ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ -গনতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ন স্তম্ভ। ভারতীয় সংবিধান বিচার বিভাগকে আইনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সোপর্দ করেছে।
আর জি কর কাণ্ডে রাজ্যের অধিকাংশের-হয়ত দেশেরও অনেকের সাগ্রহ নজর ছিল ১৭ তারিখে শীর্ষ আদালতে শুনানির দিকে। মঙ্গলবারে শুনানিকালে অবশ্য রাজ্যের প্রতি কড়া মনোভাব গ্রহণ করে প্রধানবিচারপতির বেঞ্চ প্রথমেই শুনানি সরাসরি সম্প্রচারে রাজ্যের আপত্তি খারিজ করে দেয়। সিবিআই এর তদন্তের গতি প্রকৃতি সম্বলিত ষ্টেটাস রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন ‘খুবই খারাপ ও বিচলিত করার মত’ এবং সেজন্য সিবি আই কে তদন্ত সম্পূ্র্ণ করতে আরও সময় দেওয়া উচিত।তিনি মৃতা নির্যাতিতার বাবার উদ্বেগের সাথে সহমর্মী হয়ে তাঁর চিঠিতে উল্লেখিত সূত্রগুলিও সিবি আই কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে নির্দেশ দেন। মৃতদেহের চালান ও ঘটনাস্থলের সিসি টিভির সম্পূর্ণ ফুটেজ হস্তান্তর প্রসঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে তদন্তে সি বি আই কে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করবে রাজ্য পুলিশ।রাজ্যসরকারের চালু করা ‘রাত্রিসাথী’ অ্যাপের বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করতে নির্দেশ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন কোন মহিলাকে বলা যায় না রাতে কাজ করবেন না কারণ রাজ্য সরকার ঠিক করতে পারেন না মহিলারা রাতে কাজ করবেন কিনা। ধর্মঘটী জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে ফেরা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের পূর্ববর্তী আদেশ বলবৎ রাখলেও শীর্ষ আদালতের নির্দেশ রাজ্য সরকারকেই হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা সিভিক ভলান্টিয়ারের মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মী দিয়ে নয়।মহিলা চিকিৎসকেরা রাতে কিভাবে নিরাপদে কাজ করবেন এই মন্তব্য করে আদালতের পর্যবেক্ষন- আর জি কর হাসপাতালে পরিকাঠামো ও নিরাপত্তা উন্নত করার কাজও খুব ধীর গতিতে হচ্ছে।
শীর্ষ আদালতের এই রায় ধর্মঘটী জুনিয়র চিকিৎসক মৃতা নির্যাতিতার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার করলেও বোঝা যাচ্ছে না শীর্ষ আদালতের এমত পর্যবেক্ষনের পরও প্রশাসনের হুঁশ ফিরবে কিনা-সদিচ্ছা জাগবে কিনা।ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত দু’বার বৈঠকের পর তাঁদের অনেক দাবি রাজ্য প্রশাসন মেনে নিয়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেক্ষিতে ধর্মঘটী জুনিয়র চিকিৎসকরা আপাতত কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যদিও আন্দোলন প্রত্যাহৃত হচ্ছে না। এদিকে সি বি আই ইতিমধ্যে সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার প্রাক্তন ওসিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নিয়েছে অন্যদিকে প্রশাসন প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে কোলকাতার পুলিশ প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগে কিছু রদবদল(অনেকের মতে এই সুযোগে কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের পছন্দমত পোস্টিং বা প্রমোশন দিয়ে) করে এক বার্তা দেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে-এতেই যে ব্যাপক দু্র্নীতির হিমশৈলের চুড়াটিই আপাতত দেখা যাচ্ছে তাকে কি সমূলে বিনাশ করা সম্ভব হবে?
‘তিলোত্তমা’র নৃশংস হত্যারহস্য কি সমাধান হবে সংশ্লিষ্ট সকল অপরাধীদের কি যথাযথ শাস্তি হবে এই প্রশ্নগুলিই সবাইকে ভাবাচ্ছে রাজ্য প্রশাসন ও শাসকদলের অদ্ভুত আচরণে।চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণে রাজ্য প্রশাসনের গা-ছাড়া মনোভাবও শীর্ষ আদালতের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে মেডিকেল কলেজ গুলিতে গজিয়ে ওঠা দুষ্টচক্রের যারা ‘থ্রেট কালচার’ এর মাধ্যমে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিজেদের তাবে এনে হাসপাতালে হাসপাতালে মায় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দুর্নীতির মুক্তাঞ্চল তৈরি করার কাজে বহুদিন ধরে ব্যাপৃত। অন্যদিকে আর জি করের ঘটনার অভিঘাতে সমাজে ব্যাপক আলোড়ন উঠলেও শাসকদলের কিছু মন্ত্রী সান্ত্রীরা প্রকাশ্য সভাসমিতিতে ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নামা প্রতিবাদীদের ‘আঙ্গুল ভেঙ্গে দেব’-‘হাতমুচড়ে ভেঙ্গে দেব’ জাতীয় হুংকার দিয়ছেন।দলীয়এক বর্ষীয়ান অধ্যাপক সাংসদ সহ একাধিক বিধায়ক মন্ত্রীরা যে কুরুচিকর ভাষায় ধর্মঘটী জুনিয়র চিকিৎসকদের এবং আর জি কর কাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের লাগাতার আক্রমন করে যাচ্ছেন তাতে আশংকা জাগে এও কি গণতন্ত্র? এরকম একটি নির্মম ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরও এরা দুঃখিত লজ্জিত না হয়ে ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবিদার প্রতিবাদীদের আক্রমন করে যাচ্ছেন লজ্জাহীনভাবে।মনে রাখতে হবে প্রশাসনের সার্বিক ব্যর্থতা ও অন্যায় ঢাকতে মঞ্চে ‘ফাঁসি চাই’ ‘ফাঁসি চাই’ উচ্চকিত শ্লোগান তুলে বা হাতে গরম পদ্ধতি বাতলে অপরাধীকে এনকাউন্টারে খতমের হঠকারি নিদান দিলে ঘটনার অভিঘাতে উত্তাল গণপ্রতিবাদের প্রেক্ষিতে আবেগাপ্লুত সাধারণ মানুষকে সস্তা চমক দিয়ে হাততালি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু সমস্যা নিরসনে এ কোন সদর্থক প্রয়াস হতে পারে না। এনকাউন্টার তত্ত্ব দলীয় লক্ষ্যে সৃষ্ট প্রশাসনিক পঙ্গুতা ও অকর্মন্যতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানো্র এক কৌশল হতে পারে কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখে এভাবে শাস্তি্প্রদানের দাবি বোধকরি মানানসই নয়। বিচারব্যবস্থাকে এড়িয়ে ধৃতকে এভাবে নিকেশ করার মানসিকতা ও প্রবণতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদৌ সমর্থনযোগ্যও নয়। বরং ঐভাবে মৃত্যু ঘটিয়ে তথ্য প্রমাণ লোপাট করে আসল অপরাধীকে আড়াল করার এক সুযোগ চক্রান্তকারীর হাতে এসে যায়।
একথা সত্য যে সমাজে যে অনুপাতে অপরাধ ও হিংসার ঘটনা ক্রমবর্ধমান সেইঅনুপাতে আদালতের বিচারে দোষীসাব্যাস্ত হয়না- সেকারণে শাস্তিও হয়না অপরাধীর। কিন্তু সেজন্য বিচারব্যবস্থাকেই একমাত্র দায়ী করে নিজেদের সামাজিকদায় এড়িয়ে যাওয়া ভাবের ঘরে চুরি করা ব্যতীত আর কিছু নয়। বিচারে বিলম্ব এবং দীর্ঘবিচার প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে ধৈর্যের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ালেও তা অভিযুক্তের দোষী সাব্যাস্ত না হওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারেনা। কারণ বিচারে অপরাধীর দোষী সাব্যাস্ত না হওয়ার অন্যতর কারণগুলিও(যথাযথ তদন্ত না হওয়া ,সাক্ষ্যপ্রদানে অনীহা ইত্যাদি) অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে টি আর পি বাড়ানোর লক্ষ্যে একশ্রেণীর সংবাদমাধ্যমের অত্যুৎসাহে বিচারকের ভূমিকাগ্রহণ এবং তদন্তমূলক সাংবাদিকতা ও মিডিয়া ট্রায়ালের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি সচেতন বিস্মরন বা উলঙ্ঘনের অতিপরিচিত প্রবনতায় সাময়িক উত্তেজনার আগুন পোহানো যায় মাত্র । অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে সঠিক তদন্ত করে যথা সময়ে চার্জশিট দাখিলি মামলায়ও ঘটনার পরপরই যে বা যারা অপরাধীর চরম শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হন থানা ঘেরাও করেন তারাই আদালতে বিচার চলাকালে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন না,অনেকে এমনকি নির্যাতিতা বা মৃতার ঘনিষ্ঠরাও আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেও সত্য গোপন করেন সাক্ষ্যে— হয়ত তাৎক্ষণিক উত্তেজনা অবসানে কিংবা ইতিমধ্যে কোন ‘বোঝাপড়া’ বা অন্য কোন হেতুতে। সাম্প্রতিকতম উদাহরন বগটু্ই গণহত্যা কাণ্ড মামলায় সাক্ষ্যপ্রদানকালে নিহতদের পরিবারের সদস্যদেরই সাক্ষীহিসেবে আচরণ। অনেকসময় ফরেন্সিক রিপোর্ট বা অন্য বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট আসতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয় বা রিপোর্টের অভিমত অভিযোগ প্রমাণে সহায়ক হয়না। বিচারকার্য সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে আদালতকে পুলিশ সহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয় যাদের যথাযথ সক্রিয়তা, সময়ানুবর্তিতার এবং পরিকাঠামোগত দক্ষতা এবং গুরুদায়িত্বে ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচারে বিঘ্ন ঘটে।
আর জি করের নারকীয় ও বীভৎস ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতেও অতিতৎপর রাজ্য প্রশাসন।
‘নবান্ন চলো’ অভিযানের রাতে এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলের অফিস থেকে বেরোনোর পরই ছাত্রসমাজের পক্ষে ‘নবান্ন চলো’ ডাকের অন্যতম আহ্বায়ক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হলো। হাইকোর্টের আদেশে তাঁর মুক্তির পর জনগনের করের টাকা ব্যয় করে নামী দামী আইনজীবী নিয়োগ করে রাজ্যপ্রশাসন তার জামিন খারিজ করতে গেলেও রাজ্যের মুখ আবার পোড়ে।আবার পুলিশ নয়, শাসক দলের নেতার পেশ করা একটি অডিও ক্লিপে কথোপকথনের ভিত্তিতে চিকিৎসকদের ধর্নায় হামলা চালানোর ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো লালবাজারে রাতভর অবস্থান শেষে বাড়িফেরার পথে এক রাজনৈতিক দলের যুব নেতাকে। যদিও হাইকোর্টের আদেশে ইতিমধ্যে তাঁর জামিনে মুক্তি মিলেছে-প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচও। যথারীতি আবারও আদালতের প্রশ্ন ও সমালোচনার সম্মুখীন রাজ্য পুলিশ প্রশাসন। এই মামলায় জামিন মঞ্জুরকালে মাননীয় বিচারপতির পর্যবেক্ষন- পুলিসের এধরনের আচরণে্র ফলে এক ব্যক্তিমানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হয়েছে। প্রসঙ্গত ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় স্পষ্ট বিধান আছে কিভাবে এরকম অডিও/ভিডিওয় তথ্য সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে গ্রাহ্য হতে পারে। অডিও’র গলার কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করতে গ্রেফতার করা জরুরি কিনা সে প্রশ্নও উঠছে।
সন্দেশখালির ঘটনায়ও শাসক দলের পেশ করা ভিডিও জাল কিনা পরীক্ষার আগেই পুলিশ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ছিল অতি সক্রিয়।বস্তুত দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন এমন রাজধর্মে এখন সাধারন নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে অনীহ রাজ্যের আরক্ষাবাহিনী রাজনৈতিক প্রভুদের তুষ্ট রাখতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদীদের লাঠিপেটা আর শাসকদলের স্থানীয় মাতব্বরের হামলায় ফাইলের আড়ালে আশ্রয় নিতে এমনকী যুথবদ্ধ রাজনৈতিক গুণ্ডাদের হাসপাতাল আক্রমন ও ভাঙচুরের সময়ও নির্বিকার দর্শকের ভূমিকা কিংবা ভয়ে আত্মগোপন করতে, কর্তব্যরত নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্বপালনের পরিবর্তে তাঁদের কাছেই আশ্রয় প্রার্থনার মতো লজ্জাহীন আচরণে অভ্যস্ত হওয়াই তো স্বাভাবিক। অন্যদিকে চলছে প্রতিবাদ দমন করতে প্রতিহিংসাপরায়নতা।
এ পরিস্থিতিতে মানুষের অন্তিম আশা-ভরসা বিচারব্যবস্থা সক্রিয় ও নির্ভীক নাহলে এ রাজ্যের পক্ষে বড় দুর্দিন ও হতাশার। এ প্রেক্ষিতে অনেকের মনেই ,সংশ্লিষ্ট মামলার অভিযোগ পরস্পরসম্পর্কিত নয় একথা মাথায় রেখেও, যে ধন্দ ও সংশয় জাগে তা হল আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নবান্ন চলো’ ডাক দিয়ে গ্রেফতার হওয়া দুই ছাত্রনেতাদের একেবারে ১৪দিনের এবং শাসক দলের এক নেতার উপস্থিত করা এক অডিও ক্লিপে কথোপকথনের (অপরীক্ষিত) ভিত্তিতে ‘ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগে আটক ঐ যুবনেতার সাত দিনের পুলিশ হেফাজত;অথচ পড়ুয়া চিকিৎসকের হাসপাতালের মধ্যেই খুন ও ধর্ষণের মত গুরুতর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আসামী হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ কিংবা টালা থানার প্রাক্তন ওসি’র প্রাথমিকভাবে মাত্র দু’দিন সিবি আই হেফাজত! উল্লেখ্য প্রথম দু’টি ক্ষেত্রে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে। কিন্তু শাসক দলের আজ্ঞানুসা্রে কোন প্রতিবাদী বা রাজনৈতিক কর্মীকে বেগ দিতে পুলিশ যেভাবেই অভিযোগপত্র প্রস্তুত করুক না কেন মামলার প্রাথমিক পর্বেও সে অভিযোগের সম্ভাব্যতা ও যথার্থতা ন্যায়বিচারবুদ্ধির (জুডিশিয়াল মাইণ্ড) প্রয়োগের দ্বারা আদালতের বিবেচনা-পর্যালোচনা করার এক দায়িত্বও বোধকরি থেকে যায়।
প্রসঙ্গত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের এক মৌলিক এবং অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। ভারতেরবিচারব্যবস্থা নিঃসন্দেহে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, ও যথেষ্ট শক্তিশালী –যা ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । এরগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইদানীং প্রায়শ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে,সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলীর এবং বিভিন্ন উচ্চন্যায়ালয় ও দেশের শীর্ষ ন্যায়ালয়ের বিভিন্ন রায়ের প্রেক্ষিতেও।
তবে দেশের সব শাসককুলের পক্ষেই অস্বস্তিকর ঠেকে শক্তিশালী বা স্বনির্ভর স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা।সেহেতু বিচারবিভাগকে শাসনবিভাগের প্রভাবে রাখার এক সুপ্ত বাসনায় অনেক কৌশল হয়ে থাকে মাঝে মধ্যেই। এর চরম ও ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটেছিল প্রায় অর্ধশতক আগের সেই তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ে যখন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে স্বৈরতন্ত্রের স্তাবকেরা দাবি করেছিল বশংবদ বিচার ব্যবস্থা বা কমিটেড জুডিশিয়ারীর।
লক্ষ্যণীয়, অন্যায়ের শিকার অনেক সাধারণ মানুষ প্রশাসনিক আঙিনায় প্রতিকারলাভে ব্যর্থ হলে এখনও নির্ভর করে আদালতের উপর।প্রশাসনিক বা রাষ্ট্রীয় অবিচারের প্রতিকারেরও শেষ আশা ও অবলম্বন হল আদালত।অভিজ্ঞতা বলে, অন্যায় বা অপরাধের বিরুদ্ধে নিরুপায় পুঞ্জীবিত সামাজিক ক্ষোভ অনেক ক্ষেত্রেই সান্ত্বনা পায় কোন বিশেষ ঘটনার অপরাধীর আদালতের রায়ে যথার্থ শাস্তিবিধানে এবং তার বাহ্যিক প্রকাশও ঘটে, জনমানসের আস্থা পুনর্স্থাপিত হয় বিচারব্যবস্থায়।দেশের জনপরিসরে সাধারণ অভিমত এইযে যথার্থ বিচার দিতে ব্যর্থতা বা বিলম্বিত বিচারের কারণেই জনসাধারণের আইন নিজের হাতে নেবার প্রবণতা গড়ে ওঠে। প্রসঙ্গটি আবার আলোচনায় এসেছে সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে।
প্রসঙ্গত কোন গুরুতর অপরাধে ফাঁসির সংস্থান সম্বলিত নতুন আইন পাশ করার চেয়ে অধিক জরুরী ন্যায় বিচারের স্বার্থে তদন্তকারী সংস্থার দক্ষতা ও সততার পাশাপাশি প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তাও।রাজনীতি প্রভাবিত প্রশাসনিক পক্ষপাতদুষ্টতায় এবং বিচার পদ্ধতির দীর্ঘসুত্রিতায় হতাশ দূর্গতদের(উদাহরন-ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি) অনেক বিভ্রান্ত মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে আইনের চোখে সকলেই সমান- এ কি নিছকই তত্ত্ব? এ যে নিছক তত্ত্ব নয়তা প্রমাণের দায়িত্ব প্রধানত বিচারব্যবস্থার-তবে সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও।
ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ১২ই জুন ১৯৭৫ দিনটি ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার পক্ষে অতীব গরিমার দিন হিসেবে সুচিহ্নিত-হয়ত দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ । কারণ এলাহবাদ উচ্চন্যায়ালয়ের এক মামলায় (উত্তরপ্রদেশ সরকার বনাম রাজনারায়ন)এক সাহসী ও নির্ভীক বিচারপতির সেদিনের রায়ে (এ আই আর ১৯৭৫পাতা ৮৬৫) দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতার আসন প্রকম্পিত হওয়ায় পরবর্তী গভীর অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনাহয়েছিল। আলোড়ন সৃষ্টিকারি সাহসী ও নিরপেক্ষ এবং উচ্চপ্রশংসিত তাঁর সেই রায় ভারতের বিচার ব্যবস্থার,হয়ত ভারতীয় গণতন্ত্রেরও, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সমুন্নত করেছিল।সেই মামলায় আদালতের কার্যপরিচালনায়ও তাঁর দৃঢ়তা ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগের প্রতি দায়বদ্ধতার সমুজ্জ্বল উদাহরন। কেবল বিচারব্যবস্থাই পারে এমন সদর্থক বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণে; এই নিবন্ধকারের মত আরো অনেকেরও কর্মজীবনে বিচারকের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হয়ত সতত প্রণোদনা লাভ সাতের দশকের সেই বিচারবিভাগীয় নিরপেক্ষতা, দার্ঢ্য,শুভ্র সম্ভ্রমবোধও নৈর্ব্যক্তিকতার আদর্শ উদাহরন স্মরণে।
নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে সুষ্ঠবিচারকার্যে প্রয়োজন মেধা তো বটেই, কিন্তু সর্বোপরি নিরপেক্ষতার সাথে সেই কিংবদন্তীসম ‘কারেজ’। তবেই বহুশ্রুত প্রবাদ Justice is blind অর্থাৎ ন্যায়বিচার পক্ষপাতশূন্য ও নৈর্বক্তিক-বন্ধু-শত্রু, ধনী-নির্ধন নিরপেক্ষ বাস্তবে রূপ নেবে।
গণতন্ত্রের বনিয়াদ মজবুত করতে— আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং সেকারণে বিচার ব্যবস্থাকে গতিশীল, স্বচ্ছ এবং সুদৃঢ় করতে ও সুমহান ঐতিহ্য বজায় রাখতে প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব বিচারবিভাগের নিজেরই-এ ব্যবস্থার উপর সাধারণের আস্থা সুরক্ষিত রাখারও।