• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্য নিয়ে চারদিকে চলছে জোর চর্চা

বরুণ দাস:  ভাজপা বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম শরিক বা সঙ্গী হয়েও সেই জোটকেই রাজ্যস্তরে কাঁচকলা দেখিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে একাই লড়ে ২৯টি আসন ছিনিয়ে নেওয়া কম কথা নয়৷ বাড়ন্ত ভাজপার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ২২ থেকে ২৯-এ পৌঁছনো মোটেই ছেলেখেলা নয়৷ এজন্য রাজনৈতিক দম থাকা দরকার৷ বিরোধীরা যে যাই বলুন না কেন, সেই প্রয়োজনীয়

বরুণ দাস:  ভাজপা বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম শরিক বা সঙ্গী হয়েও সেই জোটকেই রাজ্যস্তরে কাঁচকলা দেখিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে একাই লড়ে ২৯টি আসন ছিনিয়ে নেওয়া কম কথা নয়৷ বাড়ন্ত ভাজপার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ২২ থেকে ২৯-এ পৌঁছনো মোটেই ছেলেখেলা নয়৷ এজন্য রাজনৈতিক দম থাকা দরকার৷ বিরোধীরা যে যাই বলুন না কেন, সেই প্রয়োজনীয় দম বা ক্ষমতা আছে প্রায় সত্তরের দোরগোড়ায় পা রাখা তৃণমূল নেত্রীর, একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷

তৃণমূল নেত্রী নিজেও কি ভেবেছিলেন এমন আশাতীত ফলাফল? সম্ভবতঃ না৷ গতবারে প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ধরে রাখাটাই ছিল এবারের চ্যালেঞ্জ যদিও নির্বাচনের আগে মুখে অনেককিছুই বলেছিলেন তিনি৷ ওসব কথা স্রেফ বলার জন্যই বলা৷ যিনি বা যাঁরা বলেন, তাঁরাও ভালোভাবেই জানেন সেকথা৷ দলীয় কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে ভোটারদের মধ্যে জয়ের একটা কৃত্রিম বাতাবরণ তৈরি করা যাতে তাদের ভোট নিজেদের অনুকূলে আনা যায়৷ গতবার যেমন বলেছিলেন, ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ৷’

সচেতন মানুষ অবশ্যই জানেন, এসব নিছকই কথার কথা৷ বলার জন্যেই বলা৷ নির্বাচনী চমক মাত্র৷ শুধু নির্বাচনী ক্ষেত্রেই কেন, চমক চাড়া সব ক্ষেত্রেই আজকের দুনিয়া অচল৷ আধুনিক বিজ্ঞাপনী চমক যেমন ক্রেতাদের চূড়ান্ত বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়৷ শিক্ষিত সচেতন মানুষও এখনকার বিজ্ঞাপনী চমকে অন্ততঃ একবারের জন্যেও ভুলপথে পা বাড়ান৷ এমনই তার মাহাত্ম্য৷ এখনকার রাজনীতির অঙ্গনও ঠিক তাই হয়ে উঠেছে৷ দুইয়ের মধ্যে খুব একটা তফাত দেখা যায় না৷ এমনই সব অদ্ভূতুরে কাণ্ড৷

বলা বাহুল্য, তৃণমূল নেত্রী এ রাজ্যে তাঁর পুরনো দলকে একেবারে আপাংক্তেয় করে দিয়েছেন৷ ’৯৮-এ সাবেকি দল কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গড়ার পরপরই কংগ্রেস তার জনসমর্থন এবং সাবেকি ঐতিহ্য দুই হারিয়েছে৷ প্রায় দেড়শ বছরের কাছে পা দিতে চলা দলটির চূড়ান্ত দৈন্যদশা দেখলে প্রাচীন কংগ্রেসিদের দুঃখ-যন্ত্রণা হওয়ারই কথা৷ কিন্ত্ত প্রতিকারের পথও কংগ্রেসের সম্ভবতঃ অজানা৷ ২০১৯-এর লোকসভায় বাংলা থেকে কংগ্রেসের পকেটে ছিল দু’টি আসন, এবার অর্থাৎ ২০২৪-এর লোকসভায় হল এক৷

শুধু কংগ্রেস কেন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামপন্থীদের অবস্থাও কি শোচনীয় করে ছেড়েছেন তৃণমূলনেত্রী৷ একসময় ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ বলা হতো৷ ‘দুর্জয় ঘাঁটি’ বলতে অবশ্য ‘বামদুর্গ’ বোঝাতেন বামপন্থীরা৷ সেই বামঘাঁটির এখন কী চূড়ান্ত দুর্দশা৷ এখন বলা হয়, ‘বাংলার মাটি তৃণমূলী ঘাঁটি’৷ সেই ‘বামদুর্গ’ বলে কথিত বাংলা থেকে বামপন্থীরা লোকসভা কিংবা বিদানসভায় একজনও প্রতিনিধি পাঠাতে অপারগ৷ বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্র যে এভাবে আমূল বদলে যাবে তা কেউ কখনও ঘুণাক্ষরেও ভাবতেও পারেননি৷

যদিও নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এর কারণ হয়তা কিছুটা অনুমান নয়, নির্ণয় করাও যায়৷ কংগ্রেস ও সিপিআইএম— উভয় দলের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের উৎসমূলেও পৌঁছনো যায়৷ কিন্ত্ত তারা তা করতে অপারগ৷ তাদের তেমন মানসিক শক্তি নেই৷ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় তাদের৷ অথচ সেই কবে কবি-মনীষী রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, ‘মনেরে তাই কহ যে / ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে৷’ সত্য এই যে, আমরা অনেকেই সত্যেরে সহজ লইতে বা গ্রহণ করতে পারি না৷

মিথ্যের মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসি৷ বিশেষ করে আজকের অবক্ষয়িত রাজনীতির ক্ষেত্রে৷ তাই আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা বা পরাজয়ের সঠিক কারণ খোঁজার কোনও চেষ্টাই করি না৷ বরং একেবারে অকারণে এর-ওর ঘাড়ে দোষ চাপাতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি৷ যাতে নিজেদেরকে নিপাট নির্দোষ হিসেবে জাহির বা প্রমাণ করা যায়৷ এই (কু বা অপ)প্রবণতা যে আখেরে নিজেদেরই সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনে তা বুঝতেও অক্ষম আমরা৷ আর এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে আসল ট্র্যাজেডি৷

প্রাসঙ্গিক ভূমিকার পর এবার ফিরে আসা যাক ২০২৪-এ তৃণমূল কংগ্রেসের বাংলা জয়ের গাথায়৷ কীভাবে এবং কোন পথে তারা এমন অভাবনীয় নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন? ভাজপা তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ে একটি হলেও বেশি আসন পাবে বলে জোর প্রচার করেও শুভেন্দুবাবুর দল গতবারের প্রাপ্ত আসন ধরে রাখা তো দূরের কথা, বরং ৬টি আসন হারিয়েছে৷ অথচ অর্থ আর প্রচারে কোনওরকম খামতিই ছিল না তাদের৷ আর কংগ্রেস এবং সিপিআইএম? এমন মুখ থুবড়ে পড়েছে যে কহতব্য নয়৷

মহামান্য কলকাতা উচ্চ আদালত, কেন্দ্রীয় দুই তদন্তসংস্থা সিবিআই আর ইডি এবং সর্বোপরি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে শাসকদলের নানাবিধ দুর্নীতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু খবর প্রকাশ্যে এসেছে৷ কী বললেন মাননীয় বিচারপতি, সিবিআই আর ইডির তদন্তে আজ কোন তথ্য উঠে এলো, কাকে ডেকে পাঠালো ওই দুই তদন্তসংস্থা, কে ডাক পাওয়া সত্ত্বেও উপস্থিত হয়নি তদন্তসংস্থার অফিসে, কোন মামলায় কোন হেভিওয়েট আইনজীবী দাঁড়ালেন অভিযুক্তের হয়ে ইত্যাদি খবরে ছিল অনেকেরই কৌতূহল৷

কবে কার বাড়িতে ভোররাতে হানা দেবে কেন্দ্রীয় দুই তদন্ত সংস্থা সিবিআই আর ইডি, তা নিয়েই ঘোর আতঙ্কে ডুবে ছিলেন শাসকদলের মান্যগণ্য নেতামন্ত্রী তথা রাজ্যের শাসকদলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সহ রাজ্য শিক্ষা পর্ষদের বড় মাপের কর্তাব্যক্তিরা যেন ‘জেল ভরো আন্দোলন’-এ শামিল হয়েছেন৷ পর্ষদের সবাপতি তথা মাননীয় বিধায়ক, অধ্যক্ষ, উপদেষ্টা, এমনকি উপাচার্য পর্যন্ত রয়েছেন এই দলে৷

এটা যে কোনও শাসকদলের পক্ষেই অত্যন্ত অস্বস্তির কারণ৷ অন্যদিকে রাজ্যের লড়াকু বিরোধী নেতার দাপুটে আস্ফালন৷ এই চূড়ান্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতেই ২০২৪-এর লোকসভার নির্বচন লড়তে হয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে৷ শাসকদলের চারদিকে যেন ঘোর অমনিশার ঘনকালো অন্ধকার৷ কোথাও এতটুকু আলোর দেখা নেই৷ একেবারে প্রতিকূল পরিস্থিতি৷ এই আপাদমস্তক প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে যে কোনও নির্বাচনে লড়াই দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা৷ জয়-পরাজয় তো অনেক পরের ব্যাপার৷

কিন্ত্ত ঘাবড়ানোর পাত্রী নন এককালের লড়াকু বিরোধীনেত্রী৷ দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর দাপুটে পদক্ষেপ (অনেকে বলেন হিটলারি কায়দা)অনেকেই তটস্থ৷ এমনকি, তাঁর ভুল ধরার সামান্য সাহসটুকুও নেই দলের অন্য কারও৷ এটা যদিও দলের পক্ষে মোটেই ভালো নয়৷ কিন্ত্ত ভালোমন্দ মিশিয়েই দল পরিচালনা করেছেন তিনি৷ যাকে দলের ‘সেনাপতি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, তিনিও আসলে তাঁরই হাতের পুতুল মাত্র৷ তিনি ছাড়া তাঁর সেনাপতিও যে অচল একথা শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও জানেন৷

অথচ নির্বাচন শেষে ৪ জুন ফলাফল ঘোষণারপর দেখা গেল, সব ধরনের চাপ নিয়েও রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের জয়-জয়কার৷ আইন-আদালত-সিবিআই-ইডি সব বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে অষ্টাদশ লোকসভায় নিজেদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে রাজ্যের শাসকদল৷ এ যেন ‘এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন’-এর মতোই অবস্থা৷ কিন্ত্ত কী করে এটা সম্ভব হল তা নিয়ে চলছে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে সাধারণ মানুষ সবারই অপার কৌতূহল তৃণমূল কংগ্রেসের এই অভাবনীয় জয় নিয়ে৷

কেউ কেউ বলছেন এটা আসলে ডোল রাজনীতির অনিবার্য ফসল৷ ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’তে এমনটা হয়েই থাকে৷ অনেকে যাকে সামাজিক কর্মসূচি বা কল্যাণমুখী প্রকল্প বলেন, তারই হাতে গরম ফল পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ এখন তো ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসির যুগ৷ গোদা বাংলায় বলা যায়, ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ আর কী৷ যদিও দক্ষিণের এক রাজ্যেও কিন্ত্ত এই ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ কোনও কাজেই আসেনি এবার৷ তাহলে? কী ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তৃণমূল কংগ্রেসের এই অভাবনীয় সাফল্যকে?

তাহলে কি এভিএম তথা ভোট মেশিনে কারচুপি? সে তো একমাত্র দিল্লির ভাজপাই করতে পারে বলে মনে করেন অনেকে৷ রাজ্য সরকারের পক্ষে এমনটা করা কখনওই সম্ভব নয়৷ কারণ ওই ভোট মেশিনের নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ওরফে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে৷ ভাজপা এ রাজ্যে বেশি আসন পেলে না হয় তেমন ‘গুরুতর অভিযোগ’ তোলা যেত বিতর্কিত মোদি-শাহ সরকারের বিরুদ্ধে৷ কিন্ত্ত এক্ষেত্রে তো খোদ ভাজপার গতবারের প্রাপ্ত আসনই কমে গেছে৷ তাহলে বাকি রইল অন্য কী রহস্য?

রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে ‘কাজ’-এ লাগিয়ে বুথ দখল? ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া? বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দিয়ে ব্যাপক হারে ছাপ্পা ভোট দেওয়া? এই উপমহাদেশের যে কোনও নির্বাচনের সঙ্গে যে অভিযোগগুলি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকে আর কী৷ এর কিছুই যে হয়নি তেমনটা হয়তো নয়৷ কিন্ত্ত তৃণমূল কংগ্রেসের এই অবাবনীয় জয়ের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা সেভাবে কাজ করেনি একথা অবশ্য বলাই বাহুল্য৷ তাহলে আর কি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে?

অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, তৃণমূল নেত্রীর জনসম্মোহনী শক্তির কাছে এ রাজ্যের অন্য রাজনৈতিক নেতারা এখনও অনেকটা পিছিয়ে৷ কী ভাজপা, কী কংগ্রেস, কী সিপিআইএম৷ এখনও তাঁর দলের সিংহভাগ লোকে তাঁকে অর্থাৎ শ্রীমতি মমতা দেবীকে দেখেই নিজের ভোটটা দেন৷ অনেকে অবশ্য ঠাট্টা বা উপহাস করে বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেসে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট৷’ কথাটা কিন্ত্ত মোটেও মিথ্যে নয়৷ ওই একটা ‘পোস্ট’ই কিন্ত্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পুরো দলটাকে৷

অন্যদিকে পেশাদারি ভোট বিশেষজ্ঞ সংস্থা আইপ্যাক-এর অবদানও কিছু কম নয়৷ ভোটকুশলী পিকে বা প্রশান্ত কুমার নানাভাবে চেষ্টা করেছেন দলটিকে জিতিয়ে আনার৷ ভোটারদের কথা মাথায় রেখে ভোট-কুশলী পিকে’র টিম আইপ্যাক যেসব যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দলের অন্য কারও পক্ষে নেওয়া কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য৷ আসলে সবকিছু মিলিয়েই তৃণমূল কংগ্রেসের এই অভাবনীয় জয়৷ ভাজপাকে এ রাজ্যে একডজন আসনে আটকে দেওয়ার যাবতীয় কৃতিত্ব তাঁর দলেরই৷