গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ: এক শতাব্দীর সাক্ষী

নিজস্ব চিত্র

প্রবীর মজুমদার

কলকাতা প্রথম কবে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছিল? কমবেশি সব উত্তর আসবে, ১৯৪৭। তবে উত্তরটি ভুল। এটি আশ্চর্যজনক শোনাতে পারে। তবে কিন্তু বাস্তবতা হল ১৭৬৮ থেকে ১৭৭৮ সালের মধ্যে, রাশিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ইউরোপে যুদ্ধের সময়, যখন প্রচুর সংখ্যক গ্রীক মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত হয়েছিল ফিলিপ্পো পোলিস এবং অ্যাড্রিয়ানোপোলিস থেকে। দুটি শহর এখন বুলগেরিয়ার অংশ।

যুদ্ধে রাশিয়ানদের বিজয় বিপুল সংখ্যক তুর্কি ও গ্রীকদের পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য করে এবং তাদের অনেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে উদীয়মান নতুন বাণিজ্য বন্দর তখন কলকাতাকে বেছে নেয়। একই সময়ে ক্যাপাডোসিয়া ও এজিয়ান দ্বীপ থেকে গ্রীক অভিবাসীদের আরেকটি দল কলকাতায় প্রবেশ করে। এই ঘটনা কলকাতাকে বিপুল সংখ্যক গ্রীকদের আবাসস্থলে পরিণত করেছিল। আস্তে আস্তে শহরটার সাথে তাদের আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় গ্রীকদের সংখ্যা নগণ্য ছিল না। সেই গ্রীকরা সকলেই ছিলেন ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। তাঁদেরই উদ্যোগে এই শহরে গির্জা এবং গ্রীক কবরখানা তৈরি হয়।


কালীঘাট ট্রাম ডিপোর পাশে রসা রোড ও লাইব্রেরি রোডের ঠিক মাঝখানে এই গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ। হলুদ রঙের গির্জা, হঠাৎ করে দেখলে কোনো গ্রীক মন্দির বলে ভুল হয়। বারান্দার চারটে থাম ত্রিভুজাকৃতি বিরাট ইমারতটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের অর্থানুকুল্যে এই গির্জা তৈরি হয়, দেওয়ালে সে কথাও লেখা আছে।

গ্রীকদের এই গির্জাটা তুলনায় নতুন। প্রথম গির্জা তৈরি হয় ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিত্যক্ত হয়। তারপর গির্জা তৈরি আমড়াতলা ঘাট স্ট্রিটে। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রধানত গ্রীক ব্যবসায়ী আরগিরি এবং কলকাতার গ্রীকদের উদ্যোগে সেই গির্জা তৈরি হয়েছিল। এই আমড়াতলা গির্জার পিছনে ছিল একটা কবরখানা, যা পরবর্তীকালে ফুলবাগান অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়। কবরখানায় ছিল প্রায় দুশো কবর। সবকটাতে শবদেহ না থাকলেও কবরের উপরের ফলক দেখে বোঝা যায় সেই সময় কলকাতায় থাকা গ্রীকরা কতটা সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ছিলেন। ধীরে ধীরে আমড়াতলার এই অঞ্চল জনাকীর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্র হয়ে ওঠার ফলে গির্জার নিস্তব্ধতা বিঘ্নিত হয়। তাই ১৯২৫ সালে কালীঘাটের এই অঞ্চলে এই গির্জা স্থানান্তরিত হয়।

গ্রীকরা আমাদের কাছে নতুন নন। সেই কোন ছোটবেলায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের রামায়ণ, ছেলেদের মহাভারতের সাথে ইলিয়াড, ওডিসির কাহিনী আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। তারপর ইতিহাস বইয়ে দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার আর ভারতীয় রাজা পুরুর কাহিনি পড়েছি। কিন্তু আলেকজান্ডার বাহিনী ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু নদের তীর থেকে না এগোলেও উত্তরসূরীরা সপ্তদশ শতকে কিন্তু আরও এগিয়ে এসে হুগলি নদীর পাড়ে আস্তানা গেড়েছিলেন।

গ্রীকদের নিয়ে আমাদের পড়াশোনা থেমে থাকেনি। প্লেটো, অ্যারিস্টটলের দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের বিস্মিত করেছে। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার বীজ যে প্রাচীন গ্রিসের পলিস বা নগররাষ্ট্রের মধ্যে, এ কথাও আমরা জেনেছি। শাসকের কোপানলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সক্রেটিসের ইতিহাস আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে।

১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো দ্য গামা ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করে ইউরোপীয় বণিকদের ভারতে আসার পথ সুগম করে দিলেন। পর্তুগীজ, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ বণিকরা ভারতে পাড়ি জমালেন। সবশেষে এলেন গ্রীসের বণিকরা। তাঁরা কলকাতা আর ঢাকাকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। ঢাকায় নুন আর কলকাতায় প্রধানত পাট এবং মশলার কারবার করতেন।

বাণিজ্য করতে দোভাষীর প্রয়োজন হত। সেই প্রয়োজনেই সপ্তদশ শতকের শেষে কলকাতায় আগমন ঘটল প্যানাঘিওটিস অ্যালেক্সিওস আরগিরির। ধনী গ্রীক ব্যবসায়ী, আরগিরি, যিনি ক্যাপ্টেন থর্নহিল নামে অন্য একজন গ্রীক ব্যক্তির দোভাষী হিসাবে ভারতে এসেছিলেন, তিনি যীশু খ্রিস্টের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে গির্জার অর্থায়ন করেছিলেন। এটা বিশ্বাস করা হয় যে ভারতে আসার সময় তার জাহাজ মধ্য সমুদ্রে একটি ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিল এবং তিনি তীরে জীবিত অবতরণ করলে একটি গির্জা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঈশ্বরের কাছে জীবনের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এভাবে কলকাতায় অবতরণের পর তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছ থেকে এই গির্জা নির্মাণের অনুমতি নেন। তিনি ছাড়াও হেস্টিংসের কাছে আপিল পত্রে স্বাক্ষরকারী সকল স্থানীয় গ্রীক ব্যবসায়ীও এতে অবদান রাখেন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমড়াতলার গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার আগেই আরাগিরির জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। কলকাতা শহরের গ্রীক বাসিন্দারা এগিয়ে আসেন তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে। রেভ নিকিফোরস ছিলেন এই গ্রীক চার্চের প্রথম যাজক।

গির্জাটি ৬ আগস্ট, ১৭৮১ সাল থেকে চালু হয়। প্রাথমিকভাবে, গির্জার সংলগ্ন একটি কবরস্থান ছিল কিন্তু শহরে গ্রীক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ১৭৭৭ সালে ফুলবাগানে একটি নতুন কবরস্থান স্থাপন করে। এই গির্জাটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চালু ছিল এবং এটি স্থানীয় গ্রীকদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তবে কলকাতায় গ্রীকরা পরে অন্যান্য ইউরোপীয়দের সাথে মিশে যায় মূলত আর্মেনিয়ান এবং ব্রিটিশদের সাথে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় হারানোর জন্য। তা সত্ত্বেও শহরের বাণিজ্যিক জগতে, ক্লাব, ক্রীড়াঙ্গন এবং পুলিশ বাহিনীতে তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে তারা এখনও কলকাতা এবং ঢাকা উভয় স্থানেই একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় ছিল।

১৯২৪ সালে, স্থানীয় গ্রীকরা তাদের আমড়াতলা গির্জা বন্ধ করে দেয় এবং কালীঘাটে চলে আসে যেখানে সাধারণ গ্রীক মন্দির শৈলীতে একটি নতুন গির্জা নির্মিত হয়েছিল। গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ৩ নভেম্বর, ১৯২৪ -এ এবং এটি ১৯ নভেম্বর, ১৯২৫-এ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এটিকে এখন গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ বলা হয়। গির্জা নির্মাণটি বিখ্যাত গ্রীক কোম্পানি র‍্যালি ব্রাদার্সের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা মোটামুটি অর্থায়ন করা হয়েছিল, সিল্ক, তুলা কাঠ ইত্যাদির ব্যবসায় একটি বাণিজ্য বাড়ি।

গ্রীকরা এই শহরটাকে আপন করে নিতে শুরু করলেও স্বদেশের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেননি। কলকাতার সম্ভ্রান্ত, ধনী, প্রভাবশালী গ্রীকরা মূলত এসেছিলেন তদানীন্তন গ্রীসের পন্তাস, বিথিনিয়া, ক্যাপাদোসিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে। গ্রীসের মানুষ যখন অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন কলকাতার গ্রীক অধিবাসীরা অর্থসাহায্যের জন্য বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে আসেন।

কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ইংরেজদের সাথে গ্রীকরাও শহর ছাড়তে থাকেন। গ্রীকরা দলে দলে লন্ডন, জোহানেসবার্গ রওনা হন। কেউ কেউ আবার দেশে ফিরে যান। ১৯৬০ সালে কলকাতায় একজনও গ্রীক না থাকায় কালীঘাটের গির্জা চরম অব্যবস্থার মধ্যে পড়ে। ১৯৭২ সালে দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে কলকাতার গ্রীক দূতাবাস সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেইসময় এই গির্জার প্রধান পুরোহিত ছিলেন ইগনেসিওস। তাঁর উদ্যোগেই এখানে সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। সিস্টার নেকটারিয়া পারদিসি এখন এই শহরের গ্রীক চার্চের অভিভাবক।

বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার পালন করতে এখন যাঁরা গ্রীক চার্চে আসেন তাঁরা প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত বাঙালি খ্রিস্টান, কেউই গ্রীক অভিবাসী নন।