• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 April, 2025

রাজনীতির পদ্মবনে ভাষা দূষণের মত্ত হস্তী

রাজনীতিতে কুকথার চল নিয়ে মুখ খুলছেন সাধারণ মানুষও। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “খারাপ কথা বলা কখনওই উচিত নয়।"

প্রতীকী চিত্র

রতন ভট্টাচার্য

সমাজজীবন ও রাজনীতিতে যে ভাবে কুরুচিকর শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে রাজনীতিতে কুরুচিকর শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা আরও বেড়েছে। কোন সমাজ কতটা উন্নত এবং রুচিশীল সেটা প্রমাণ হয় ভাষা প্রয়োগ থেকে। কিন্তু কিছু সময়ে যেমন ঝগড়া বা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মানুষ তার সংযম হারায় এবং অশ্রাব্য কথা বলে ফেলে। সমাজে, বিশেষত রাজনীতি এবং নির্বাচনের মতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘সীমাজ্ঞান’ থাকাটা যে আবশ্যিক। নির্বাচনের আবহে প্রচারের সময় রুচিশীল মন্তব্য খুবই প্রয়োজন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাষা কেন শালীন হবে না, এটাই তো প্রশ্ন। একজন নেতা অন্য নেতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যে ভাষা প্রয়োগ করছেন, সেটা রুচিশীল হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। রাজনীতির আঙিনায় ভাষার প্রয়োগ, শব্দ চয়ন এবং তার শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন বা আলোচনা কোনওটাই নতুন নয়। ভাষার দূষণ রোধ করার আর একটি সহজ উপায় হলো প্রচুর বই পড়া। নিয়মিত বই পড়া মানে শব্দ ভান্ডারের মহাসমুদ্রে স্নান করা। প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কে যখন নিত্য নতুন শব্দ সিঞ্চন করা হয় তখন আপনা আপনিই কথা বলার সময় অন্য ভাষার শব্দ এড়িয়ে চলা যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা বই পড়েন কি?
একটি ব্যাপার খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকলে অবশ্য খেয়াল না করে উপায়ও নেই। আর তা হচ্ছে বিশ্বের জনপ্রিয় নেতারা সবাই বই পড়েন; তা তিনি রাজনৈতিক নেতা হোন আর ব্যবসায়ী নেতা হোন।

বারাক ওবামা দু–চার দিন পরপরই টুইটারে নিজের পড়া বই নিয়ে টুইট করেন। মিশেল ওবামাও বই নিয়ে ভীষণ সরব। প্রায়ই তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থিত হয়ে বই নিয়ে আলোচনা করেন। বিল গেটস প্রতিদিন বই পড়েন এবং সেসব বই নিয়ে লম্বা লম্বা আলোচনা লেখেন নিজের ওয়েবসাইট গেটস নোটসে। আরেক ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের বই পড়া নিয়েও প্রায়ই বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। প্রযুক্তি বিশ্বের তরুণতর নেতা মার্ক জাকারবার্গও বই পড়েন। মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এমনকি আমাদের সময়েও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বই পড়তেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত পড়েন আর বই লিখেও যাচ্ছেন নিয়মিত। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, ভালো নেতা হতে হলে কি বই পড়া জরুরি? এ বিষয়ে নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ এবং পিয়েডমন্ট হেলথ কেয়ারের এক নির্বাহী পরিচালক এলিজাবেথ ওয়াং বলেছেন, ভালো বই, বিশেষত ভালো উপন্যাস মানুষের নেতৃত্ব বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখে। দুঃখের বিষয় হল, বেশির ভাগ নেতাই বই পড়া ছেড়ে অশোভন ভাষা প্রয়োগের প্রশিক্ষণ নিতে অধিকতর আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। নেতাদের বাইরে একটা ভদ্রতার মুখোশ আছে কিন্তু হিপোক্রিসিও আছে। কারও মৃত্যু কামনা করা, চরিত্র হনন, কারও পরিচয় নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য রাজনীতিতে বেড়ে চলেছে। এটা কাম্য নয়। তবে রাজনীতির প্রসঙ্গ এলেই কুরুচিকর ভাষার উল্লেখ আজ থেকে নয়। এই চল বহু যুগ আগে থেকেই বলে জানা যাচ্ছে।

যুদ্ধের আগে প্রতিপক্ষকে ‘উত্তেজিত’ করতে কুকথার প্রয়োগ রামায়ণ-মহাভারতের যুগ থেকে চলে আসছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে যুদ্ধের আগে অঙ্গদ গিয়ে ইন্দ্রজিৎকে উত্তেজিত করার জন্য যে ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন তা শালীন ছিল না। মহাভারতে শকুনির ছেলে উলুক গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে যে ভাষায় আক্রমণ করে এসেছিল, সেটাও তো ভাল কিছু নয়। তাই রাজনীতি এলেই খারাপ কথা এসেছে এই বিষয়টা বহু পুরনো। সাময়িক উত্তেজনার কারণে বেফাঁস মন্তব্য করে বসেছেন এমনও নেতা আছেন। আবার স্রেফ খবরে থাকার জন্য ভাষণে কুকথা ব্যবহার করেছেন এরকমও বহু উদাহরণ আছে। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাও আছে যাতে বোঝা যায় রাজনীতিতে সৌজন্য প্রদর্শনের প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। অন্ততঃ আমাদের রাজ্যে।

একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সদ্য প্রয়াত হয়েছেন ৮০ বছর বয়সে, তাঁর প্রয়াণে শোকের আবহ রাজ্য রাজনীতিতে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন সকলেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ পাম অ্যাভিনিউয়ে বুদ্ধদেবের বাড়িতে ছুটে যান সেদিন। সেখানে বুদ্ধদেবের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। বুদ্ধদেববাবুর তীব্র বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সেদিন সুচেতনকে পাশে বসিয়ে বলেছিলেন, “মারা গেলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না, কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে থেকে যান। বার বার এই বাংলার মাটিতেই ফিরে আসুন আপনি।” এটা ছিল রাজনীতিতে সৌজন্য প্রদর্শনের সেরা উদাহরণ। আমার মত যারা প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না তারাও একটা মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন। কিন্তু যেভাবে অতি দ্রুত রাজনীতির ভাষা, ভঙ্গি রাজনীতিবিদদের নানা অশোভন কার্যকলাপে দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে তাতে নতুন প্রজন্ম যারা এমনিতেই রাজনীতি থেকে নিজেদের শত যোজন দূরে সরিয়ে রাখে তারা এর পর রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করবে না তো! আর ঘূণা করতে আরম্ভ করলে বাম ডান কোনও পন্থী বাদ যাবে না। তাহলে কী রেখে যাচ্ছেন তারা রাজনীতিতে? এটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাবমূর্তি রক্ষা না হলে, সব শেষ হয়ে যাবে। ভয়ঙ্কর খারাপ হচ্ছে, অপরাধ হচ্ছে। কুকথার স্বল্পমেয়াদি প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবন অসহনীয় করে তুলেছে। রোজ পথে ঘাটে তুলকালাম সব ঘটছে। কিন্তু এসবের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা ভাবলে বিষয়টি আরো বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে স্বচ্ছ্বতা ও শালীনতা বজায় থাকাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমার পরিবারের নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে আসতে দিতে পারি, কিন্তু তাকে শিক্ষিত ও স্বচ্ছ্ব রাজনীতিবিদ হতে হবে। যাঁরা কলেজে পড়ছেন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ঘাঁটছেন, এসব দেখে তাঁদের মনে হবে, এই কি রাজনীতি? এঁদের দেখে রাজনীতি করব? রাজনীতিবিদদের একটা অন্য স্তরের জীব ভাবছে ছেলেমেয়েরা। খুব ভয় করে। খারাপ লাগে এই ভেবে যে, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করে! এখন খুল্লাম খুল্লা কুকথার অন্তঃহীন স্রোত বইছে। কুকথা ব্যবহারের চল প্রাচীনকালেও ছিল। কে খারাপ কথা বলেননি? মহাভারতে কর্ণ বলেছেন, দুর্যোধনও বলেছে। কৃষ্ণও বলেছেন, হয়তো একটু ঘুরিয়ে। খারাপ কথা রাজনীতিতে আসেনি এমনটা হয়নিসামাজিক কাঠামোতে। কিন্তু এখন যেন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদরা।

আগে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতেন রাজনীতিবিদরা। একটা কথা সবার ভাবা দরকার, খারাপ কথা বলার প্রতিযোগিতা হলে কারা জিতবে? হয়তো কেউই নয়, কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো বটেই, বৃহত্তর অর্থে রাজ্যে বা দেশে সংস্কৃতির সবচেয়ে সুন্দর ধারাটি এক্ষেত্রে ব্যাহত নয় হত হচ্ছে। বিভিন্ন দলগুলির মধ্যে দ্বৈরথ চরমে। দুই দলের নেতারাই পরস্পরকে তীব্র আক্রমণ করছেন, ভাষার ব্যবহারেও লাগাম থাকছে না। আগে রাজনীতিতে শালীনতা মোটামুটি বজায় ছিল কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে কুরুচিকর ভাষার ব্যবহার অনেকটাই বেড়েছে। এর আগে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার সময় সীমা এত অতিক্রম করতে দেখা যায়নি কখনও। রাজনীতিতে ভদ্রতা বলে একটা কথা ছিল যাকে বলা হত রাজনৈতিক চাণক্যগিরি বা পলিটিক্যাল ডিপ্লোম্যাসি। রাজনীতিতে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, কুকথায় একেবারে সায় ছিল না এমন বড়মাপের নেতা নেত্রীদের। ‘কী রেখে গেলাম রাজনীতিতে, আমাদের তো ঘৃণা করবে তরুণরা!’ রাজনীতিতে কুকথার ফোয়ারা নিয়ে বলেছিলেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব। সম্প্রতি বিরোধী দলনেতার সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কুকথা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও বলেছেন,কেউ একজন আগুন লাগিয়ে চলে যায়। কিন্তু পুড়ে মরে সবাই যারা থাকে।

রাজনীতিতে কুকথার চল নিয়ে মুখ খুলছেন সাধারণ মানুষও। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “খারাপ কথা বলা কখনওই উচিত নয়। ভাল কথা বলতে তো অর্থ লাগে না, তা হলে ভাল কথা কেন নয় এই প্রশ্ন তো বরাবরই রয়েছে। শালীনতা রাখা, মাত্রা বজায় রাখা আমাদের প্রাচীন ভাবনা এবং দর্শনে আছে। কিন্তু খারাপ ভাষায় যে ‘ফোর্স’ রয়েছে সেটা ভাল শব্দের চাইতে বেশি।” শালীনতা ও রুচিশীলতাকে ‘সভ্যতার মাপকাঠি’ বলে ব্যাখ্যা করছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তার কথায়, “শালীনতা হল ভদ্র সমাজের বৈশিষ্ট্য। “চিত্র শিল্পী মাতিস বলেছিলেন, ব্ল্যাক ইজ ফোর্স। সেই কালো থেকে কালীও তৈরি হয়েছেন, আবার কৃষ্ণও। অর্থাৎ কালো দিয়েও ভাল কিম্বা মন্দ দুই-ই করা যায়।
কেন নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসতে আগ্রহী নয়। আমরা কি তাদের সেই পরিবেশটুকু দিতে পারছি? বলা হয় যার নাই কোন গতি/সে করে রাজনীতি। রাজনীতি যদি রাজার নীতি তাহলে ভাষাতেও রাজকীয় আভিজাত্য থাকবে আশা করাই যায়। আমরা ভাবি বাড়ির ছেলে মেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাব। কিন্তু সে রাজনীতিতে আসুক সেটা চাই না বললেই সত্যি কথাটা বলা হয়। টিভিতে, খবরের কাগজে শিরোনামে উঠে আসা রাজনৈতিক হোমরা চোমড়াদের মন্তব্য, বাড়ির ছোটদের সামনে দেখা বা পড়া যায় না।

“রাজনীতির ভাষা নিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা দিতে চাইছি? সে কাকে নির্বাচন করবে, সেই প্রতিনিধির ভাষাই যদি রুচিশীল না হয়? কেউ বলছে অমুক ধর্মের জন প্রতিনিধিকে চ্যাংদোলা করে ফেলে দেব, কেউ বলছে অমুক ধর্মের লোককে কেটে অমুক নদীতে ভাসিয়ে দেব, কিংবা অমুককে ঠুঁসে দেব কেউ বলছে ঠ্যাং ভেঙে দেব তখন তাঁদের মত জন প্রতিনিধির জন্য অবজ্ঞা আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কিছু দল ব্যবস্থা নিলেও তাতে বিশেষ হেরফের হয় না। কিছু দল সরবে তাদের নেতাদর কুকথাকে বেশ করেছে এটা বলার জন্য টিভির সান্ধ্য বৈঠকে হাজির হয় সেজে গুজে নির্লজ্জতার সীমা না রেখে। সাধারণ সময় বা নির্বাচন প্রচারে ভাষা রুচিশীল হোক এই কথা বলতে যখন রাস্তায় নামতে হচ্ছে তার চাইতে হাস্যকর আর কী হতে পারে! নির্বাচন বা রাজনীতির ময়দান তো জনসেবার জন্যই তার নৈতিকতার দিকটি কোনও যুক্তিতেই অস্বীকার করা যায় না। জনসেবায় যদি কুরুচিকর ভাষা প্রয়োগ হয় তাহলে সেবককে নিয়ে দ্বিধা তো থাকেই। জনসেবা করতে চাইছেন কিন্তু একে রাজনীতিবিদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে কারণ তাদের মধ্যে আছেন দেশের আইন প্রণেতারা, তাদের মধ্যে রয়েছে নৈতিকতার ধারক ও বাহকরা। এটা অস্বীকার করলে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় অস্বীকার করা হবে।নিজেকে ও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপসংস্কৃতির ভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃতিশোভন ভাষা আগে পরিপূর্ণভাবে শিখতে হবে তারপরেই জীবনের কর্মপথে জনসেবার কাজে অগ্রসর হতে হবে।