‘সাজানো বাগান’ শুকিয়ে গেল

সাজানো বাগানে বাঞ্ছারাম ও জমিদার বাবু। ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

এর আগেও একাধিকবার রটেছে তাঁর মৃত্যুর ভুয়ো খবর। তাই এবারও এই মৃত্যুর খবরটা যেন ভুয়োই হয়, মনে মনে এমনটাই প্রার্থনা করছিলেন মনোজ মিত্রের অভিনয়ের অনুরাগীরা। তবে না, এবার আর খবরটা ভুয়ো নয়। হ্যাঁ, কিংবদন্তী অভিনেতা, নাট্য ব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র আর নেই।

২০২৪ এর আকাশ আরও এক নক্ষত্র পতনের সাক্ষী রইল।মনোজ মিত্রের জন্ম ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের সাতক্ষিরা জেলার ধূলিহর গ্রামে। ১৯৫৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ স্নাতক হন তিনি। এই কলেজেই থিয়েটারে দীক্ষিত হন। সঙ্গী হিসেবে পান বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো ব্যক্তিত্বদের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ করেন। ডক্টরেটের জন্য গবেষণা শুরু করেছিলেন।১৯৫৭ সালে কলকাতায় মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু মনোজ মিত্রর। ১৯৭৯ সালে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিষয়েও শিক্ষকতা করেন। যদিও প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ লেখেন ১৯৫৯ সালে কিন্তু ১৯৭২-এ ‘চাক ভাঙা মধু’ নাটকের মাধ্যমে তিনি পরিচিতি তৈরি হন। ওই নাটকটির মঞ্চ নির্দেশনা করেন বিভাস চক্রবর্তী। নাট্যগোষ্ঠী ‘সুন্দরম’ প্রতিষ্ঠাতাও মনোজ মিত্র। থিয়েটারের মতোই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও খ্যাতি অর্জন করেন কিংবদন্তি শিল্পী।


সারা জীবনে বহু পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন এই শিল্পী। বলা বাহুল্য, মনোজ মিত্রের মৃত্যু একটি যুগের অবসান। তাঁর অনুপস্থিতি বাংলা নাটককে কি ক্ষতিগ্রস্ত করবে? হয়তো অভিনেতা মনোজ মিত্রের অনুপস্থিতি পূরণ করা যাবে না। পরিচালক মনোজ মিত্রেরও। কিন্তু নাট্যকার মনোজ মিত্র? তিনি তো কেবল ‘সুন্দরম’-এ আবদ্ধ থাকেননি! শহর, শহরতল, মফস্‌সল, গ্রাম— তাঁর নাটক ছড়িয়ে রয়েছে। শখের নাট্যদল, মাটি কামড়ে পড়ে থাকা রাগী গ্রুপ থিয়েটার, আপিস পাড়ার অ্যানুয়াল থিয়েটার, কলেজ সোশ্যালের একাঙ্ক প্রতিযোগিতা…। তালিকা বানাতে বসলে থৈ পাওয়া মুশকিল!

‘কেনারাম বেচারাম’ বা ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’ বা ‘দেবী সর্পমস্তা’। ক্রমশ বাড়তেই থাকবে নাটকের মিছিল। অগণিত কুশীলব, অসংখ্য চেনামুখ, অবিরল অচেনা হয়ে যাওয়া সত্তার সেই মিছিলে কে নেই! শিকড়ের সন্ধান করা লোকনাট্যের স্বপ্নসন্ধানী কিনু কাহার থেকে শুধুমাত্র বাঁচতে চাওয়া (অথবা না চাওয়া) বাঞ্ছারামের পাশে অনায়াসে দাঁড়িয়ে পড়ে বাস্তবের অফিসবাবু, টিউশনি সম্বল করে মুড়ি-তেলেভাজা খেয়ে রিহার্সাল করে যাওয়া মফস্‌সলবাসী মেয়েটি, অ্যাকাডেমি চত্বরে হাউস ফুল বোর্ড দেখে তৃপ্ত নব্য পরিচালক। এরা সকলেই আজ ‘স্টান্ডিং ওভেশন’-এ। ‘কার্টেন কল’-এ সুবিশাল জীবনমঞ্চে এসে দাঁড়াচ্ছেন একা একজন মানুষ, যিনি স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের, বাস্তবের সঙ্গে অপ্রাকৃতের, উপকথার সঙ্গে দিনাতিপাতের লড়াইকে এক করতে পেরেছিলেন।

১৯৭৭ সালে মনোজ লিখলেন ‘সাজানো বাগান’। প্রধান ভূমিকায় তিনি নিজে। বাংলা নাটকের দর্শক উপহার পেলেন এমন এক নাটক, যার ‘ধরন’-এর সঙ্গে তেমন পরিচয় তাঁদের ছিল না বললেই চলে। বাংলা সমান্তরাল ধারার নাটকের সূত্রপাত যদি গণনাট্য সঙ্ঘের হাতে হয় বলে ধরা যায়, তবে সেই ধারা থেকে ‘সাজানো বাগান’ ছিল অনেকখানি দূরে। তাঁর নিজের মতে, পঞ্চাশের দশকে গণনাট্য যে নাট্যধারা প্রবর্তন করে, সত্তরের দশকের শেষ দিকেও গ্রুপ থিয়েটার তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়ে পৌঁছনো সিদ্ধান্তকে যেন দর্শকের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বক্তব্য ভারাক্রান্ততা থেকে নাটকের মুক্তি চেয়েছিল ‘সাজানো বাগান’। সেখানে মানুষের সুখ-দুঃখ ছিল, আশা-আকাঙ্ক্ষার দোলাচল ছিল, প্রাকৃত আর অপ্রাকৃতের সহজ সহাবস্থান ছিল। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বকঠিন প্রয়োগ ছিল না। তথাকথিত সামাজিক দায়বোধ বাংলা নাটককে ক্রমশ ক্লান্ত এবং বৈচিত্রহীন করে তুলছে, সে কথা তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু তাঁর নাটক ‘বক্তব্যহীন’ হয়ে যায়নি।

শ্রেণি নয়, ব্যক্তিমানুষই তাঁর নাটকের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ‘চাক ভাঙা মধু’র জটা বা মাতলা, ‘সাজানো বাগান’-এর বাঞ্ছা, সকলেই একক। সামাজিক বিন্দু থেকে দেখলে তারা প্রান্তজন। কিন্তু প্রান্ত থেকেই যদি বিশ্বকে দেখা হয়, তা হলে তার চেহারাটাই বদলে যায়। ‘সাজানো বাগান’-এ বাঞ্ছার নাতিকে দেখানো উত্তরাধিকারের মধ্যে বিপুল আশাবাদ কি ‘নরক গুলজার’-এও নেই? হঠাৎ কেউ এই সব নাটকের সঙ্গে মিল পেতে পারেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের তামাম ছোটগল্প আর উপন্যাসে ছড়িয়ে থাকা দর্শনের। একজন কথাসাহিত্যিক আর একজন নাট্যকার। সমসাময়িক। কিন্তু দু’জনের কেউই ‘আধুনিক’ শিল্পদর্শনের নাগরিক ক্লান্তি বা শ্রেণিচেতনার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন না। শীর্ষেন্দুর ফজল আলি বা বাঘু মান্না যেন চকিতে দেখা দিয়ে যায় ‘চাক ভাঙা মধু’ বা ‘সাজানো বাগান’-এ। অথবা তার উল্টোটা। ‘বক্তব্য’ একটা কোথাও থাকে বটে, কিন্তু সে তার সর্বস্বতা নিয়ে গ্রাস করে না একা মানুষের লড়াইকে। বেদনার সঙ্গে ফুলঝুরির আলোবিন্দুর মতো ঝলকায় কৌতুক। যা শত-সহস্র মারি আর মড়কের পরে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখায়।১৯৫৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মঞ্চস্থ হয় ‘পথের পাঁচালী’।‌ ‘অপু’র চরিত্রে পার্থপ্রতিম চৌধুরী ‘অপু’র বন্ধু ‘প্রণব’-এর চরিত্রে মনোজ। তখন মূলত গল্প লিখতেন তিনি। পার্থপ্রতিমের তাড়নাতেই মনোজের লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’।

১৯৫৯ সালে ওই নাটক লেখেন মনোজ। পাঁচের দশকের শেষভাগে ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় প্রথমবার। তারপর থেকে একের পর এক কালজয়ী নাটক লিখেছেন মনোজ মিত্র। ১৯৭২ সালে তাঁর খ্যাতি আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে ‘চাক ভাঙা মধু’-র মাধ্যমে। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘শত্রু’-সহ একাধিক ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকের মন জয় করেছে। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে তাঁর অভিনয় জায়গা করে নিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। সময় যত এগিয়েছে, মঞ্চ থেকে পর্দা, দিনে দিনে অভিনেতা হিসেবে সকলের মন জয় করেছিলেন মনোজ। শুধু কি অনুরাগীদের মন জয় করেছিলেন? তাঁর ঝুলিতে দিনে দিনে এসেছে বহু পুরস্কার। অনেকেই জানেন না, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবির বছর সাতেক আগে রুপোলি পর্দায় প্রথম পা রাখেন মনোজ মিত্র এবং তাতে বড় ভূমিকা ছিল বন্ধু পার্থপ্রতিমের।

চিদানন্দ দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘বিলেত ফেরত’ ছবির বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল নিউ আলিপুর কলেজ, যেখানে তৎকালীন সময়ে মনোজ মিত্র অধ্যাপনা করতেন। ছবির সহ-পরিচালক ছিলেন পার্থপ্রতিম। একদিন ওই কলেজে শুটিং শুরু হওয়ার আগে দেখা যায় এক চরিত্রাভিনেতা অনুপস্থিত। তখন বন্ধুর অনুরোধে সেই অভিনেতার জায়গায় ভরাট করেছিলেন মনোজবাবু। সেই হল তাঁর পর্দায় পথ চলা শুরু। এরপর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘শত্রু’-সহ একাধিক ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকের মন জয় করেছে। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে তাঁর অভিনয় জায়গা করে নিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। মনোজবাবুর লেখা ‘দর্পণে শরৎশশী’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। মৃত্যুর মাসখানেক আগে জানিয়েছিলেন, ‘সাজানো বাগান’ নিয়ে একটা বড় কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তা আর হল না। কোনও দিকশূন্যপুর অজানা, পরিপাটি সাজানো বাগানের দিকে পা বাড়ালেন মনোজ মিত্র।এই বেঁচে থাকার গল্প ক্রমেই প্রসারিত হয় ‘দম্পতি’ বা ‘আমি মদন বলছি’-র মতো নাটকে।

কমেডির উল্লাস যেন সংযত, ফল্গুস্রোতে বয়ে যায় জীবনের বেদনার স্রোত। কিন্তু তার পরেও থাকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। সংলাপ থেকে সংলাপে কাহিনি এগোয়। যদি তাঁর নাট্য প্রযোজনা কেউ না দেখেও থাকেন, তবে ক্ষতি নেই, তাঁর নাটকের অন্যতম গুণই হল সেগুলির পাঠযোগ্যতা। অনায়াসে একের পর এক নাটক পাঠ করে যাওয়া যায়। লিখনের প্রসাদগুণে সেই সব নাটক আখ্যানের চেহারা নেয়। সাহিত্যের বিন্দু থেকে দেখলেও মনোজ মিত্র এমন এক সিদ্ধিতে স্থিত, যেখানে উপন্যাস আর নাটক— এই দুই ‘ফর্ম’-এর ফারাক কোথাও যেন ধুয়েমুছে যায়।তাঁর দীর্ঘ আয়ু জুড়ে অক্লান্ত ভাবে চালিয়ে গিয়েছেন কলমচারণা, নাট্য পরিচালনা, মঞ্চাভিনয় আর পর্দার জীবন। মঞ্চাভিনয় থেকে পরিণত বয়সে সিনেমার পর্দায় উঠে আসা খুব সহজ কাজ ছিল বলা যায় না। কিন্তু ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ সাড়া ফেলে দিলেন মনোজ। পর্দা এবং মঞ্চ— দুইয়েরই নিয়মিত অভিনেতা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের পাশাপাশি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায় বা অঞ্জন চৌধুরীর মতো মূলধারার পরিচালকদের ছবিতেও তাঁর অনায়াস উপস্থিতি। অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ১৯৮৪-র ছবি ‘শত্রু’র খলনায়ক নিশিকান্ত সাহা বাংলা চলচ্চিত্রে সিরিও-কমিক ভিলেনের উদাহরণ হয়ে রইল। গ্রুপ থিয়েটার আর তথাকথিত শিল্পসম্মত ছবির বাইরে এ ভাবে বেরিয়ে আসতে পারেন খুব কম অভিনেতাই। উৎপল দত্তের পরে এ প্রসঙ্গে যে নামটি উচ্চারিত হতে পারে, সেটি অনিবার্য ভাবেই মনোজ মিত্র। খলনায়কের ‘টাইপ কাস্টিং’ ভেঙে বেরিয়ে এসে তপন সিংহের ‘হুইলচেয়ার’-এর শতদল চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শককে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছিল।তাঁকে বাংলার নাটকের ইতিহাসে একটি পর্ব উৎসর্গ না করে উপায় থাকবে না ইতিহাসবিদদের।