‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ স্পর্শ করে শপথ নেবার দিন

গুরু নানক। ফাইল চিত্র।

সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

শিখ পন্থ বা শিখ পথের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্ম পাঞ্জাবের তালবন্দি নামে ছোট এক গ্রামে হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত অক্টোবর কার্তিক পূর্ণিমায়। আবার অন্য মতে তার জন্ম ১৪ এপ্রিল বৈশাখ মাসে। জন্মের পর তার নাম ছিল নানক নিরঙ্কারি। অর্থাৎ বিশ্ব মানবের সেবক নানক, মায়ের নাম ছিল তৃপ্তী, ধর্মপ্রাণা ও কর্তব্য পরায়ণা। পিতা কালু।
গুরু নানকের পর আরো নয়জন গুরুর উপস্থিতি জানা যায়। শেষ গুরু ছিলেন গোবিন্দ সিংহ।
বাল্য জীবন থেকে ৩০/‌৩২ বছরে নানক হয়েছেন সংসারী, দুই পুত্রের জনক নবাবের দরবারে করেছেন কাজ। কিন্তু সাধু সঙ্গ, সাধু সেবা, ভগবানের নাম গান, কীর্তন, দান, নিত্য ধর্মীয় কার্যও চালিয়েছেন।
তিনি প্রতিদিন ভোরে নদীতে স্নান করতেন, শোনা যায় ওই নদীর তীরে বা ধারে, তালান্দীর জঙ্গলে বহু পরিবাজক সন্ন্যাসী সাধনার স্থান করে নিয়ে ছিলেন। নানক অনেক সময়ই ওই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করতেন। কথিত একদিন নদীতে স্নান করেতে গিয়ে নদীর জলে ডুব দেবার পর তিনি আর উঠে আসেন নি, ওই সময় এক অলৌকিক অনুভুতি লাভ করেন ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য পান, ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধন্য হন, এবং জীব উদ্ধারের নির্দেশ পান। নানক যেন পবিত্র মন নিয়ে ঈশ্বরের জপ করেন। তিন দিন ঈশ্বর উপদেশ শ্রবণ করে তিনি জল থেকে উঠে এসে পাশের জঙ্গলে সাধু সঙ্গ গ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ বলেন, যে নদীতে নানক স্নান করতেন, তার পাশে একটা গুহা ছিল, তিনি স্নান করতে গিয়ে সেই গুহায় আশ্রয় নেন। মানুষের অগোচরে তিনি সেখানে তিন দিন সমাধিতে থাকেন। সেই সময়-তিনি এক দৈব অনুভূতি লাভ করেন এবং মন্ত্র বা নাম প্রাপ্তির পরে মন্ত্র পাঠ করতে করতে তিনি ঘরে ফিরে আসেন।
এরপর শুরু হয় নানকের পরিব্রাজক জীবন, জানা যায় ওই সময় ‘জপজী’ রচনার পরি কল্পনা তার মনে আসে, পরবর্তীকালে, জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে উদাসীর বেসে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র শহর মক্কা, পারস্য, বাগদাদ এছাড়াও সিংহল ভ্রমণের পর হিন্দু-পণ্ডিত ও মৌলভির কাছে ঈশ্বর তত্ত্বের নানান আলাপ আলোচনা করেন। এরপর রাজস্থানের জাঠ, অবিভক্ত সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাবের কিছু মানুষ যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান যাঁরা ভক্তিমার্গের আদর্শে বিশ্বাসী তাঁদের নিয়ে সুগঠিত এক সম্প্রদায় বা জাতি গঠন করেন, যাদের কাজ পরোপকার ও মানব সেবা। পরবর্তীকালে গুরু নানকের ধর্মমতই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শিখ ধর্ম’ নামে।
রাভি নদীর তীরে কর্তারপুরে তার সংসার শ্রম গড়ে ওঠে এবং পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষদের ধর্মপ্রদেশ দান, ‘জপজী’ ও তার অন্যান্য বাণী রচনার কাজ শেষ করেন। এই জপজীর প্রথা মতই শোভিত শিখ পন্থের মূলমন্ত্র।
পাঞ্জাবী ভাষার-শাখা গুরুমুখী ভাষা। সে সময় পাঞ্জাবে ল্যান্ডা মহাজনী ভাষায় লেখার প্রচলন ছিল। গুরু নানকের বাণীও লাণ্ডা ভাষায় লেখা। পরে নানকের শিষ্য দ্বিতীয় গুরু অঙ্গদদেব। পুরানো লাণ্ডা মহাজনী ভাষার বর্ণমালাকে সংস্কার করে সংস্কৃতের দেবনাগরী বর্ণমালার ধাঁচে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে বাণীগুলি লিপিবদ্ধ করেন। যেহেতু এই নতুন ভাষায় গুরুর মুখের বাণী লেখা হলো, সে জন্য এর নাম দেওয়া হল ‘গুরুমুখী’ ভাষা।
‘গুরুমুখী’ ভাষার শিখ শব্দটি সংস্কৃতের ‘শিষ্য’ শব্দ থেকে এসেছি। ‘শিষ্য’ শব্দ ‘গুরু’ শব্দের পরিপুরক।
এই ‘জপজীর’ প্রথমেই আছে শিখ ধর্মগ্রন্থের মূল বীজমন্ত্র—‘এ’ বা ‘ইক ওঁকার’।
নবম গুরু তেগবাহাদুর ধর্মান্তরিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু বরণকে শ্রেয় মনে করতেন, তাই তাকে প্রাণ ও দিতে হয় তার ছেলে গোবিন্দ সিংহের কোনও পুত্র জীবিত ছিল না, তাই গুরু পরম্পরায় ছেদ পড়ে, তাই ‘গুরু গ্রন্থ সাহিবকে’ গুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ লেখা শুরু হয় ১৬০৪ সালে আমৃতসরের হরমন্দির সাহিবে যেটি এখন স্বর্ণমন্দির। পঞ্চম গুরু অর্জন দেবের উপস্থিতিতে তারই সংঙকলিত গ্রন্থ ‘গ্রন্থ সাহিব’ শিখদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ প্রকাশের ৪০০ বছর পূর্তি উৎসব অমৃতসরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৬০৪ সালের পর দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ গুরু তেগবাহাদুরের ৫৬টি পদ এবং ৫৭টি শ্লোক ‘গ্রন্থ সাহিব’ এসংযুক্ত করেন। ১৭০৮ সালের ৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্রের নন্দড়ে গুরু গোবিন্দ সিংহ এই মহাগ্রন্থকে গুরুর মর্যাদায় মহিমান্বিত করেন, যা আজ সকলের কাছে পুজ্য ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ হিসেবে, এই গ্রন্থের মাহাত্ম্য আজ সমস্ত শিখ জাতিকে গৌরবান্বিত করে তুলেছে,
‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ ভারতের সমস্ত মানুষের একাত্মতার প্রতিক। সব বর্ণের সাধু-সন্তদের বাণী সংযোজিত গ্রন্থ। যেমন ভক্ত রবিদাস ছিলেন তথাকথিত চর্মকার, ভগবান নামদেব ছিলেন ধোপা, ভক্ত কবীর ছিলেন (জোলা) তাঁতি, সন্ত ফরিদ সুফি মুসলমান, ভক্ত সেইন নাপিত, ভক্ত জন্না জাঠ, ভক্ত জয়দেব ব্রাহ্মণ, নানক নিজে ক্ষত্রিয়, সকলের স্থান ‘গ্রন্থ সাহিব’-এ,। এতে ৩১টি ভাগ, ৫৮৯৪টি শ্লোক, ১৪৩০টি হুকী আছে। আজকের শিখগুরুর জন্ম দিনে, ওই গ্রন্থ স্পর্শ করে আসুন আজ আমরা শপথ গ্রহণ করি, আর কবি গুরুর কথায় বলি।
পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শীরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে, জাগিয়া উঠেছে শিখ
নির্মম নির্ভিক।
হাজার কণ্ঠে গুরুজীর জয় ধ্বনিয়া তুলেছে দিক,
নতুন জাগিয়া শিখ, নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিঘ।