শ্রী জয়দীপ
শতবর্ষের গৌরব! বর্ধমান টাউন স্কুল এই বছর তার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করল, এক শতাব্দী ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে অসংখ্য জীবন রূপান্তরের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সময়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও, এই স্কুল আজও বর্ধমান জেলার শিক্ষাক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দীপ্তিমান। শুরুটা ছিল প্রচন্ড সংগ্রামের।
বর্ধমান টাউন স্কুলের জন্ম লগ্নের সময়টাই ছিল ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সেই সময় ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দেশ জেগে উঠছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। এই উত্তাল সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বনির্ভরতার আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে বর্ধমান টাউন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯২৫ সালে, বর্ধমান ডিভিশনের তৎকালীন স্কুল ইন্সপেক্টর মিস্টার গ্রিফিথ বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেন, কারণ ৮০০ জন ছাত্রের বিপরীতে মাত্র ৩০ জন শিক্ষকের ভারসাম্যহীনতা শিক্ষার মানকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, বর্ধমান কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য মৌলানা আব্দুল কাশেম, জেলার একটি সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবিতে জোরালো আবেদন জানান। তৎকালীন সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বর্ধমান আদালতের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি বাগানবাড়িকে স্কুলের জন্য মনোনীত করে। মজার বিষয়, আজকের ‘বর্ধমান টাউন স্কুল’ সেই সময় পরিচিত ছিল ‘কাছারি বাড়ি’ নামে, যার স্মৃতি আজও ‘কাছারি রোড’-এর নামকরণে জড়িয়ে আছে।
প্রায় ২৭ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত এই বাগানবাড়ির মধ্যে ছিল দুটি পুকুর, এক বিশাল ফলের বাগান, এবং একটি সুদৃশ্য দুই তলা ভবন—যা বর্তমানে ‘ওল্ড বিল্ডিং’ নামে পরিচিত। এক লক্ষ দুই হাজার টাকার বিনিময়ে সরকার এই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে এবং বিদ্যালয় গঠনের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু ইতিহাসের মোড় আবার ঘুরে যায়। ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের ফলে সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। তখনই স্বদেশি আদর্শে পরিচালিত একটি বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় বর্ধমান টাউন স্কুল। আমি যখন ১৯৮৯ সালে এই ঐতিহ্যময় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই, তখন স্কুলটি তার পূর্ব গৌরব হারাতে শুরু করেছে। ৯০-এর দশকের শুরুতে টাউন স্কুল এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধের অভাব, অব্যবস্থাপনা, এবং শিক্ষার মানের অবনতি স্কুলকে ক্রমশ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। সেই সময়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনজন প্রধান শিক্ষক বদল হয়—শক্তিপদ চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্ত কুমার গঙ্গোপাধ্যায় এবং সৈয়দ বজলুল করিম। শক্তিপদবাবু নম্র প্রকৃতির জন্য, তার নেতৃত্বে সংকল্পের দৃঢ়তা ছিল না, যা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য জরুরি ছিল। ফলে কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগত টিউশনে মনোনিবেশ করেন এবং শিক্ষার মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ক্লাস অনিয়মিত হত, শিক্ষকরা দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলছিলেন, আর ছাত্রদের মধ্যেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। আমি নিজেও, প্রথমে মর্নিং শাখায় ভর্তি হলেও, প্রথম তিনজনের মধ্যে স্থান পাওয়ার পর ডে-শাখায় স্থানান্তরিত হই। কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
এই সংকটময় পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে, ১৯৯৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি, বর্ধমান টাউন স্কুলের ৬৮তম জন্মদিবস তিনি স্থায়ী প্রধান শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার পরে। তার ১২ বছরের প্রধান শিক্ষকের সময়কালের, তিনি শুধু শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেননি, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যা বাংলার অন্যান্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে দৃষ্টান্তমূলক। দুর্গাবাবু বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল নয়, বরং ছাত্রদের মনে নৈতিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা, এবং আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করা। তাঁর দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় নেতৃত্বের ফলে ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই স্কুলের চেহারায় নাটকীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ৩১ শে জানুয়ারি ২০০৫ সালে যখন তিনি রিটায়ার করেন,তার মধ্যেই স্কুলটি আবার জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ঐ সাফল্যের একটি মাইলফলক: সৌমজিৎ দে-র ঐতিহাসিক স্বীকৃতি অর্জন। এই পরিবর্তনের চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ২০০৩ সালে, যখন টাউন স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনজন কৃতি ছাত্র রাজ্যস্তরে সাফল্য অর্জন করে -হিরন্ময়ী মন্ডল, শেখ তৌসিফ মোহাম্মদ ও সৌমজিৎ দে। তাদের মধ্যে সৌমজিৎ দে রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে, যা শুধু দুর্গাবাবুর নেতৃত্বেরই ফসল নয়, বরং মূল্যবোধনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যের মাইলফলক।
আজ, যখন বর্ধমান টাউন স্কুল তার শতবর্ষ উদযাপন করছে, এটি শুধুমাত্র অতীতের গৌরবের স্মরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের আরও সমৃদ্ধ, আধুনিক ও মূল্যবোধনির্ভর শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দূরদর্শিতার ফলেই আজ স্কুলটি জেলার গৌরবময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার অবদান শুধু একটি স্কুলকে নয়, অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর জীবনকে আলোকিত করেছে।তার অবদানের জন্য, তিনি ৫ ই সেপ্টেম্বর ২০০০, তখনকার রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়নের হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছেন,যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শতবর্ষ পূর্তির এই মহোৎসব শুধুমাত্র অতীতের গৌরব উদযাপন নয়, বরং ভবিষ্যতের শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখার প্রতিজ্ঞা। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে শুরু হওয়া এই নবজাগরণ আজও বহু প্রজন্মের মনে বর্ধমান টাউন স্কুলের গৌরব ও ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। আমরা প্রাক্তনীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আগামী শতবর্ষেও এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার আলোকবর্তিকা বহন করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবে। শতবর্ষের এই গৌরবময় যাত্রা আগামী দিনেও হোক সমান আলোকময়!