• facebook
  • twitter
Thursday, 17 April, 2025

বিপন্ন গণতন্ত্র

এখানে এটাও উল্লেখের দাবি রাখে যে, বিচারপতিদের প্রভাবিত করার বিষয়টি শুধু যে আর্থিক মূল্য দ্বারা সংগঠিত হতে হবে, তা কিন্তু নয়।

ফাইল চিত্র

নিম্ন আদালত বা উচ্চ আদালতের রায়ের মধ্যে প্রায়শঃ পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্যের অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো উপস্থাপিত নথিসমূহের পর্যবেক্ষণের প্রশ্নে বিভিন্নতা এবং আইনি ব্যখ্যার তারতম্য। এই প্রশ্নে স্বার্থ নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিসত্তার প্রভাব থাকে না একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তার অর্থ এই নয় যে সকলেই এই সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন। সামগ্রিকতার প্রেক্ষিতে তা নগণ্য হলেও জনমানসে তার নেতিবাচক প্রভাব অপরিসীম। কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও স্বাতন্ত্র্যতার প্রশ্ন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারপতি নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে রচিত যে আইন ইতিমধ্যে অবৈধ হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা ঘোষিত, সেই আইনের প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৪-র আইনকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়, তবে তা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামাকেই যে শুধু দুর্বল করবে তাই নয়, শাসককেও বেপরোয়া হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এখানে এটাও উল্লেখের দাবি রাখে যে, বিচারপতিদের প্রভাবিত করার বিষয়টি শুধু যে আর্থিক মূল্য দ্বারা সংগঠিত হতে হবে, তা কিন্তু নয়।

একটা নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রকে কোন লক্ষ্যে এবং কার স্বার্থে ব্যবহার করবে তাই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নের মোকাবিলায় অনেক ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উপেক্ষিত থেকেছে এবং তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্রের এই বিকৃতরূপকে মার্জিতকরণের বা মান্য রূপদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদ নানা কথা বলেছেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ফরাসি দার্শনিক মনটেস্কু প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে আইন প্রণয়ন, প্রশাসন (আইন প্রয়োগ) এবং বিচারব্যবস্থাকে পৃথক সত্তা বিশিষ্ট সংস্থা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনও দেশে প্রস্তাবিত এই নীতি সংবিধানে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়, তবে সরকারের আচরণে তার প্রকাশ ঘটছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব বর্তায় বিচারব্যবস্থার উপর। এই নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যেমন বিচারব্যবস্থার ভূমিকা থাকে, তেমনই সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের বিরোধ, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে উদ্ভূত বিরোধ সাংবিধানিক পথে নিষ্পত্তির দায়ও বিচারব্যবস্থাকেই নিতে হয়। প্রতিটি প্রশ্নেই সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা হলো এই বিচারব্যবস্থা। এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি দুর্বল হলে বা প্রভাবিত হলে তা যে কোনও দেশের পক্ষেই যথেষ্ট চিন্তার কারণ।

নৈতিক মূল্যবোধের কারণে একই অপরাধে একজন সাধারণের অপেক্ষা অধিকতর দায়িত্ববান ব্যক্তির শাস্তি অধিক হওয়ার কথা। বাস্তবে বিপরীতটাই ঘটতে দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে সুবিধা মেলে বিপুল অর্থদানের মধ্য দিয়ে, এই ধারণা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। স্থূল অর্থে যা বিচার বিক্রির প্রতিদান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যভাবে যাকে বলা যায় অন্যায্য সুবিধাদানের বিপরীতে ন্যায্য বিচারে বঞ্চিত করার ফল হলো এই বিনিময় মূল্য।

ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে একজন বিচারপতি সুবিধা প্রাপ্তির প্রশ্নে বিনিময় মাধ্যম কী হবে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে জনমানসে তার প্রভাব কী পড়ছে, তা দেখা। এই প্রশ্নে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজও তার দায় এড়াতে পারে না। বিচারব্যবস্থায় ঘুণ ধরলে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক।