রাজা নবকৃষ্ণ দেবই কলকাতায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন ১৭৫৭ সালে তাঁর শোভাবাজারের রাজবাড়িতে। অবশ্য অনেকের মতে বাংলায় সর্বপ্রথম শরৎকালীন এই দূর্গাপুজোর উদ্যোগ নেন এবং প্রচলন করেন নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর এই পুজোর কথা শুনে এবং অনুপ্রাণিত হয়ে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবও ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন।
প্রসঙ্গত, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব সিরাজদৌল্লা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের হাতে পরাজিত হবার পরে , ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবকে ডেকে বলেন, ইংরেজদের এই জয়ের জন্য বঙ্গদেশের চতুর্দিকে বিজয় উৎসবের আয়োজন করতে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই এই উৎসবের সমস্ত খরচ বহন করবে। রবার্ট ক্লাইভের এই অভিনব প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত অনুগত, প্রভুভক্ত এবং স্তাবক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ঠিক আছে, আপনার কথা মতো আমরা এবার শরৎকালেই উৎসবের আয়োজন করব মা দুর্গার পুজো করে।
রাজা রামচন্দ্র লঙ্কার রাক্ষসরাজা রাবণ বধের আগে এই দেবীপুজো করেছিলেন। এবার আমরা করব রাবণ বধের পরে। এতে কোনও আপত্তি নেই। সেই সময় ধূর্ত ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ বলেছিলেন, বাংলার সমস্ত জমিদারদের এই পুজো করতে হবে একই সময়ে।
সমস্ত জমিদারদের ভোজের ব্যবস্থা করতে হবে পুজো উপলক্ষে। জমিদারদের খাজনা মকুব করবে কোম্পানি। বঙ্গদেশে উৎসবের জাঁকজমকের যেন কোনও খামতি না হয়। রবার্ট ক্লাইভের কথামতো ১৭৫৭ সালে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ শরৎকালে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন বেশ জাঁকজমকভাবে।
এরপরে শরৎকালেই বাংলার সর্বত্র দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যায়। কমতে থাকে বাসন্তীপুজোর সংখ্যা। ১৭৫৭ সালে কলকাতায় নবকৃষ্ণ রাজবাড়িতে প্রবর্তিত প্রথম দুর্গাপুজোয় নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন রবার্ট ক্লাইভ এবং তার দলবল।
এই দুর্গাপুজো উপলক্ষে কবিগান, আখড়াই, বাঈ নাচ, যাত্রাপালা প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়েছিল। সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর, কালীঘাট এবং আশপাশের আরও অনেক গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ এসেছিলেন এই নতুন শরৎকালীন দুর্গাপুজো দেখতে।
রবার্ট ক্লাইভ এবং অন্যান্য সাদা চামড়ার লোকদের জন্য লখনউ থেকে বাঈ এনে নাচের এবং গান শোনার ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ। কলকাতার প্রথম এই দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান চলেছিল পনের দিন ধরে। কৃষ্ণনগর থেকে মৃৎ শিল্পী এনে তৈরি করা হয়েছিল দেবীমূর্তি।
১৭৫৭ সালের এই শরৎকালীন দুর্গাপুজোয় খরচ হয়েছিল লক্ষাধিক টাকা। রবার্ট ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে পুরোহিতের দক্ষিণা ১০১ টাকা এবং ঝুড়ি ঝুড়ি ফলমূল পাঠিয়েছিলেন এই পুজো উপলক্ষে। বাংলায় শরৎকালীন দুর্গাপুজো প্রবর্তন করার ব্যাপারে মূল হোতা এবং নেপথ্য কারিগর ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাধ্যক্ষ রবার্ট ক্লাইভ।
মূলত তার বদান্যতায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় শরৎকালে যে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল বঙ্গদেশে, তা আজকে বাঙালির সর্বজনীন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।