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ও বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিতই স্পষ্ট।

বিশ্বব্যাঙ্কের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এককথায় অসম্ভব। ভারতের অবস্থা কতটা করুম, রিপোর্টে তারও স্পষ্ট বিশ্লেষণ রয়েছে। ১৯৯০ সালে ভারতে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটানো মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৩ কোটি ১০ লক্ষ। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যাটা কমলেও দারিদ্র্যসীমার নিচে (মধ্য আয়ের দেশগুলিতে ৬.৮৫ ডলার বা ৫৭৬ টাকা দৈনিক রোজগারের মাপকাঠিতে) বসবাসকারী সামগ্রিক মানুষের সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতে বেড়েছে গরিব মানুষের সংখ্যাও।

এর আগে বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছিল, পরপর দু’বছর বৃদ্ধির পর ২০২১ সালে ভারতে চরম দারিদ্র্যে কাটানো মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লক্ষ কমে হয়েছে ১৬ কোটি ৭৪ লক্ষ। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যাটা আরও কিছুটা কমেছে ঠিকই। তবে সামগ্রিকভাবে দারিদ্রসীমার নিচে (৫৭৬ টাকার মাপকাঠি) থাকা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ‘পভার্টি, প্রসপারিটি অ্যান্ড প্ল্যানেট : পাথওয়েস, আউট অব দ্য পলিক্রাইসিস’ শীর্ষক বিশ্বব্যাঙ্কের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, চরম দারিদ্রের মধ্যে তিন কাটানো মানুষের ভিড় বাড়ছে সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন আফ্রিকার দেশগুলিতে। পরিস্থিতি যা, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যমাত্রা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা এক কথায় থমকে গিয়েছে। ফলে ২০২০ থেকে ২০৩০— এই এক দশক কার্যত জলে যেতে বসেছে। বর্তমান অবস্থায় চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে আরও বেশ কয়েক দশক লেগে যাবে। আর দৈনিক ৬.৮৫ ডলারের মাপকাঠি মেনে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষকে গরিবির খাঁচা থেকে মুক্তি দিতে এক শতাব্দীরও বেশি সময় লাগবে।


নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। নিম্ন আয়ের মানুষরা যা উপার্জন করছেন, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করার মতো অতিরিক্ত কিছু থাকছে না।

‘জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস’ বা এনএসও প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, খুচরো মুদ্রাস্ফীতির হার এ বছরে সেপ্টেম্বর মাসে ৫.৪৯ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সাধারণ মুদ্রাস্ফীতিতে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির অংশ ৪০ শতাংশের বেশি, তাই খাদ্যদ্রব্যের (বিশেষ করে ফল ও সবজির) দাম বৃদ্ধির কারণেই মুদ্রাস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি। খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি সেপ্টেম্বরে ৯.২৪ শতাংশে পৌঁছয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৬.৬৩ শতাংশ। ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন সার্ভিসেস অব ইন্ডিয়া লিমিটেড বা ক্রিসিল-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতির জন্য সবজি, ফল, চিনি এবং ডালের দামের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করা হয়েছে। টম্যাটো, আদা এবং বেগুনের দাম আগেই বেড়েছিল, পরবর্তীতে রসুন, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়ে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। বৃষ্টির খামখেয়ালিপনা, ফসল ওঠার আগে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি, দেশের অনেক জায়গায় বন্যা—এইসব কারণে ফসলের উৎপাদন কমেছে। বিশেষ করে নষ্ট হয়েছে সবজি। ফলে জোগানের অভাব স্বাভাবিক কারণেই দাম বাড়বে সবজি সহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি। এছাড়াও পশ্চিম এশিয়ার অশান্তি ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দামকে বাড়িয়ে রেখেছে। যুদ্ধের কারণে পণ্যের জোগানও ধাক্কা খেয়েছে। এগুলিও মূল্যবৃদ্ধির জন্য অনেকটা দায়ী।

কেন্দ্র বা রাজ্য, উভয় সরকারেরই দায়িত্ব গরিব প্রান্তিক মানুষজনের জীবন-যন্ত্রণার খবর রাখা এবং তাঁদের সমস্যার সমাধান করা। তা না করে তাঁদের রাজনৈতিক বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করছে। ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে চাল-গম বিতরণ করছে।