• facebook
  • twitter
Sunday, 16 March, 2025

মমতার প্রতি শিল্পমহলের অগাধ আস্থা

বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে রাজ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনা

নিজস্ব চিত্র

স্নেহাশিস সুর

আপাত শিল্প বিরোধিতার মধ্যে যিনি বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে, সেই তিনিই আজ শিল্পপতিদের প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দুতে। সময় পাল্টেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে দৃষ্টিভঙ্গী। শুধু লক্ষ নয়, প্রত্যয় এখন রাজ্যে শিল্প আনার আর কর্মসংস্থান বাড়াবার। সেই লক্ষেই বুধবার রাজ্য সরকারের উদ্যোগে শুরু দুদিনের অষ্টম বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট। ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাত বারের পর, এই নিয়ে আটবার এই শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করলেন।

কেমন এই সম্মেলন? শোনা যাক দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির কাছেই। সম্মেলনেই তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার বললেন, তিনি এই সম্মেলনে আসছেন ২০১৬ থেকে প্রত্যেকটায়। আর প্রতিটায় ভাবছেন সেটাই সবচেয়ে ভাল এবং এর চেয়ে ভাল আর হতে পারে না। আর পরেরটাতেই তাঁর ভুল ভাঙছে। কারণ দেখছেন সেটা আগেরটার চেয়েও ভাল আর এবারের অভিজ্ঞতাও তার ব্যতিক্রমী নয়। মুকেশ আম্বানির এই প্রশস্তিই শুধু নয় ওঁর বক্তব্যে ওঁর সংস্থা এরাজ্যে কী বিনিয়োগ করেছে এবং করছে তার বিনিয়োগের কথা বলার পর নিজের থেকেই বললেন, আমার পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা খুবই ভাল। এখানে বন্ধ, হরতাল নেই, শ্রমিক সমস্যা নেই, প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হয় না, সরকার অত্যন্ত সদর্থক, তাই দেশ বিদেশের শিল্পপতিদের আমি আহ্বাণ জানাচ্ছি, আপনারাও এরাজ্যে বিনিয়োগে এগিয়ে আসুন।

এর ঠিক পরেই বলতে উঠে মুকেশ আম্বানি এরাজ্যের ব্র‍্যন্ড এম্বাসাডারের মত এইভাবে এগিয়ে আসায় মুখ্যমন্ত্রীও যে অবাক হয়েছেন সেটা বেরিয়ে পড়ল আম্বানির প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর উচ্ছসিত মনোভাব ও বক্তব্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আজ সারা দেশের শিল্পপতিদের এই আস্থা অর্জন করেছেন তারই পরিচয় পেল বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষ। প্রথম দিনেই নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা বেশকিছু হয়েছে, তার অনেকগুলোই হাজার কোটিতে। তবে একদিন যে অগ্নিকন্যার রক্তচক্ষু দেখেছিল শিল্প মহল, তার থেকে সরে এসে দেশের তাবড় তাবড় শিল্পপতিদের আস্থার নয়নমণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা এই বিজিবিএস-এ একটা বড় পাওয়া। আর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা মানে ডেস্টিনেশন বেঙ্গল। এরাজ্যে শিল্প আসা। পশ্চিমবঙ্গ যে শিল্পবিরোধী নয় সেই ছবিটা তুলে ধরা। বিনিয়োগ আসা এবং বিনিয়োগ এলেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়া। শিল্পের প্রতি রাজ্যের এই সদর্থক মনোভাব প্রকাশ পাওয়া খুব জরুরি। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই, চাকরি নেই, ছেলে মেয়েরা বাইরে চলে যাচ্ছে এই ধারণা বা এই প্রচার থেকে বেরিয়ে আসা খুব জরুরি। বিশেষত আগামী বছর যেখানে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্তর্জাতিক বানিজ্য সম্মেলন এবং সেখানে উপস্থিত শিল্পপতিদের এই প্রশংসা যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে। বিশেষত বাংলায় কাজ নেই, বাংলায় শিল্প নেই, সেই অপবাদ থেকে সাধারণ মানুষের মনোভাব পাল্টাতে এটা যথেষ্ট কাজ করবে।

সাধারণত শিল্প সম্মেলনের সাফল্য মাপা হয় নতুন কি শিল্প বা বিলিয়োগের ঘোষণা হল তা দিয়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আগামীকাল থেকেই বীরভূমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা খনি দেউচা পাচামির কাজ শুরু হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী যে ঘোষণা করলেন, সেটা নি:সন্দেহে যুগান্তকারী। কারণ এর বিশাল বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশগ্রহণ, ব্যাপক কর্মসংস্থান, এই পরিবর্তনের সব সম্ভাবনার চেয়ে যখন সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়লার ব্যবহার ক্রমে বন্ধ হওয়া, এলাকায় বসবাসকারী মানুষজনের অন্যত্র যেতে না চাওয়া, এবং পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়া এইসব বাধা দূর করে এই প্রকল্প চালু করাটা নি:সন্দেহে একটা বড় ব্যাপার ছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সহজ কাজ ছিল না। এটা করে দেখাতে পারায় শিল্পমূখী একটা বড় বার্তা অবশ্যই যাবে; যেটা আবার আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের স্বপক্ষে প্রচারের একটা হাতিয়ার হয়ে দেখা দিতে পারে। এই খনিতে এক হাজার দুশো চল্লিশ মিলিয়ন টন কয়লা আছে এতে প্রায় একলাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় ছেলে মেয়েদের কাজের সুযোগ হবে। এছাড়া স্বভাবিক ভাবেই এই অঞ্চলে বহু অনুসারী শিল্প গড়ে উঠবে।

কোথাও নতুন শিল্প আসার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে শিল্পের জন্যে জমি যোগাড় এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অনুমতি যোগাড়। মুখ্যমন্ত্রী এই শিল্প সম্মেলনে শিল্পক্ষেত্রকে আরেকটা ইজ অব ডুইং বিজনেস এর বার্তা দিলেন নতুন স্টেট লেভেল ইনভেস্টমেন্ট সিনার্জি কমিটি করে। এই কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন মুখ্য সচিব। কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একবারে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পের মঞ্জুরি দেবে। প্রতি পনের দিন অন্তর এই কমিটির বৈঠক বসবে। এর আগেও অনুমোদনে গতি বাড়াতে একাধিক পদক্ষেপের ঘোষণা হয়েছে কিন্তু এই ঘোষণা শিল্প মহলে নি:সন্দেহে একটা বড় সদর্থক বার্তা দেবে। আর এখন বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে শিল্প টানার যে প্রতিযোগিতা চলছে তাতে এই ঘোষণা বড় কাজ করতে পারে। বিশেষত যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ইজ অব ডুইং বিজনেস এর কথা এত বলছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পপতিদের টানতে এটা কার্যকরী হবে। তবে এই ধরণের দিদ্ধান্ত, ব্যবস্থা আগেও হয়েছে। সত্যিই বাস্তবে প্রতি পনের দিনে বৈঠক হয় কিনা বা সত্যিই একটা বৈঠকে প্রকল্পের ছাড়পত্র পাওয়া যায় কিনা সেটা অবশ্যই দেখার। তবে এই সরকারের কাছে গতিটা যে অবশ্য পালনীয় সেটা শিল্পপতিরাও বুঝে গেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিনে এটা প্রমাণ করতে পেরেছেন।

সরকারের দিক থেকে আরেকটা ঘোষণা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পের জন্য বেশ কিছু নীতি আনার কথা বলা। যেমন চা বাগানের অব্যবহৃত জমি পর্যটন কেন্দ্র বা অন্য কিছুর জন্য ব্যবহার করা যেত ১৫ শতাংশ এখন এই জমি তিরিশ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে। সরকারের বক্তব্য, এতে স্থানীয় মানুষের উপকার হবে। এছাড়াও আরও কিছু নীতি নির্ধারণ হয়েছে শিল্পের স্বপক্ষে যা মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন এই সম্মেলনে।

বিজিবিএস বা বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে এর আগে নব্বই লক্ষ পনের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রকল্প এসেছে এবং তার মধ্যে বারো লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এই আউটকাম রিপোর্ট অর্থাৎ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তার খতিয়ান পেশ করাটা খুবই উল্লেখযোগ্য। এবারে রিলায়েন্সের মুকেশ আম্বানি, জিন্দাল গোষ্ঠীর সজ্জন জিন্দল, আরপিজি গোষ্ঠীর সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, অম্বুজা নেওটিয়া গোষ্ঠীর হর্ষ নেওটিয়া, আইটিসির সঞ্জয় পুরীসহ উপস্থিত সকল শিল্পপতিই এরাজ্যে শিল্পের পরিবেশ খুবই ভাল বলে, মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করে, তাঁদের সংস্থার এরাজ্যে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা রেয়েছে তার কথা বিস্তারিতভাবে জানান। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর শেষ সময়ে আসা বাতিল করার কারণ অনুল্লিখিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের এতে শেষ মুহূর্তে কোনও ভূমিকা আছে কিনা তা বলা শক্ত। আর টাটা গোষ্ঠীর সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের এই সম্মেলনে থাকতে না পারাটা যে তাদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তার ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী জানান টাটার নেতৃত্বের দঙ্গে তার একদিন আগেই আলোচনা হয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী এই সুযোগে ওঁর রাজ্যে লগ্নি টানার একটু চেষ্টা করেন তাঁর ভাষণে।

এখন অপেক্ষা দ্বিতীয় দিনে কত বিনিয়োগের সমঝোতাপত্র দই হয় এবং ঐদিন বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে আলোচনাগুলো আছে সেগুলো থেকে কতটা ভবিষ্যতের কার্যকরী বিনিয়িগের সম্ভাবনা উঠে আসে সেটা দেখার।