• facebook
  • twitter
Friday, 11 April, 2025

বাঙালি আর বাঙালিয়ানার অস্তিত্বের নাম— ‘নমস্তস্যৈ’

পিয়াল ভট্টাচার্যের এই রচনা বোধহয় এই সময়ে দর্শকদের সেরা প্রাপ্তি।গবেষণা ও তথ্যের ভার এ নাটককে কোথাও ক্লান্তিকর করে তোলে নি।

ফাইল চিত্র

সুনন্দ ভৌমিক

মহিষাসুরমর্দিনী বাঙালির একটা আবেগ। আজও দেবীপক্ষের সূচনা হয়না বানী কুমার পঙ্কজ মল্লিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ছাড়া। কিন্তু এর নেপথ্যের কাহিনি জানেন কজন?স্বাধীনতার আগে ও পরে ব্রিটিশ সরকার ও ভারত সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিল বাঙালির এই আইডেন্টিটিকে মুছে ফেলার। এমনকী জরুরি অবস্থার সময়ে দিল্লির নির্দেশেই মহিষাসুরমর্দিনী বন্ধ করে আকাশবাণীকে বাধ্য করা হয় ‘দেবীং দুর্গতি হারিণীম্’ সম্প্রচারের। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয় মহানায়ককে। আসলে হিন্দি বলয়ের বাঙালিয়ানাকে মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা কোথাও বেতারে প্রতিফলিত হয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনীর বিরুদ্ধাচারণের মধ্যে। আর সময়ের সেই অজানা ইতিহাসকেই মঞ্চে জীবন্ত করেছে অশোকনগর প্রতিবিম্বের নাটক— ‘নমস্তস্যৈ’।

নাটকের দুটি অর্ধে ব্যক্ত হয়েছে দুটি সময়ের কাহিনি। প্রথমটি স্বাধীনতা-পূর্বের, দ্বিতীয়টি স্বাধীনতা- উত্তরকালের। রাজেন সেন, নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রমুখের হাত ধরে দেবীর বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে বেতারে জাতীয়তাবাদ প্রচারের যে ভাবনার সূত্রপাত হয়েছিল, কালে কালে তা একদিকে যেমন বদলায় বাঙালিয়ানার অহংকারে অন্যদিকে তেমন চলতে থাকে সেন্সরশিপ। সোহরাওয়ার্দী সরকারের আপত্তির পাশাপাশি নাটকে ব্যক্ত হয়েছে পঙ্কজকুমার মল্লিকের অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে বেরিয়ে যাওয়া, বিজন ঘোষ দস্তিদার, শচীনদাস মতিলালের ব্যর্থ হওয়া কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে পুনরায় মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচারের কাহিনি। আর উঠে এসেছে রিহার্সাল রুমের গল্প। দ্বিতীয়ার্ধে এ নাটক আরও বেশি টান টান। বানী কুমার, পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে রেডিও-এ লাইভ সম্প্রচারের পরিবর্তে মহিষাসুরমর্দিনীর রেকর্ডেড-টেপ বাজানোর ঘটনা কিংবা মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে ‘দেবীং দুর্গতি হারিণীম্’ করার সরকারি আদেশের কথাই উঠে এসেছে নাটকের দৃশ্যে। আর ব্যক্ত হয়েছে হিন্দি বলয় ও কেন্দ্রের বাঙালির সিগনেচারকে মুছে ফেলার আপ্রাণ প্রচেষ্টার কথা।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভূমিকায় বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীর অভিনয় এ নাটকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাঁর সাবলীল অভিনয় ও অপূর্ব স্তোত্র-পাঠ নিমেষে জাগিয়ে তোলে বাঙালির নস্টালজিয়া। বার বার মনে পড়ে জীবন্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কথা। কথক প্রান্তিক চৌধুরীর অভিনয় নাটককে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এছাড়া বানী কুমারের চরিত্রে পার্থ মুখোপাধ্যায়,পঙ্কজকুমার মল্লিকের চরিত্রে শ্যামল সরকার,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে রাজীব বর্ধন অনবদ্য।অনুপম চন্দ ও ঐশিকি ঘটকের অভিনয়ও যথেষ্ট ভালো। লাইভ-মিউজিক এ নাটকে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। রাতুল চন্দ রায়ের সংগীত আয়োজন অসাধারণ। অদ্রীশকুমার রায়ের মঞ্চ এবং সৌমেন চক্রবর্তীর আলোও যথাযথ। তবে সঞ্জয় পালের রূপসজ্জার উল্লেখ আলাদা করে করতেই হয়। তিনি যেন চরিত্রদের জীবন্ত করেছেন মঞ্চে।

পিয়াল ভট্টাচার্যের এই রচনা বোধহয় এই সময়ে দর্শকদের সেরা প্রাপ্তি।গবেষণা ও তথ্যের ভার এ নাটককে কোথাও ক্লান্তিকর করে তোলে নি। বরং ইতিহাসকে নাটকীয় ঘটনায় ও দ্বন্দ্বে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা কোথাও নাটককার পিয়ালের চরম মুন্সিয়ানাকেই ব্যক্ত করেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাকী চরিত্রদের দ্বন্দ্বের দৃশ্যটি কোথাও না কোথাও ব্রাত্য বসুর “রুদ্রসংগীত”কে মনে করায়। বিশেষ করে একটি সংলাপের কথা উল্লেখ করতেই হয় যেখানে কথক দর্শকদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেন প্রশ্ন— ‘উত্তমকুমার তো সংস্কৃত স্তোত্র পড়েননি এবং তাঁর বাঙলা পাঠের সময়ও ছিল খুব বেশি হলে আড়াই থেকে তিন মিনিট। অনুষ্ঠান বা এক্সপেরিমেন্ট ফ্লপ করলে,তিন মিনিট পাঠ করলে যদি সব ব্যর্থতা উত্তম কুমারের হয় তাহলে সে ব্যর্থতা একই ভাবে লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলেরও’। কারণ ‘দেবীং দুর্গতি হারিণীম্’-এ এঁদেরও কন্ঠ ছিল কিন্তু সচেষ্টভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বম্বে বলয়ের নাম। আর সেই জন্যই বাঙালিয়ানার জয়গানে শেষ পর্যন্ত উঠে আসে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার কথা।’ যতদিন বাঙলা থাকবে,যতদিন বাঙালি থাকবে, ততদিন থেকে যাবে বানী কুমার পঙ্কজকুমার মল্লিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।

নির্দেশক পার্থসারথি রাহা এ নাট্যের নির্মাণে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।বিশেষ করে কথক চরিত্রটিকে মঞ্চে না তুলে প্রেক্ষাগৃহের বিভিন্ন স্থানে ও দর্শকদের মধ্যে থেকে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে এক অন্য ছবি তৈরি করেছেন। তবে কোথাও গান ও স্তোত্র পাঠকে দীর্ঘায়িত করার ভাবনা বা প্রথম অর্ধের শেষে অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাইকের সামনে ভারত-মাতার নৃত্য প্রদর্শন সামান্য হলেও নাটকের তাল কেটে দেয়। বরং নাটকের শেষে দেবী দুর্গার কোরিওগ্রাফির ভাবনা যথেষ্ট প্রশংসনীয়।