আরজি কর ঘটনার তদন্ত কি থিতিয়ে যাচ্ছে?

নারায়ণ দাস

আরজি কর মেডিকেল কলেজের নারকীয় ঘটনা দেশকে ছাপিয়ে বিদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। সব শ্রেণির লোকই চাইছে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু সেই শাস্তি কবে হবে, কবে আরজি কর নিয়ে ঘোলা জলে রাজনীতি বন্ধ হবে, তা এখনও কেউ জানে না! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশের এক বিশেষ টিমকে ঘটনার নেপথ্যে কে বা কারা রয়েছে তা জেনে নিয়ে চার্জশিট দিতে এবং তাদের বিচারের ব্যবস্থা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে হোক চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সেই সময় না দিয়ে সিবিআইকে এই তদন্ত অর্পণ করার নির্দেশ দেয় মহামান্য হাইকোর্ট। সুতরাং কলকাতা পুলিশ কি পারে বা পারে কিনা, জানা গেল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও শুরুতে বলেছিলেন, এই ঘটনার ভার যদি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে সরকারের কোনও আপত্তি নেই। যদিও সেই সঙ্গে বলেছিলেন সিবিআই ঘটনার মূল অভিযুক্তদের খোঁজে বের করতে কত সময় নেবে তা তাঁর জানা নেই। তাছাড়া সিবিআইয়ের সাফল্য সম্বন্ধেও তাঁর মত সুখকর নয়। বিশিষ্টজনেরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন আরজি করের ঘটনায় তদন্ত ‘স্লো হয়ে আসছে’।

সিবিআইয়ের হতে তদন্তভার যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত, কিন্তু এখনও এই কেন্দ্রীয় সংস্থা ঘটনার কোনও ব্রেক থ্রো করতে পারেনি। একমাত্র কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে কয়েক ঘণ্টা জেরা করা ছাড়া। তাঁকে গ্রেফতার করারও দাবি তুলেছে রাজনৈতিক এবং বিশিষ্ট মহল। অথচ মহামান্য হাইকোর্ট সিবিআইকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কেসটির তদন্তভার শেষ করে তা কোর্টে পেশ করার নির্দেশ দিয়েছিল। আসলে এই কেন্দ্রীয় সংস্থার ওপর বিভিন্ন কেসের তদন্তের বিরাট বোঝা। কোথাও কোনও খুন-জখমের ঘটনা ঘটলেই ভুক্তভোগীরা সিবিআইয়ের ওপর তদন্তভার দেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ওই সংস্থার ওপর মানুষের বিশ্বাস এখনও পর্যন্ত অটল থাকলেও, বড় বড় ঘটনার তদন্তভার শেষ করে চার্জশিট কোর্টে পেশ করতে পারেনি। সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করার প্রধান কারণ মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলেছে। তারা মনে করে পুলিশের ওপর কোনও গুরুতর ঘটনার তদন্তভার দিলে তা শেষ হতে সময় বেশি না লাগলেও, আকাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না, কারণ পুলিশের রাজ্য প্রশাসনের কোনও ত্রুটি বা গাফিলতি ধরা পড়বে না। সুতরাং পুলিশি তদন্তে তাদের বিশ্বাস নেই। কিন্তু এ পর্যন্ত যত বড় বড় ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, এই সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত করেও তার রহস্য উদঘাটন করে তদন্তে কী পাওয়া গেল জানায়নি। সিবিআইয়ের এই ব্যর্থতাকেও মানুষ ভালো চোখে দেখছে না।


সুতরাং আরজি করে এক কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে রহস্যজনক মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলেন কিছু বিশিষ্টজন। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট তা মেনে না নিয়ে তদন্তের ভার সিবিআইয়ের ওপর দিল। এই সংস্থা শুধু চিকিৎসক মহিলার মৃত্যুরই তদন্ত করবে না, আরজি করে নানা দুর্নীতির তদন্তভারও এই সংস্থার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এই হাসপাতালের মর্গে দুর্নীতি নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং সিবিআই এই সব তদন্তের ভার হাতে পেয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

আরজি করের মহিলার মৃত্যু নিয়ে আন্দোলন শুধু জনিয়র ও সিনিয়র ডাক্তারদের ওপর সীমাবদ্ধ নেই— সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এমনকি বিনোদন জগতের শিল্পীরা পথে নেমে আওয়াজ তুলেছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। তাছাড়া রাজ্যের রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন পথে নেমেছে আরজি করের ঘটনার তদন্ত করে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে। এদিকে বিধানসভায় ধর্ষণে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তাব দাবি করে একটি বিল পাশ করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে জুনিয়র চিকিৎসকরা পথে নেমেছে আরজি করের ঘটনার ধিক্কার জানিয়ে। তাঁরা অবিলম্বে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সুতরাং আরজি করের পৈশাচিক ঘটনা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

কলকাতা পুলিশ এই ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িত একজনকে ধরেছে— সে আবার পুলিশের সঙ্গে যুক্ত, অর্থাৎ সিভিল পুলিশ। তাকে জেরা করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা লিখিতভাবে সিবিআইয়ের সমীপে পেশ করা হয়েছে বলে জানা যায়। কলকাতা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন অফিসার জানিয়েছেন, যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সে নাকি অপরাধ স্বীকার করেছে। কিন্তু সে একাই এই ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িত, নাকি তার সঙ্গে কেউ ছিল, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। চিকিৎসক মহল ও বিশিষ্টজনের মতে, তদন্ত যত দেরি হবে, এই ঘটনাও মানুষের মন থেকে মুছে যেতে থাকবে। সুতরাং সবারই দাবি, তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে যে বা যারা অভিযুক্ত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে। এই জঘন্য কাজের প্রতিবাদস্বরূপ মহিলারাও দল বেঁধে গত সপ্তাহের এক মধ্যরাতে রাস্তায় নেমেছিল, যা নজিরবিহীন। তাঁরাও দলমত নির্বিশেষে অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। প্রচুর সংখ্যক মহিলা রাজপথে নেমে আওয়াজ তুলেছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। তাঁরা আরও দাবি তুলেছেন, তদন্তে দেরি করা চলবে না। তাঁদের অভিযোগ, সিবিআই কেসটি হাতে নেওয়ার পর তদন্ত তেমন এগোয়নি— শুধু আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে দীর্ঘ জেরা ছাড়া। অনেকেই কিন্তু তার গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। তার গ্রেফতার না হওয়ার জন্য অনেকেই রহস্য দেখছেন।

মহামান্য হাইকোর্টের তদারকিতে সিবিআই আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত চালাচ্ছে। যতদূর জানা গেছে এই মৃত্যুর নেপথ্যে অনেক রহস্য লুকোনো রয়েছে— সিবিআই তার কতটা বের করতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা চলছে!

এদিকে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আন্দোলন তো অনেক হল, এখন আপনারা কাজ শুরু করুন। বহু রোগী ফেরত চলে যাচ্ছে। অন্যান্য মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের তিনি কাজ আরম্ভ করতে অনুরোঝ জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, গরিব মানুষ চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারছেন না— কারণ সেখানে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি কলকাতা পুলিশের হাতে এই ঘটনার তদন্তভার দিয়ে তাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, নির্দিষ্ট দিনক্ষণ মতো তদন্ত রিপোর্ট শেষ করে চার্জশিট জমা দিতে হবে। বিচার হবে ফার্স্টট্র্যাক কোর্টে। কিন্তু কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে চলে গেল। এখন দেখা যাক সিবিআই কেসের তদন্ত কতদিনে শেষ করতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীও আরজি করের ঘটনা মর্মাহত। তিনি পরিবারের সদস্যদের সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, সরকার তাঁদের পাশে আছে এবং সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।

আরিজি করের ঘটনা নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে এবং হবে। কিন্তু আসল কথা হল কলকাতা পুলিশের একজন সিভিক ভলান্টিয়ার বাদে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আর কাউকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। যে কোনও আন্দোলনই হোক না কেন, তা দীর্ঘস্থায়ী হলে জনমানসে তার প্রবল প্রভাব পড়ে। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হল আরজি কর নিয়ে পথে নেমেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ— আন্দোলনের যেন শেষ নেই। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়াশোনা যেমন থেমে রয়েছে, তেমনই আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্নে অফিসে এবং ব্যবসাবাণিজ্যের কাজকর্মে। আর এই আন্দোলন কবে শেষ হবে, কবে অভিযুক্তরা সাজা পাবে, তা এখনও ঘোরতর অনিশ্চিত। মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে বিশেষ করে আন্দোলনকারীদের বলেছেন, আপরাধী বা অপরাধীদের শাস্তি হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হঠাৎ করে কাউকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো যায় না— সবই হবে আইন মোতাবেক। আরজি করের মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং পরে খুন করার যথাযুক্ত বিচার চেয়ে যে আন্দোলন চলছে, তা এককথায় নজিরবিহীন!

কোনও কোনও মহল থেকে মুখ্যমন্ত্রী, যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কেন পদত্যাগ করবেন? তিনি ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বিধিসম্মত ব্যবস্থা নিয়েছেন, তিনি নিজেই এক্ষেত্রে অভিযুক্তর ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব অপরিসীম— তা তিনি করে যাচ্ছেন। তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের অনুরোধ জানিয়েছেন অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে, যাতে রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলেছেন, যে পর্যন্ত না আরজি কর কাণ্ডের ‘জাস্টিস’ না মেলে আন্দোলন চলবে। তৃণমূলের নেতৃবর্গ বারবার বলেছেন, আরজি কর কাণ্ডে যা ঘটেছে তা অতি জঘন্য, বর্বরোচিত কাজ। সুতরাং যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সে ফাঁসিই হোক বা অন্য কোনও শাস্তিই হোক হওয়া দরকার। তাঁরা বলেছেন, বিচারে আইনানুগ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তার প্রতি তাদের পূণ: সমর্থন রয়েছে। তারা কিছু গোপন করছে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আন্দোলনকারীরা এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে— যার প্রভাব সর্বক্ষেত্রে পড়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আন্দোলন আরও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তারা ইতিমধ্যে থানা ঘেরাও করেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, তাঁদের একাধিক দাবি— মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ সহ তিনি রাষ্ট্রপতির শাসনও দাবি করেছেন।

রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা এ পর্যন্ত মিছিল-মিটিং করে শহরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে— এখনও ভাবছেন এই একটি ইস্যু যা অনেকদিন চালিয়ে যাওয়া যায়। আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়াতে সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কারণ তাঁদের অনেকের ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত এবং মণিপুর এবং বিজেপি-শাসিত আরও কয়েকটি রাজ্যে বড় বড় মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তা নিয়ে সাধারণ মানুষের আন্দোলন এরকম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তারা আইনানুগ বিচার চেয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। পুজোর মুখে এই আন্দোলন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত ক্ষতি করছে। অপরদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য। সাধারণ মানুষের দুর্গতির শেষ নেই। আলু-পেঁয়াজ সহ সব তরিতরকারির মূল্য আকাশছোঁয়া। রাজনৈতিক দলের নেতাদের সেদিকে কোনও নজর নেই— আরজি কর ইস্যুই এখন তাঁদের প্রধান ইস্যু।

ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন সংসদে এমন একটা আইন আনতে, যাতে ধর্ষকদের ফাঁসি হয়। ধর্ষণের ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ঘটছে না— অন্যান্য রাজ্যেও ঘটছে। কিন্তু তা নিয়ে প্রতিবাদ বা আন্দোলন এমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুতরাং ধর্ষণে অভিযুক্ত যারা তাদের যাতে কঠোর শাস্তি, অর্থাৎ ফাঁসি হয়, এমন একটা বিল সংসদে পাশ হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায়ও ধর্ষণবিরোধী এবং ধর্ষকদের ফাঁসি চেয়ে একটি বিল পাশ হতে চলেছে।

আরজি করের ঘটনার পর সরকারের যে শিক্ষা নেওয়া উচিত, তা হল, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। আরজি করের মতো এমন জঘন্য ঘটনা যেন আর না ঘটে।