সঙ্কট কাটল

মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পর আন্দোলনের অবসান ঘটাল ডাক্তাররা। (Photo: IANS)

চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান হল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বটে, জুনিয়র ডাক্তারদের সব দাবি মেনে নিয়ে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির আশ্বাস দেওয়ায়, এনআরএস সহ অন্যান্য হাসপাতালের ডাক্তাররা কাজে যােগদান করতে স্বীকৃত হলেন।

মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, আলােচনা সফল। ডাক্তারদের দাবি ন্যায্য। গত ছয়দিন রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এনআরএসের চিকিৎসকদের আন্দোলনের সমসাথী হয়ে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে হাজার হাজার রােগী বিপন্ন হয়ে পড়েন। তারা চিকিৎসা করাতে এসে ফিরে যান, শিশুসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়, যা মানবতাবিরােধী ও চিকিৎসকদের পেশার পরিপন্থী।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেমন নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে তাদের পাশে দাড়িয়েছেন, তেমনি কর্মবিরতির ফলে অসংখ্য রােগীর চিকিৎসায় যে চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তার জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।


নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এত ব্যাপকতা লাভ করত না যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটু নরম মনের পরিচয় দিয়ে মমতাময়ী হয়ে কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামা জুনিয়রদের সামনে এসে দাঁড়াতেন, সমব্যথী হয়ে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে রােগীদের স্বার্থে কাজে যােগদানের আবেদন জানাতেন। কিছুদিন আগেও তিনি মেয়ে রােডে অনশনরত শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের চাকরি হবে– এই আশ্বাসে তাঁরা অনশন ভেঙেছিলেন। উনি তা করলেন না– রাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনারকে পাঠালেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝিয়েসুঝিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে। তিনি এসএসকেএম বহির্বিভাগে রােগীর অবস্থা দেখতে গিয়ে আন্দোলনরত ডাক্তারদের রােষে পড়লেন। তাঁর সঙ্গেও অভব্যতা করা হল– তিনি চিকিৎসকদের অবিলম্বে কাজে যােগদান করার নির্দেশ দিলেন। নইলে কঠোর ব্যবস্থা। আইএমএমের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার থ্রেট– সব মিলেই চিকিৎসক এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি বড় সংঘাতের রাস্তা খুলে গেল।

এক্ষেত্রে প্রায়শই যা ঘটে অর্থাৎ রাজনীতি ঢুকে গেল। বহিরাগত তত্ত্ব চলে এল। রাজ্যপালও চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে উদ্বিগ্ন হলেন। তারপর জল যেভাবে গড়ায়, সেইভাবেই গড়াল। শেষপর্যন্ত বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে নীলরতনের আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। মুখ্যমন্ত্রীকেই তাঁদের কাছে এসে আলােচনায় বসতে হবে এই দাবি থেকে সরে এলেন। আন্দোলনকারীদের মনােভাবে এই পরিবর্তন প্রশংসনীয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তারদের সঙ্গে চিকিৎসাসংক্রান্ত নানা বিষয়ে কথা বললেন, তাদের সমস্যা শুনলেন এবং সহানুভূতি সহকারে তা সমাধান করার আশ্বাস দিলেন।

একথা সত্যি, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের ওপরই চাপ বেশি। তাঁরাই হাসপাতালে চিকিৎসা চালান, রােগীর দেখভাল তাঁরাই বেশি করেন। সুতরাং তাঁদের কাজের জন্য হাসপাতালে সুস্থ পরিবেশ থাকা বিশেষ প্রয়ােজন। আবার চাপ বেশি বলে ধৈৰ্য্য হারিয়ে রােগীর সঙ্গে, তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ভুললে চলবে না, ডাক্তাররা যদি কোনও কারণে রােগী দেখা, রােগী সেবা বন্ধ করে দেন, তাহলে বহির্বিভাগে যে হাজার হাজার রােগী গ্রামগঞ্জ থেকে ভাল চিকিৎসার জন্য কলকাতার হাসপাতালে আসেন, অথবা ইনডােরে যেসব চিকিৎসাধীন রােগীরা ভর্তি আছেন, তাদের অবস্থা কী হতে পারে? চিকিৎসকেরা রােগীর চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তােলেন, তার মুখে হাসি ফুটিয়ে তােলেন। সে আবার জীবন ফিরে পায়, বাঁচার আনন্দে তার মন ভরে ওঠে। ডাক্তারদের এই পেশার সঙ্গে অন্য কোনও পেশার তুলনা চলে না।

সরকারি হাসপাতালে আবার একটি চিকিৎসার সঙ্কট কাটল। কিন্তু অতীতেও এই ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসকদের নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে– তাঁরা প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছেন। সরকার সব দাবি মেনে নিয়েছে। তাঁরা আবার কাজে যােগদান করেছেন। এবারও সরকার সব দাবি মেনে নিল। সবই তাে হল, কিন্তু বলা কি যায়, এই ধরনের চিকিৎসক- নিগ্রহের ঘটনা আর ঘটবে না? চিকিৎসায় গাফিলতি না হলেও, গাফিলতির অভিযােগ এসে পড়ে মৃতের আত্মীয়স্বজনেরা আপনজনের মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারেন না। দোষ এসে পড়ে চিকিৎসকের ওপর।

আর সেই কারণেই চিকিৎসকদের ওপর বিরাট চাপ থাকলেও, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটলে চলবে না। মেজাজ না হারিয়ে রােগীর আত্মীয়স্বজনদের ভালভাবে বােঝাতে হবে যে মৃত্যু কোনও ত্রুটির জন্য নয়। চিকিৎসককে মনে রাখতে হবে তিনি একজন রােগীর রােগ সারানাের কাজে রত। সে কাজটি মহান।