মোদী অর্থনীতির হাল

বর্ষা ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির আকাশে এখনও রয়ে গিয়েছে তিনটি ঘন কালো মেঘ। বেসরকারি বিনিয়োগ থমকে যাওয়া, উৎপাদন ক্ষেত্রের গতি হারানো এবং শ্রমিকদের মজুরি ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া। এর দ্রুত সমাধান না করলে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। বিজেপির ১০০ দিনের কাজের খতিয়ান বা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেট ভাষণে একবারও অপুষ্টি অথবা ক্ষুধা শব্দ দু’টি শোনা যায়নি।

অতিমারির পর দেশের অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সেই সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বেসরকারি লগ্নি কিছুটা মাথা তুলেছিল। তারপর থেকেই তা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলেছে। পরের দু’টি আর্থিক বর্ষে বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রকল্প ঘোষণা কমেছে ২১ শতাংশ। এটা প্রমাণ করে যে, লগ্নিকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন। সরকারের ‘অসংলগ্ন’ নীতি এবং সরকারি তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে দিয়ে ‘অভিযান’ চালানোর ফলেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত। বিভিন্ন সংস্থা এখন তাদের মুনাফাকে ব্যবসা বাড়ানোর কাজে ব্যয়ের বদলে ঋণের বোঝা কমানোয় ব্যবহার করছে। সরকারের উৎসাহেই আয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে শেয়ার বাজারের মূল্যায়নে।

সম্প্রতি ১০ বছর পূর্ণ করেছে মোদী সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেই প্রকল্পের ‘সাফল্য’ প্রচারও করছেন। কংগ্রেসের অভিযোগ, গত এক দশকে উৎপাদন ক্ষেত্রের গতি কার্যত স্তব্ধ। দেশের মোট জিডিপি’তে উৎপাদন ক্ষেত্রের অবদান একই জায়গায় আটকে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দূর অস্ত, উল্টে কমেছে। ২০০৫-১৫ সালের মধ্যে জি]পি’তে রপ্তানির ভাগ বাড়লেও, এখন তা নিম্নমুখী।


২০১২ সালে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান ছিল গুজরাতের। সেই সময় এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মা মেয়েকে দুধ খেতে বললে বাচ্চা লড়াই করে। বলে, ‘দুধ খেলে মোটা হয়ে যাব।’ মোদীর বক্তব্য ছিল, সাধারণ মানুষের টাকার অভাব আছে এমনটা নয়, কিন্তু বাচ্চারা সৌন্দর্য সচেতন, স্বাস্থ্য সচেতন নয়।’

এরপর এক দশক কেটে গেছে। কিন্তু সমালোচনা সহ্য করতে না পারার অসুখ এখনও রয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে এভিপিডি (অ্যাভয়ডেন্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার)। বিশ্বের প্রতি তিন জন অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর মধ্যে একজন ভারতীয়। ক্ষুধার জ্বালায় ভোগা মানুষের শতকরা হার ভারতে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে ছিল মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়্ছে ১৪ শতাংশে।

রাজস্ব এবং বাণিজ্য কোনও দিকেরই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না মোদী সরকার। এর অবশ্যম্ভাবী কুফল ভুগছে সমগ্র অর্থনীতি। বাড়ছে না কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হারও প্রত্যাশা ছুঁতে ব্যর্থ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে বেকারত্ব এবং গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির দুর্ভোগ। কিন্তু এই ‘সাফল্য’ যার সেই সরকারই দেশবাসীকে অহরহ স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘আচ্ছে দিন’ ও ‘অমৃতকাল’ উপহার দেওয়ার এবং ‘উন্নত ভারত’ নির্মাণের। এমনকি, এই দাবিও করা হচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করবে। বিশ্বে ভারতীয় অর্থনীতির স্থান হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের পরেই।

ভারতের জনসংখ্যা আপাতত দেড়শো কোটির মাইলস্টোন ছুঁতে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। দায়িত্বশীল রাষ্ট্র যদি তার মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারে, তাহলে বিপুল জনসংখ্যা উদ্বেগের কারণ নাও হতে পারে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের পূর্বশর্ত হল বৈষম্য দূর করে ফেলা। কিন্তু সাতাত্তর বছরের স্বাধীন দেশ বৈষম্য বৃদ্ধিতেই হাত পাকিয়ে চলেছে। মোট সম্পদের ৭০-৮০ শতাংশ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের জন্য পড়ে রয়েছে শুধু হাহাকার। এই দেশ কীভাবে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।