নাজমুল হক
বাংলা চিরকালই ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানে ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন—সব উৎসবেই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই মিলিত হন, আনন্দ ভাগ করে নেন।
রমজান মাস শেষে যখন ঈদের চাঁদ ওঠে, তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এক মাস রোজার পর ঈদগাহের মাঠে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় করেন। এই খুশির দিনে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ভাই-বোনেরাও মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন, মিষ্টিমুখ করেন। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে সকলে এক হয়ে ঈদ উৎসবে শামিল হন।
ঠিক তেমনই, দুর্গাপূজার সময়েও বাংলার চিরচেনা ছবি—প্যান্ডেল তৈরিতে, আলোকসজ্জায়, প্রতিমা গড়ার কাজে মুসলিম ভাইয়েরাও তাদের শিল্পকর্ম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আর পূজার আনন্দে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সবাই একসঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেন। বড়দিনের সময়ও দেখা যায় একই ছবি—চার্চের কেক কাটার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, প্রার্থনায় শামিল হন সবাই।
বাংলার এই চিরায়ত সৌহার্দ্যের বাতাবরণেই বাঙালি বড় হয়েছে। ধর্ম কখনো বিভেদ সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষের মনকে আরও উদার করে তুলেছে।
কিন্তু সম্প্রতি, বিরোধী দলনেতা এবং বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারী ধর্মীয় সম্প্রীতির এই চিত্রকে আঘাত করছেন। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা বাংলার মাটিতে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলার সংস্কৃতি কখনোই ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। বরং একে অপরের উৎসবে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়েই এখানে ধর্মীয় মেলবন্ধন শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা যখন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি করেন, তখন তা বাংলার দীর্ঘদিনের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
সত্যিকারের ধর্মানুসারী ব্যক্তি কখনো অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না। বরং সব ধর্মের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই ধর্মের বিকাশ ঘটে। বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে এই বিভেদের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করা জরুরি।
আমাদের এই মিলনময় উৎসবের পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখা, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
শুভেন্দু অধিকারী বর্তমানে যে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তা মূলত তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ এবং বিজেপির কাছে নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধি করার কৌশল। তিনি সত্যিই যদি হিন্দু ধর্মের রক্ষক হতেন, তবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার সময় তিনি প্রতিবাদ করতেন, কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি বিজেপির অবজ্ঞার বিরুদ্ধেও তিনি সরব হতেন। আসল কারণ তিনি ধর্মকে ব্যবহার করছেন শুধুমাত্র নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে।
শুভেন্দু অধিকারী মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যই সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রকৃত সনাতনী হিন্দু ধর্মের মূল আদর্শ হলো ভক্তিবাদ, যেখানে বিদ্বেষের স্থান নেই। সনাতনী ধর্ম সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখায় অথচ শুভেন্দু সেই আদর্শকে উপেক্ষা করে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা তার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে।
এক সময় তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন, মন্ত্রিত্ব সামলেছেন এবং বিভিন্ন জেলার দায়িত্বেও ছিলেন। মুর্শিদাবাদ সহ অন্যান্য মুসলিম-প্রধান অঞ্চলে কাজ করার কারণে তার সঙ্গে বহু মুসলিম নেতার যোগাযোগ ছিল, যা আজও হয়তো বজায় রয়েছে। অতীতে তিনি কখনো মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু আজ রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার স্বার্থে তাকে এই ভূমিকা নিতে হচ্ছে। যেটা একান্তই তার রাজনৈতিক উদ্যেশ্য প্রনোদিত।
অন্যদিকে, তৃণমূল নেতা হুমায়ুন কবীরও শুভেন্দুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে “আমার জাতি আগে, তারপর দল” বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটিও আসলে রাজনৈতিক স্বার্থেই দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে, বিজেপিকে তিনি মুসলিম বিদ্বেষী দল বললেও, একসময় তিনিও বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদি তিনি সত্যিই মুসলমান জাতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন, তাহলে কখনই তিনি বিজেপিতে যোগ দিতেন না। আজ শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তার যে কঠোর অবস্থান, সেটাও মূলত রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কৌশল। ফলে তাকে প্রকৃত অর্থে মুসলমান জাতির দরদী একজন মনে করার কোনো কারণ নেই।
সত্য হলো, শুভেন্দু অধিকারী হিন্দু ধর্মের রক্ষক নন, তেমন হুমায়ুন কবীরও মুসলিম জাতির প্রকৃত প্রতিনিধি নন। দুজনেই মূলত নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে ধর্মকে ব্যবহার করছেন। এখানে আদর্শ বা ধর্ম নয়, রাজনীতিই মূল চালিকা শক্তি।
এই পরিস্থিতি আমাদের একটি গভীর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। রাজনীতি ও ধর্ম যখন একে অপরের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন মূল যে সত্যটি হারিয়ে যায়, তা হলো মানবতা। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মের মূল শিক্ষা সম্প্রীতি ও মানবতার চর্চা। তাই রাজনীতির নামে ধর্মের অপব্যবহার আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত এবং মানবতার আদর্শকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব
দেওয়া উচিত। সব জাতির জন্য তা মঙ্গলময় হবে।