নওফেল মহঃ সফিউল্লা
ঊনবিংশ শতকে মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স ও তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার বিকল্প একটি শোষণ, বৈষম্য মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মানব সমাজকে, তারই প্রথম স্বার্থক রূপায়ণ হয়েছিল রাশিয়ায় মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে৷ তাই এই ঘটনাকে শুধু মাত্র স্বৈরাচারী জার শাসকদের হাত থেকে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের রাশিয়ার ক্ষমতা দখলের ইতিহাস হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। নভেম্বর বিপ্লব হল দীর্ঘ কয়েক দশকের রাশিয়ার শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পরিণতি৷ তাই আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শোষণ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে যখনই জনগণের অসন্তোষ বিদ্রোহ দেখা দেয় তখনই ১০৭ বছর পরেও ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে আসে। তিন দশকের বেশি সময় হল সোভিয়ত রাশিয়ার পতন হয়েছে৷ একথা অনস্বীকার্য যে সোভিয়ত রাশিয়া তারও কয়েক দশক আগে লেনিনের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও আজও কেন নভেম্বর বিপ্লব বিশ্বজুড়ে শোষণ, বৈষম্য মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা অসংখ্য মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখে! ফিরে দেখি সেই ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের পটভূমির দিকে—
ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়া ছিল মূলত কৃষক অধ্যুষিত নিরক্ষরের দেশ৷ গ্রামীণ জনজীবন ছিল ধর্মীয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন৷ অর্থনীতিও মূলত কৃষি নির্ভর৷ ১৮৬৯ সালে ভূমিদাস প্রথার অবসান হলেও দরিদ্র কৃষকদের উপর জমিদারের শোষণ চলতে থাকে, সমসাময়িক সময়ে জার শাসিত রাশিয়ায় বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগে শিল্পায়ন গতি পায়, তার ফলে এই সময় রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে৷ শ্রমিকের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হতে ১৮৭৫ সালে গড়ে ওঠে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন৷ ১৮৮১ সাল থেকে ১৮৮৬ সালের মধ্যে এই ট্রেড ইউনিয়ন গুলির উদ্যোগে ৪৮ টি ধর্মঘট হয়৷ পরবর্তীতে ১৮৯৫-৯৬ সালের দিকে লেনিনের ‘মুক্তি সংগ্রাম সংঘের’ নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন আরও তীব্র হয়৷ ১৮৯৮ সালে রাশিয়ায় গড়ে ওঠে রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাট এন্ড লেবার পার্টি (RSDLP)৷ পরবর্তীতে দলটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় প্লেখানভ ও মার্টভের অনুগামীরা মেনশেভিক অন্যদিকে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক দল তৈরি হয়৷ মেনশেভিকরা মূলত শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলতো, অন্যদিকে বলশেভিকরা শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে ছিল৷ ফলতঃ বলশেভিক দল এবং তাদের নেতা হিসেবে রাশিয়ার জনগণের মধ্যে লেনিনের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে শুরু করে৷ ১৯০৫ সালে জানুয়ারী মাসে রাশিয়ার জনতা জার দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রাসাদ আক্রমণ করে৷ জারের পুলিশ বাহিনী নির্মম ভাবে নারী-শিশু সহ সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ করে। এই ঘটনা রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক জার শাসনের উচ্ছেদ না ঘটাতে পারলেও আগামীর পথকে তরান্বিত করে৷ ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরে তীব্র খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হয় আকাশ ছোঁয়া, লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারায়৷ সমগ্র রাশিয়া জুড়ে শরনার্থীদের ভিড়৷ এসবের ফলে দেশজুড়ে শুরু হয় জনগণের বিদ্রোহ৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে জার দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত হলে মেনশেভিক কেরেনেস্কি অর্ন্তবর্তী সরকার গঠন করে৷ কেরেনস্কির সরকার শ্রমিকদের চাপে ধর্মঘটের অধিকার সহ কিছু সংস্কার করতে বাধ্য হলেও আদপে এই সরকার প্রকৃত শ্রমিক-কৃষক স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছিল না। এই সময় লেনিন তার বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’-এর মধ্য দিয়ে ঘোষণা করেন অস্থায়ী সরকারকে কোন অবস্থাতে সমর্থন নয়৷ বরং তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মুখোশগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে৷ তার ফলে লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়ত রাশিয়া।
মাও সেতুং- এর লং-মার্চ থেকে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম, কিউবার একনায়কতন্ত্রী শাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা লড়াই থেকে প্যাট্রিস লুমুম্বার স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন প্রেরণা জুগিয়েছিল ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব। ঠিক তেমনই ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের ঢেউ ভারতের মাটিতে এসে পৌঁছেছিল৷ তা যেমন একদিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে এদেশে বামপন্থী আন্দোলনকে নির্মান করেছে, দিশা দেখিয়েছে৷ তার মধ্য দিয়ে দেশ কতটা এগোতে পেরেছে তা অন্য এক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়, কিন্তু আজকের মোদি জমানার ভারতবর্ষের দিকে যদি ফিরে দেখি তাহলে খুঁজে পাই নভেম্বর বিপ্লবের ১০৭ বছর পরেও তার প্রাসঙ্গিকতা কেন বারে বারে ফিরে আসে! অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে আমাদের দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ দেশের মাত্র ১ শতাংশ নাগরিকের হাতে, শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে গৃহিত হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র স্বার্থ বিরোধী নানা নীতি। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে সঞ্চিত হচ্ছে বিশাল ধন সম্পদ, বিশাল ঐশ্বর্য, চলছে তাদের রাজকীয় ভোগবিলাস৷ অন্যদিকে কয়েক কোটি যুবকের হাতে কাজ নেই ও ক্ষুধার্ত মানুষ, অনাহারে বা বিনা চিকিৎসায় মরছে৷ বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১২৭ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১০৫ তম। মানুষের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ধ্বংস হচ্ছে৷ ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার নিম্নগামী, টাকার মূল্য কমছে৷ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, কর্মসংস্থান থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য সব মিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ চরম সংকটে৷ তবুও শাসক প্রতিদিন দরাজ হচ্ছেন কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থে কর ছাড় ও ঋণ মুকুব করতে৷ প্রতিবাদ করলে নেমে আসছে রাষ্ট্রের দমন পীড়ন। ঠিক এখানেই সোভিয়েতের বিপর্যয় তিন দশক পরেও সোভিয়েত রাশিয়ার সোনালী দিন গুলি ফিরে আসে।
যেখানে ছিল সার্বজনীন শিক্ষার প্রচলন৷ ৮০টি মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা৷ প্রাইমারি থেকে ইউনিভার্সিটি স্তর পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা ছিল অবৈতনিক৷ বিনা ব্যয়ে সকলের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল৷ ডাক্তার নার্সের সংখ্যা ছিল পর্যাপ্ত, প্রতিদিন নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছিলো৷ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে ছিল নারী পুরুষের সমানাধিকার ও স্বাধীনতা।সন্তানসম্ভবা মায়েরা পেত সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি। এমনকি সেখানে শ্রমিক–কৃষকরা বছরে ১৫ দিন সবেতন ছুটি পেত স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য সমুদ্র উপকূলে, পাহাড়ের ধারে যাওয়ার জন্য। শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আলাদা রোজগার করতে হত না, রাষ্ট্র তাঁদের সকল দায়িত্ব বহন করত৷ শহরে–গ্রামে হাজার হাজার লাইব্রেরি, থিয়েটার মঞ্চ, সিনেমা হল তৈরি হয়েছিল ছিল বিনা ব্যয়ে বিশ্বসাহিত্য পড়াশোনা, সাংস্কৃতিক বিনোদনের জন্য৷ রাষ্ট্রের ব্যয়ে স্বাস্থ্যচর্চা, ক্রীড়া ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল৷ যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন অলিম্পিকে শীর্ষস্থান দখল করেছিল৷ বিজ্ঞানে এত অগ্রগতি ঘটিয়েছিল যে, পশ্চিমা দেশ নিয়ন্ত্রিত নোবেল কমিটি ১২ জন সোভিয়েত বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দিতে বাধ্য হয়েছিল৷ সোভিয়েত ইউনিয়নই বিশ্বে প্রথম মহাকাশে মানুষ পাঠিয়েছিল৷ সেই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন উপলব্ধি করেছিল গণতন্ত্র মানে কেবল নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নয়। রাষ্ট্রের কাজে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া আদর্শ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এই অনুশীলনও সেখানে শুরু হয়েছিল। নির্বাচনে প্রার্থী হত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক–কৃষকেরা৷ আজও বিশ্বজুড়ে যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলে রাইট টু কল ব্যাকের দাবি ওঠে তা সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শেই অনুপ্রাণিত। এগুলো শুনে আজ মনে হবে এ কোন স্বপ্নলোকের স্বর্গরাজ্য। আজকের বিশ্বে এরকম স্বপ্নলোকের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব তা নিয়ে না না পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আজও যারা অতীতের নানা ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সবরকম বঞ্চনা শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে এখনও সোচ্চারে বলতে পারে এই পৃথিবীটা তোমার একার নয়, আমার একার নয়, আমাদের সকলের৷ তাদের সামনে কোন শর্টকার্ট পথ নেই৷ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে৷ জনগণের প্রয়োজনে অত্যাচারী শাসক শ্রেণীর পতন হবে অন্য দিকে বিজয়ী শ্রেণী যুগের কালিমা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে৷ সেই নতুন যুগ গড়ার সূচনা করতে হলে আজও ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব আমাদের কাছে জ্বলন্ত দীপশিখা ৷
রাজপথ কাঁপে বারবার বিদ্রোহে
পাহাড় ছুঁয়েছে গর্বিত যত শির
অন্য গন্ধ ছড়িয়ে আমরা ধোব
বজ্রমেঘেই সব ধূলো পৃথিবীর…
—ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি