ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এক অতল খাদের সামনে

শোভনলাল চক্রবর্তী: জনগণের স্মৃতি একটা সিগারেট পুড়তে যত সময় লাগে, তার চেয়েও কম৷ তবু এক দশক আগে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যে সব আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলির কথা কারও কারও মনে থাকতেও পারে৷ তার ‘জুমলা’ অংশগুলি না হয় বাদই দেওয়া যাক— সবার অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা, ডলারের দাম চল্লিশ টাকা, পেট্রলের দামও তাই, এ সব কথার কথা যে বাস্তবায়িত হবে না, বোঝা গিয়েছে আগেই৷ কিন্ত্ত, অর্থব্যবস্থার মূল প্রশ্নগুলি কোথায় দাঁড়াল, নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফা শাসনের শেষ পর্বে এসে সেই প্রশ্নটি না করলেই নয়৷

১৯৯১ সালে ভারতে আর্থিক সংস্কারের পরবর্তী সময়ে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালেই সার্বিক ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল সর্বনিম্ন৷ তার জন্য কোভিডকে দায়ী করা চলে না, কারণ অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগেই আর্থিক বৃদ্ধি নিম্নমুখী হয়েছিল৷ কোভিড শুরু হওয়ার আগের চারটি আর্থিক বছরের প্রতিটিতে বৃদ্ধির হার ছিল তার আগের আর্থিক বছরের তুলনায় কম৷ দেশের আর্থিক উন্নতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম৷ ২০১১-১২ সালে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ৩৫ শতাংশ ছিল বিনিয়োগ৷ ২০২৩ সালে সেই অনুপাত কমে দাঁডি়য়েছে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি৷ বেকারত্বের হার আকাশছোঁয়া, বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে— পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, স্নাতক বা তার বেশি শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীতে যত জন প্রত্যক্ষ ভাবে চাকরি খুঁজছেন, তাঁদের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন কর্মহীন৷

আর্থিক অসাম্য যে ক্রমেই বাড়ছে, তারও নানান প্রমাণ মিলছে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে৷ জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার বা ভোগব্যয় সংক্রান্ত সর্বশেষ সমীক্ষাটি হয়েছিল ২০১৭ সালে, তার ফলাফল সরকার এখনও প্রকাশ করেনি৷ কিন্ত্ত, সেই ফলাফল ‘ফাঁস’ হয়েছিল, এবং তাতে জানা গিয়েছিল যে, গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয় নিম্নমুখী৷ অন্য দিকে, মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পরানোও সম্ভব হয়নি৷ সব মিলিয়ে, নরেন্দ্র মোদীর দশ বছর ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে এক অতল খাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে৷ অর্থমন্ত্রী যখন এ বছরের ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করলেন সংসদে, এই উদ্বেগগুলির একটিও সেখানে শোনা গেল না৷ শোনা যে যাবে না, তা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বোঝা গিয়েছিল৷ অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সরকারের অঘোষিত নীতিটির নাম ‘ডিনায়াল’ বা বাস্তবকে অস্বীকার করা, এবং তথ্যের অযথা ব্যবহার করে একটি মেকি বাস্তব খাড়া করা৷ তার কারণ, অর্থনীতির যুক্তি-তর্ক বহু ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে— তাঁরা শুধু একটি বিশ্বাসযোগ্য বয়ান জানতে চান৷


জি২০-র সভাপতিত্বকে কেন্দ্র করে যেমন ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠার বয়ান তৈরি করল বিজেপি৷ সেই শোরগোলে এ কথাটি চাপা পডে় গেল যে, গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্বটি ঘুরে ফিরে সব দেশই পায়, তার জন্য কোনও বিশেষ কৃতিত্বের প্রয়োজন হয় না৷ এবং, গোষ্ঠীভুক্ত ২০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয় ভারতেরই৷ প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী থেকে আইটি সেলের কর্মী, সবাই বুক ফুলিয়ে জানান যে, ভারতীয় অর্থনীতি এখন আয়তনের নিরিখে বিশ্বের পঞ্চম স্থানে৷ এ কথা বলেন না যে, তা সম্ভব হয়েছে নিতান্তই জনসংখ্যার কারণে৷ আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের হিসাবে, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪৩তম স্থানে৷ দেশের নেতারা হুঙ্কার দিয়ে জানান যে, ভারতের মতো আর্থিক বৃদ্ধির হার আর কোনও বৃহৎ অর্থব্যবস্থার নেই৷ নিচু ভিত্তির উপরে তুলনায় বেশি বৃদ্ধির হার অর্জন করার কাজটি যে সহজতর, তাঁরা সে কথা বলেন না৷ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ভারতের জাতীয় আয়ের যে কণামাত্র ব্যয় হয়, তা যে উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে না, বলেন না তা-ও৷ দশ বছরের শাসন শেষে যদি শুধু অর্ধসত্যের উপরে ভর করেই বয়ান সাজাতে হয়, তবে দেশের কী অবস্থা তাঁরা করেছেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ বাজেট যে রাজনীতির হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল না৷ নির্মলা সীতারামন হতাশ করেননি৷

যে ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির প্রশ্নগুলিকে রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, এই বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ঠিক তা-ই করেছেন৷ এই বক্তৃতার বৈশিষ্ট্য কী, এই প্রশ্ন করলে উত্তর হবে, আত্মবিশ্বাস৷ নির্মলা সীতারামনের বক্তৃতা কার্যত বলেই দিল যে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা তৃতীয় দফা সরকার গড়বেন, সে বিষয়ে তাঁদের মনে সংশয়ের অবকাশ নেই৷ অর্থমন্ত্রী জানালেন, নতুন সরকার গঠনের পর তাঁরা যে বাজেটটি পেশ করবেন, তাতে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার বিস্তারিত পথনির্দেশ থাকবে৷ ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে বর্তমানের অন্ধকার ঢাকতে ব্যবহার করার কৌশলটি সফল ভাবে পরীক্ষিত— তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সেই ভবিষ্যতে পৌঁছনোর পরে প্রতিশ্রুতি মিলিয়ে দেখার কথা কারও বিশেষ মনে থাকে না৷ যেমন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতির ক’আনা পূরণ হল, সে হিসাব আর কেউ করেন না৷ ২০৪৭ তো আরও অনেক দূরের কথা৷ কিন্ত্ত, সরকার গডে় দূর ভবিষ্যতের পথনির্দেশ দেবেন, অর্থমন্ত্রীর এই বার্তাটি তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক নয়৷ এই বাজেটে কার্যত কোনও নতুন প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, কোনও ‘রেউডি়’-র ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র গত দশ বছরের কৃতিত্বের তালিকা সাজানোর মধ্যে নিহিত আসল বার্তাটি— তা এই যে, দশ বছরে যা করা হয়ে গিয়েছে, নির্বাচনে জিতে আসার জন্য সেটাই যথেষ্ট; নতুন কিছু করার আর দরকার নেই৷

কেউ কেউ বলবেন, এটা আত্মবিশ্বাস নয়, বরং কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করার ঔদ্ধত্য৷ এটা বিলক্ষণ কাউকে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গি— এমনকি, সত্যেরও তোয়াক্কা না করা৷ অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে ‘তখন বনাম এখন’-এর একটি তুলনা টানলেন, ইউপিএ আমলের সঙ্গে বর্তমান আমলের৷ ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বাস্তব সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, এমন ব্যক্তিমাত্রেই জানবেন যে, এটা কোনও তুলনাই নয়৷ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে উজ্জ্বলতম বছরগুলি হল ২০০৩ থেকে ২০১১— কার্যত পুরোটাই ইউপিএ জমানা— যখন ২০০৭-এর বৈশ্বিক মন্দার বছরটি বাদে আর্থিক বৃদ্ধির হার ধারাবাহিক ভাবে ৮ শতাংশের বেশি ছিল৷ এবং, ১৯৯১-পরবর্তী পর্যায়ে শ্লথতম বৃদ্ধির দশকটি হল নরেন্দ্র মোদির শাসনকাল৷ যা কোনও মতেই নয়, তাকেই ‘হয়’ বলে চালানোর মধ্যে বেপরোয়া ঔদ্ধত্য বিলক্ষণ আছে৷ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন: মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় কী কী ভুল ছিল, সে বিষয় তাঁরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন৷ অর্থনীতির বাস্তবকে রাজনীতির কোন মোচড় দিয়ে তাঁরা পেশ করেন, তা দেখার বস্তু হবে নিশ্চয়ই৷ দিল্লীশ্বররা জানেন, ইদানীং মানুষের এমনটাই পছন্দ৷ এক দিকে রামমন্দিরের বাস্তব, আর অন্য দিকে সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার খোয়াবনামা— এই মিশেলের কোনও মার নেই৷
অর্থমন্ত্রীর ভাষণে এমন একাধিক প্রসঙ্গ রয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে যা অতি তাৎপর্যপূর্ণ৷ যেমন, গরিব-যুব-অন্নদাতা-নারীকে চারটি ‘জাত’ হিসাবে দেখালে অস্বীকার করা যায় মনুবাদী সমাজব্যবস্থার যাবতীয় বাস্তব, যাবতীয় শোষণ ও বঞ্চনা৷ যেমন, বিনিয়োগের পরিমাণ না বাড়লেও কর্পোরেট করের নিচু হার অপরিবর্তিত রেখে দিলে অর্থনীতির যাবতীয় যুক্তিকে অস্বীকার করেই সাঙাততন্ত্রের উপকারসাধন করা যায়৷ অর্থমন্ত্রীর ভাষণে এই কথাগুলি এসেছে নির্বিকার ভঙ্গিতে৷ তাৎপর্যপূর্ণ হল, এক ঘণ্টার সামান্য কম সময়ের ভাষণে বিরোধী বেঞ্চ থেকে শোনা গেল না একটিও শব্দ, এমনকি এই কথাগুলির সময়ও নয়৷ তার কারণ কি এটাই যে, অর্থমন্ত্রীর মতো বিরোধীরা দেওয়াল লিখন পডে় নিয়েছেন?