বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য

বাঙ্গালী জাতি, বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বাঙ্গলা সাহিত্য সম্পর্কে দুই-চারিটি কথা নিবেদন করিতে চাহি। ‘বাঙ্গালী জাতি’ বলিলে, যে জন-সমষ্টি বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে বা ঘরোয়া ভাষা রূপে ব্যবহার করে, সেই জন-সমষ্টিকে বুঝি। বাঙ্গালা দেশে, বাঙ্গালা-ভাষী জন-সমষ্টির মধ্যে দেশের জলবায়ু ও তাহার আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ এই দেশের উপযোগী বিশেষ জীবন-যাত্রার পদ্ধতিকে অবলম্বন করিয়া, এবং মুখ্যতঃ প্রাচীন ও মধ্য যুগের ভারতের ভাব-ধারায় পুষ্ট হইয়া, গত সহস্র বৎসর ধরিয়া যে বাস্তব, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি, গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা-ই ‘বাঙ্গালী সংস্কৃতি’; এবং এই সংস্কৃতি, বাঙ্গালা ভাষার সৃষ্টি-কাল হইতে বাঙ্গালা ভাষায় রচিত য়ে-সকল কাব্যে কবিতায় ও অন্য সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, তাহা-ই ‘বাঙ্গালা সাহিত্য’।

এখন পাঁচ কোটির অধিক লোকে বাঙ্গালা ভাষা বলে। সংখ্যা হিসাবে বাঙ্গালী জাতি নগণ্য নহে। গ্রেট-ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি— ইহাদের প্রত্যেকের অধিবাসিগণের চেয়ে বাঙ্গালী অর্থাৎ বাঙ্গালা-ভাষী জনগণের সংখ্যা অধিক। আমি এই বিষয়ে আমার দেশবাসিগণের ও অন্য লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি যে, ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক ব্যক্তি মাতৃভাষা হিসাবে বাঙ্গালা বলে। অবশ্য, কেবল অন্যতম সংখ্যা-গরিষ্ঠ ভাষা হওয়ায় বাঙ্গালার বা আর কোনও ভাষার পক্ষে বিশেষ গৌরবের কিছু নাই; কিন্তু সংখ্যাধিক্য উপেক্ষণীয় বস্তু নহে; এবং সংখ্যাধিক্য ভিন্ন বাঙ্গালার সাহিত্য-গৌরবও অন্য পাঁচটি ভাষার মধ্যে বাঙ্গালার একটি প্রতিষ্ঠা আনিয়াছে।


এই-যে কয়েক কোটি বাঙ্গালা-ভাষী যাহারা সারা বাঙ্গালা দেশ জুড়িয়া এবং বাঙ্গালার প্রত্যন্ত দেশ জুড়িয়া বাস করিতেছে এবং কিছু কিছু বাঙ্গালার বাহিরে অ-বাঙ্গালীদের দেশে গিয়াও যাহারা বাস করিতেছে, তাহারা সকলেই পরস্পরের মধ্যে একটা ভাষা-গত স্বাজাত্য অনুভব করে। বিদেশে অন্য ভাষা-ভাষীদের মধ্যে গেলে, এই স্বাজাত্য-বোধটুকু আমাদের কাছে বিশেষ পরিস্ফুট হয়। আজ-কাল জাতীয়তা বা স্বাজাত্যের প্রধান আধার হইতেছে ভাষা। যেখানে বিভিন্ন ভাষা, সেখানে ধর্ম, মানসিক সংস্কৃতি, অতীত ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্থান এক হইলেও, সম্পূর্ণ ঐক্য হওয়া কঠিন,—সম্পূর্ণাহ্গ স্বাজাত্য-বোধ আসা এক-রকম অসম্ভব।

বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে এমন একাধিক জন-সমষ্টিকে, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য কারণে একরাজ্য-পাশে বদ্ধ করা যায়; কিন্তু দেখা যায়, ভাষা-গত বৈষম্য থাকিলে, ওতপ্রোত-ভাবে মিল হয় না। রাষ্ট্রীয় বন্ধনে সঙ্ঘ-বদ্ধ বিবিধ ভাষা-বাষী একাধিক জন-সমষ্টির মধ্যে একটি বিশেষ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা-স্বরূপ গ্রহণ করিলে, একতার সূত্র একটা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু প্রান্তিক সত্তা বর্জন করিয়া সকলে মিলিত হইতে চাহে না বা পারে না। সম্পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় ঐক্য স্থাপন করিতে হইলে, দেশে মাত্র একটি ভাষাকে রাখিতে হয়,—অন্যগুলিকে হয় একেবারে ধ্বংস করিয়া ফেলিতে হয়, নতুবা নির্জীব ও ক্ষয়িষ্ণু করিয়া রাখিতে হয়।

এইরূপ করিয়াই তবে গ্রেট ব্রিটেন রাষ্ট্রীয় ঐক্য ঘটিয়াছে—স্কট্ল্যান্ডের গেলিক ও ওয়েলস্-এর ওয়েল্শ্-ভাষাকে বিলোপের পথে আগাইয়া দিয়া ইংরেজির প্রতিষ্ঠা ও সঙ্গে-সঙ্গে ইংরেজি ভাষাকে আশ্রয় করিয়া ব্রিটিশ একতা। ফ্রান্সেও এইরূপে দক্ষিণ-ফ্রান্সের প্রভাঁসাল ভাষাকে নির্জীব ও উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ব্রেতঁ ভাষাকে ক্ষয়িষ্ণু ও মৃতকল্প করিয়া, ফরাসি ভাষার অবিসংবাদিত ও অপ্রতিহত প্রতিষ্ঠার আসনেই ফ্রান্সের রাষ্ট্র-গত একতা স্থাপিত হইয়াছে। বহুভাষাময় রুষ সাম্রাজ্যেও এই প্রকারে প্রান্তিক ভাষাগুলিকে পিষ্ট ও বিনষ্ট করিয়া দিয়া রাষ্ট্রীয় ঐক্য সাধনের চেষ্টা হইয়াছিল, কিন্তু রুষ সাম্রাজ্যে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়,—এক সময়ে রাজভাষা রুষের চাপে পোলীয় ভাষা, লিথুআনীয়, লেট্, এস্তোনীয়, ফিন্, আর্মানি প্রভৃতি ভাষার প্রাণসংশয় হইয়াছিল; কিন্তু রুষ সাম্রাজ্যের পতন ও উক্ত সাম্রাজ্যের খন্ড খন্ড হইয়া যাওয়ার সঙ্গে-সহ্গে, এই সকল ভাষা যাহারা বলে তাহারা মাথা-ঝাড়া দিয়া দাঁড়াইতে পারিয়াছে, নিজ-নিজ ভাষাকে অবলম্বন করিয়া ইহারা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করিয়া লইয়াছে।
(ক্রমশ)